দেশের ৬৪ জেলায় ২ লাখ মানব পাচার মামলা বিচারাধীন

6

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মানব পাচারের ঘটনা কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। ইউরোপসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে বেশি বেতনের চাকরি ও উন্নত জীবনযাপনের প্রলোভনের টোপে ফেলে দালাল চক্র যুবকদের পাচার করছে। এই প্রক্রিয়া দিনে দিনে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি ফাঁকি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার সময়ে গত রবিবার ১৬৪ বাংলাদেশীকে আটক করেছে লিবিয়ার কোস্টগার্ড। আগের দিন শনিবার ইউরোপের দেশ উত্তর মেসিডোনিয়াতে যাওয়ার সময়ে ২০ বাংলাদেশীকে আটক করেছে মেসিডোনিয়ার পুলিশ। বিদেশস্থ দূতাবাসের মাধ্যমে এই মানব পাচারের ঘটনা অবহিত হয়েছে সরকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এই ঘটনার খবর পাওয়ার পর মানব পাচারকারী চক্র ও দালাল চক্রের খোঁজে তৎপর হয়ে উঠেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, সরকার মানবপাচার রোধকল্পে কঠোর অবস্থান নেয়ার পরও মানবপাচার থেমে নেই। দেশের ৬৪ জেলায় বর্তমানে পৌনে দুই লাখ মানবপাচার মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে ৩০ হাজার ৭১১টি মামলা। গত ৮ বছরে গ্রেফতার করা হয়েছে ৬ হাজার মামলায় ৯ হাজার ৬৯২ জনকে। এই সময়ে সাজা হয়েছে ৫৪ জ[েজঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশনর। তবে মামলা নিষ্পত্তির হার খুবই কম। মানবপাচারের শিকারে পরিণত হওয়া অনেকেই মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের বনেজঙ্গলে থাকার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
অপর এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে গত ১০ বছরে ২ লাখ নারী, পুরুষ ও শিশু পাচার হয়েছে। প্রতিবছর ২০ হাজার নারী ও শিশু ভারত, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়ে যায়। ভারতে অথবা ভারত হয়ে অন্য দেশে ৫০ হাজার নারী পাচার হয়ে গেছে এমন তথ্য উঠে এসেছে মানবপাচার সংক্রান্ত প্রতিবেদনে। মানবপাচারের অভিযোগে মামলা হয়েছে প্রায় ছয় হাজার। সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেয়ার পরও মানবপাচার বন্ধ হচ্ছে না। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে মানবপাচার বন্ধ হচ্ছে না। প্রতিবছরই সাগরে ডুবে মারা যাচ্ছে রোহিঙ্গাসহ বাংলাদেশের নাগরিকরা।
২০২০ সালে মানবপাচার তথা টিআইপি বা বৈশ্বিক ট্রাফিকিং ইন পারসন টিআইপি সূচকে বাংলাদেশ একধাপ এগিয়েছিল। টায়ার মাইনাস টু থেকে টায়ার টু তে উন্নীত হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশই প্রশংসা করেছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি ও তৎপরতার মধ্যেই মানবপাচারের ঘটনা আবার বাড়ছে। রবিবার ভূমধ্যসাগর থেকে ৪৩৯ জন অভিবাসন প্রত্যাশীকে উদ্ধার করেছে লিবিয়ার কোস্টগার্ড। তাদের মধ্যে ১৬৪ বাংলাদেশী রয়েছেন। লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে বিষয়টি অবহিত হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। লিবিয়া অবজারভারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বৃহস্পতিবার পৃথক দুটি উদ্ধার অভিযান চালায় দেশটির কোস্টগার্ড। এই অভিযানে ৪৩৯ অভিবাসন প্রত্যাশী উদ্ধার হয়। তারা আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের নাগরিক। তারা সমুদ্রপথে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। লিবিয়ার দুটি উদ্ধারকারী জাহাজ এই অভিযানে অংশ নেয়। রাবারের তৈরি ডিঙিতে ওই অভিবাসন প্রত্যাশীরা ইউরোপের উপকূলের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধারের পর অভিবাসন প্রত্যাশীদের লিবিয়ার ত্রিপোলির নৌঘাঁটিতে আনা হয়। পরে তাদের লিবিয়ার অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধ-বিষয়ক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। চলতি বছর দেশটির কোস্টগার্ড সমুদ্র থেকে ৯ হাজারের বেশি অভিবাসন প্রত্যাশীকে উদ্ধার করেছে। এই অভিবাসন প্রত্যাশীরা সমুদ্রপথে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। আর ২০২০ সালে উদ্ধার করা হয় ৭ হাজারের বেশি অভিবাসন প্রত্যাশীকে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ জুন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরে ৮১৩ অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে।
অপরদিকে পুলিশ সদর দফতরের আরেক খবরে জানানো হয়েছে, ইউরোপের দেশ উত্তর মেসিডোনিয়াতে ২০ বাংলাদেশী আটক করার খবর দিয়েছে উত্তর মেসিডোনিয়ার পুলিশ প্রশাসন। অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের দায়ে তাদেরকে আটক করা হয়েছে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের বিবৃতি অনুযায়ী শনিবার নিয়মিত টহলের সময় একটি ভ্যান থেকে তাদের আটক করা হয়। সার্বিয়ার সঙ্গে দেশটির সীমান্তের কাছাকাছি একটি মহাসড়ক থেকে তাদের আটক করা হয়। এদের মধ্যে ৯ জনের বয়স আঠারো বছরের নিচে। তাদেরকে বহন করা ভ্যানের ড্রাইভার ছিলেন একজন উত্তর মেসিডোনিয়ান, যার বয়স অনুমানিক ৪৪ বছর। বর্তমানে তাকে পুলিশের হেফাজতে রাখা হয়েছে। বর্তমানে আটক হওয়া এসব অভিবাসন প্রত্যাশীকে মেসিডোনিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর জেভেলিয়াতে রাখা হয়েছে। মেসিডোনিয়ার পুলিশের দেয়া তথ্যানুযায়ী, আটক বাংলাদেশীরা বলকান উপদ্বীপের সবচেয়ে দক্ষিণের দেশ গ্রিস থেকে মেসিডোনিয়াতে প্রবেশ করেছিলেন। তাই খুব শিগগিরই তাদেরকে গ্রিসে ফেরত পাঠানো হবে। অবৈধভাবে ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগালসহ সেনজেনভুক্ত বিভিন্ন দেশে অনুপ্রবেশের জন্য বর্তমানে বলকানের এ রুটটি ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে তুরস্ক ও গ্রিস থেকে ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন ও পর্তুগালের মতো সেনজেনভুক্ত দেশগুলোতে অনুপ্রবেশের লক্ষ্যে উত্তর মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো ও বসনিয়া এ্যান্ড হার্জেগোভিনার মতো বলকান পেনিনসুলার দেশে অনেক অভিবাসন প্রত্যাশী ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে মানবপাচারের অভিযোগ নতুন কোন ঘটনা নয়। কিন্তু সম্প্রতি লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশীকে হত্যার ঘটনার পর তা পুনরায় দেশ-বিদেশে আলোচনায় উঠে এসেছে। লিবিয়ায় মানবপাচারের ঘটনায় অর্ধ শতাধিক দালালকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তদন্তও হচ্ছে। চলতি বছর ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের ৬৪ জেলায় মানবপাচারের অভিযোগে দায়ের হওয়া ১ লাখ ৮০ হাজার ৬৭৫টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। পুলিশের সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে পাচারকারীরা ইউরোপে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে মানুষকে লিবিয়ায় নিচ্ছে। সেখানে তারা অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ইউরোপে যেতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকে মারা যান। ২০১২ সালে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনটি হওয়ার পর থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার মামলায় ৯ হাজার ৬৯২ জন গ্রেফতার হয়েছেন। আর ২০১৪ সাল থেকে এযাবৎ মাত্র ৫৪ জনের সাজা হয়েছে। গত প্রায় আট বছরে দেশে ৫ হাজার ৭১৬টি মামলা করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২৪৭টি অর্থাৎ মাত্র ৪ শতাংশ মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বিচারাধীন আছে প্রায় ৪ হাজার ৪০৭টি মামলা।
অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি থেকে মানবপাচার মামলার নথির তথ্যানুযায়ী এক মামলায় ১১৮ বার তারিখ পড়ার পরও সাক্ষী পাওয়া যায়নি। ক্যান্টনমেন্ট থানার ২০০২ সালের একটি মামলায় সাক্ষী হাজির করার তারিখ পড়েছিল ৫৫ বার। তেজগাঁও থানায় ২০০৫ সালের একটি মামলায় পড়েছিল ৪৭ বার। এই ধরনের ১৮টি মামলায় বারবার তারিখ পড়ার তথ্য পেয়েছেন। ২০১১ সালে ফিরে এসে মামলা করেন একজন ভুক্তভোগী। সেই মামলা এখনও চলছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনে আছেন। অথচ এই আইনের মামলা জামিনযোগ্য নয়। এ ছাড়া আইনে সুযোগ না থাকলেও অনেক সময় দুই পক্ষ আপোস করে ফেলে। তখন মামলা চালানো কঠিন। আইন বলছে, ৯০ দিনের মধ্যে পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন দেবে এবং ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে। তেমন নজির প্রায় নেই। আইনটিতে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাবাস। সঙ্গে মোটা অর্থদণ্ড আছে।
মানবপাচার মামলা পরিচালনাকারী রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেছেন, মামলার বিচারের ধীরগতি হওয়ার পেছনে চারটি কারণ। অভিযোগকারীর চেয়ে আসামিপক্ষ অর্থ-বিত্তে ক্ষমতাশালী হওয়া ও আসামিপক্ষ বেশি তৎপর থাকায় মামলার ওপর প্রভাব ফেলে। বাদীপক্ষ আদালতের বাইরে মীমাংসা করতে বাধ্য হয় এবং সেটি সম্ভব হয় অপরাধটির ভয়াবহতা নিয়ে প্রচার বেশি না থাকার কারণে। তারা এও বলছেন, কোন অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির না থাকলে, সেটি খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেয় না কোন পক্ষই। মানবপাচারের মামলাগুলো বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয় খুব জরুরী। সম্প্রতি লিবিয়ায় মানবপাচারকারীদের গুলিতে নিহত ২৬ বাংলাদেশী মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ ও যশোরের অধিবাসী। এসব জেলার মানবপাচার বিষয়ক আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটরদের সঙ্গে কথা বলে ও মানবপাচারের চলমান মামলার দীর্ঘসূত্রতাসহ এই চার কারণ জানা যায়।
অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের বিমানবন্দর থেকে শুরু করে লিবিয়া পর্যন্ত চক্রের জাল বিছানো। পাচারকারীরা দফায় দফায় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা নেন। দেশ থেকে হুন্ডি করে টাকা আনাতে হয়। লিবিয়ায় প্রায়ই কোন দল অপহরণ করে নিয়ে যায়। মুক্তিপণ দিতে হয়। অনেক সময় অভিবাসনের নামে পাচার চলে। ইউরোপে অভিবাসনের হাতছানিতে গত বছরও ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গেছেন এবং উদ্ধার হয়েছেন অনেক বাংলাদেশী। লিবিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে ২০১১ সালে ৩৭ হাজার বাংলাদেশীকে ফেরত আনা হয়েছিল। তারপর দেশটি পাচারের পথ হয়ে ওঠে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী, মাদারীপুর, শরীয়তপুরসহ নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে গড়ে ওঠা দালাল চক্র এলাকার লোককে এই পথে পাচারের ব্যবসায় যুক্ত।
অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, গত ২৭ মে লিবিয়ায় গুলিতে হত্যা করা হয়েছে ২৬ বাংলাদেশীকে। ২ জুন র‌্যাব কামাল হোসেন ওরফে হাজি কামালকে (৫৫) গ্রেফতার করেছে। র‌্যাব বলছে, তিনি মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা। অভিজ্ঞজনেরা যদিও বলছেন, মূল ব্যক্তিরা সচরাচর ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। মানবপাচার চক্রের মূল অংশটি দেশের বাইরে। স্থানীয় পর্যায়ে কিছু দালাল কাজ করে। অনেকক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা তথ্য দেন না। মানবপাচার মামলায় সাক্ষী নিয়মিত পাওয়া যায় না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমনে ২০১২ সালে যে আইনটি করা হয়েছে, সেটি চমৎকার একটি আইন। তদন্ত ও শাস্তিসহ বেশকিছু বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু এই আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এছাড়া, জাতীয় যে কর্মপরিকল্পনা রয়েছে সেটাও ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। মানবপাচারের মামলাগুলো বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যায়নি আট বছরেও। এ বছর সাতটি বিভাগে ট্রাইব্যুনাল চালু করে বিচার করার কথা আছে। মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমনের যে আইনটি আছে তার বাস্তবায়ন করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই ধরনের উদ্যোগের সফল বাস্তবায়ন করা গেলে মানবপাচার সংক্রান্ত ভয়াবহ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো সম্ভব বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্মকর্তার দাবি।