কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা দেশেই করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন উৎপাদনে সরকারের উদ্যোগ গ্রহণের কথা জানিয়ে বলেছেন, দেশে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে বিদেশ হতে ভ্যাকসিন সংগ্রহের পাশাপাশি দেশেই ভ্যাকসিন উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়ে ভ্যাকসিন আবিষ্কারক দেশের সঙ্গে সরকারী পর্যায়ে (জিটুজি) আলোচনা অব্যাহত আছে। একই সঙ্গে সরকার মহামারী করোনাসহ ভাইরাস প্রতিরোধক ভ্যাকসিন উৎপাদনের লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি মন্ত্রীসভায় অনুসমর্থন ও অনুমোদনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার জাতীয় সংসদে টেবিলে উত্থাপিত প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকারী দলের সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটু প্রশ্নের লিখিত জবাবে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। অন্য প্রশ্নের লিখিত জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারের পদক্ষেপে বিশ^ ঐতিহ্য সুন্দরবনের আয়তন বেড়েছে। একই সঙ্গে বাড়ছে বাঘের সংখ্যাও। মুজিববর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের জন্য গৃহনির্মাণ করে দিচ্ছে সরকার। সারাদেশে এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের ‘মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই’ কথাটি চিরতরে বিলুপ্ত করতে সরকার বদ্ধপরিকর।
দেশে করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও জানান, দেশে তিনটি প্রতিষ্ঠান- মেসার্স ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড, মেসার্স পপুলার ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড ও মেসার্স হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন উৎপাদনের সক্ষমতা ইতোমধ্যে যাচাই করা হয়েছে। মেসার্স গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাদের উদ্ভাবিত কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনটি বর্তমানে ট্রায়াল পর্যায়ে।
সুন্দরবনের আয়তন বৃদ্ধি, বাঘও বেড়েছে : সংরক্ষিত আসনের সুলতানা নাদিরার প্রশ্নের লিখিত জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন ‘সম্প্রসারিত হচ্ছে’ এবং বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার সুন্দরবন ও এর জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়ে সব সময় আন্তরিক ও বদ্ধপরিকর। যে কারণে দেশের উন্নয়নে যে পদক্ষেপই নেয়া হোক না কেন সুন্দরবন এবং এর জীববৈচিত্র্য যেন কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়।
সংসদ নেতা বলেন, সুন্দরবনের আয়তন বাড়ানোর জন্য সরকার কৃত্রিম ম্যানগ্রোভ সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে। সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলে এর বিস্তৃতি ঘটানোর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সুন্দরবনের বৃক্ষাদি এবং বন্যপ্রাণী রক্ষার জন্য তথা বন অপরাধ দমনের জন্য স্মার্ট পেট্রোলিংসহ নানাবিধ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সুন্দরবন সম্প্রসারিত হচ্ছে।
সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে ২০১৫ সালের বাঘ শুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। ২০১৮ সালের শুমারিতে এই সংখ্যা ১১৪টি পাওয়া গেছে। সুন্দরবনের কার্বন মজুদের পরিমাণ ২০০৯ সালের ১০৬ মিলিয়ন টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯ সালে ১৩৯ মিলিয়ন টন হয়েছে। তিনি জানান, সুন্দরবনে এখন ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির অর্কিড এবং ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী পাওয়া যায়। বন্যপ্রাণীর মধ্যে ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর, ৩১৫ প্রজাতির পাখি, ২১০ প্রজাতির মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া আছে।
সুন্দরবনের গাছপালা ও বন্যপ্রাণীকুলকে রক্ষার জন্য বনকর্মীদের যুগোপযোগী করে তুলে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির পদক্ষেপের কথাও জানান সরকারপ্রধান। তিনি জানান, যথাযথ পদক্ষেপের কারণে সুন্দরবন সম্প্রসারিত হচ্ছে। ২০১৭ সালে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এলাকা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বর্তমানে সুন্দরবনের প্রায় ৫৩ শতাংশ এলাকা অভয়ারণ্যের অন্তর্ভুক্ত।
কেউ গৃহহীন থাকবে না : সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আ ক ম সরওয়ার জাহানের প্রশ্নের লিখিত জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের তালিকা করা হয়েছে। ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের সংখ্যা ২ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬১টি। আর জমি আছে কিন্তু ঘর নেই এমন পরিবার রয়েছে ৫ লাখ ৯২ হাজার ২৬১টি। ‘দেশের একজন মানুষও ভূমিহীন থাকবে না’ এ ঘোষণা বাস্তবায়নে পর্যায়ক্রমে সকলকে পুনর্বাসন করা হবে। তিনি জানান, মুজিববর্ষ উপলক্ষে গত ২৩ জানুয়ারি ৬৫ হাজার ৪০টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ঘর দেয়া হয়েছে। আগামী ২০ জুন আরও ৫৩ হাজার ৩৪০টি ঘর দেয়া হবে।
একই প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভিক্ষুক, বেদে এবং হিজরা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। খাস জমি না পাওয়া গেলে প্রয়োজনে জমি কিনে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। তিনি আরও জানান, ১৯৯৭ থেকে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৫৬২ পরিবারকে গৃহ নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ ৬৮ হাজার ৪৮ পরিবারকে ব্যারাকে, এক লাখ ৫৩ হাজার পরিবারকে নিজ জমিতে ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া এর মধ্যে ৪৯ হাজার ৩৩৪ পরিবারকে ২ শতাংশ করে জমি বন্দোবস্তসহ এবং ঘূর্ণিঝড় আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত ১১শ’ পরিবার রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর বিশেষ স্মৃতিবিজড়িত স্থান সংরক্ষণ : তরিকত ফেডারেশনের সদস্য আনোয়ার হোসেনের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজধানী ঢাকাসহ দেশের যে সকল স্থানে অবস্থান করে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সে সকল স্থান বিশেষভাবে সংরক্ষণের জন্য বর্তমান সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ স্মরণে ভাস্কর্য নির্মাণ করা হবে। ইতোমধ্যে ১৫০ ফুট উঁচু গ্লাস টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। যশোরের রাজগঞ্জ বাজারে ও ফরিদপুরের আম্বিকা ময়দানে বঙ্গবন্ধু স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হবে।
রাজধানী ঢাকার মিন্টু রোড ও আব্দুল গণি রোডের ভবনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ছিল বিধায় সেগুলো সংরক্ষণের বিষয়ে আইনানুগ কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি জানান, বাংলাদেশের যে সকল স্থানে বঙ্গবন্ধু বিশেষ স্মৃতিবিজড়িত ঐ সকল স্থান ঘটনার তাৎপর্য, ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় স্মৃতিস্বরূপ সংরক্ষণ করা হলে তরুণ ও ভবিষ্যত প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর জীবন ও আদর্শ সম্পর্কে অবহিত হতে পারবে।
সাংবাদিকদের ৪৫ ভাগ মহার্ঘভাতা দিতে আইন : সরকারী দলের সদস্য শহীদুজ্জামান সরকারের প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা জানান, সরকার গণমাধ্যমকর্মীদের ৪৫ শতাংশ মহার্ঘভাতা নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়ন করেছে। এটি অনুমোদনের জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তিনি জানান, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া উভয়ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা কর্মস্থলে চাকরির অনিশ্চয়তায় ভোগেন। এটা স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য হুমকি। তাদের চাকরির এ অনিশ্চয়তা দূর করতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলী) আইন প্রণয়ন করছে, যা বর্তমানে অনুমোদনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সাংবাদিকদের আবাসনের জন্যও বিশেষ প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
একই প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, দেশের গণমাধ্যমকে সব ধরনের সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে সমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সমুন্নত রেখেছে সরকার। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সাংবাদিকদের পরিবারকে সহায়তা দেয়ার জন্য ১০ কোটি টাকা আর্থিক অনুদান দেয়া হয়েছে। করোনায় প্রেসক্লাবের আয় কমে যাওয়ায় মে মাসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্য ৫০ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান প্রদান করা হয়েছে। সংবাদকর্মীদের কল্যাণে বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকার ২০১৩ সালে অষ্টম সংবাদপত্র মজুরি বোর্ড রোয়েদাদ ঘোষণার মাধ্যমে সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছে।
নবম ওয়েজ বোর্ড রোয়েদাদ ঘোষণার মাধ্যমে সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে বলে জানান সংসদ নেতা। তিনি আরও জানান, বিভিন্ন সময় গুরুতর আহত ও অসুস্থ সাংবাদিকদের দেশ-বিদেশে উন্নত চিকিৎসার ব্যয়ভার সরকার বহন করেছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকেও সাংবাদিকদের জন্য অর্থ প্রদানসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী জানান, বর্তমানে দেশে প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যা তিন হাজার ২২২টি। এছাড়া সরকার বেসরকারী খাতে ৪৫টি টেলিভিশন, ২৭টি এফএম রেডিও এবং ৩১টি কমিউনিটি রেডিও চ্যানেলের অনুমতি দিয়েছে। তিনি আরও জানান, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের ফলে গণমাধ্যম অঙ্গন শক্তিশালী হয়েছে। দেশে টিভি চ্যানেলগুলো এখন অনেক কম খরচে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ ব্যবহার করে সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
মাছের উৎপাদন ৫০ ভাগ বৃদ্ধি : সরকারদলীয় সংসদ সদস্য সহিদুজ্জামানের প্রশ্নের লিখিত জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, সরকারের কার্যকর ও ফলপ্রসূ পদক্ষেপে গত ১১ বছরে দেশে মাছের উৎপাদন ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতিসংঘের ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে। এখন আমরা মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমানে দৈনিক ৬০ গ্রাম চাহিদার বিপরীতে আমরা ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম মাছ গ্রহণ করছি।
তিনি বলেন, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধির জন্য ২০০০ সালে ৬৯৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা রিজার্ভ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং তা সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এছাড়া ইকোফিশ প্রকল্পের সহায়তায় নিঝুমদ্বীপ সংলগ্ন এলাকায় ৩ হাজার ১৮৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা (এমপিএ) হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে মা ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকার সময়ে ৫১ দশমিক ২ ভাগ ডিম দেয়ার সুযোগ পেয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন ৫ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন।