॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
মানবদেহের বিভিন্ন গুণের রক্তের আবিষ্কারক নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টেইনারের জন্মদিন ১৪ জুন। তার জন্মদিনকে মর্যাদাদান এবং প্রাণ বাঁচাতে রক্তদানকে উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্য নিয়ে ২০০৪ সাল থেকে পালিত হচ্ছে এই দিবস। এ দিবসে ২০০৪ সালের প্রতিপাদ্য পহ্ছে, ‘রক্ত জীবনের জন্য উপহার- ধন্যবাদ’। বিনামূল্যে স্বেচ্ছায় রক্তদানের মহান ত্যাগকে অভিনন্দন এবং দাতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সারা বিশ্বে পালিত হয় বিশ্ব রক্তদাতা দিবস।
রক্তদান এক মহান ত্যাগের নিদর্শন। কোটি কোটি মানুষ দান করছে তার শরীরের রক্ত বিনামূল্যে, নির্দ্বিধায়, স্বেচ্ছায় অপর কোটি মানুষের জন্য। অথচ কেউ কাউকে জানে না, চেনেনা। এতে দাতার নেই কোনো পুরস্কার, নেই প্রশংসা। একজনের রক্ত অজান্তেই চলে যাচ্ছে অজানা অন্যজনের শরীরে। কিন্তু এতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে নিরাপদ রক্ত। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বেড়ে চলছে রক্তদাতার সংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ছে নিরাপদ রক্ত নিয়ে ঝুঁকি।
জরিপে বলা হয়েছে, প্রতি বছর ৮০ মিলিয়ন ইউনিট রক্তদান করা হচ্ছে। তন্মধ্যে ৩৮% সংগ্রহ হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশে। যেখানে বিশ্বের ৮২% মানুষের বাস। এই ৮২% মানুষের অনেকেই রক্তের জন্য নির্ভর করে পরিবার, পিতামাতার বন্ধুদের ওপর। অনেকক্ষেত্রেই রক্তদানের জন্য করতে হয় মূল্য পরিশোধ। বিশ্বব্যাপী দেখা গেছে স্বেচ্ছাসেবী রক্ত সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানের সংগৃহীত রক্ত নিরাপদ হিসেবে পাওয়া যায় এবং এই রক্তের পুরোটাই স্বেচ্ছায়, বিনামূল্যে রক্তদান।
রক্তদাতা দিবস পালনের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় রক্তদানের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করবে এবং অধিক মানুষকে নিয়মিত রক্তদাতা হতে উৎসাহিত করবে। যারা নিয়মিত রক্তদাতা তারা জানেন না তার রক্ত কোথায় যায়, কার শরীরে প্রবেশ করছে রক্ত, কার জীবন বাঁচাচ্ছে। তাদের এই নিয়মিত ত্যাগকে বিশেষভাবে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানায় এই দিবস। এই দিবসে আরও আশা প্রকাশ করা হয় যে, নতুন প্রজন্ম এই রক্তদানের মহান ধারকে ধরে রাখবে। যখন যেখানে প্রয়োজন হবে উপহার দেবে নিরাপদ রক্ত। বাঁচাবে জীবন। বিশ্ব রক্তদাতা দিবস নতুন প্রজন্মকে তাই বিশেষভাবে ফোকাস করছে ভবিষ্যতের জন্য।
দিবসটি তুলে ধরছে ‘নিরাপদ রক্তের ভিত্তি হচ্ছে স্বেচ্ছায় রক্তদান’- এর বিষয়টিকে।
১৬১৬ সালে ইংরেজ চিকিৎসক ডা. উইলিয়াম হার্ভের গবেষণার মাধ্যমে মানুষ মানবদেহের অভ্যন্তরে রক্ত প্রবাহের বিষয়ে জানতে পারে। স্যার ক্রিস্টোফার রেন ১৬৫৭ সালে ডা. উইলিয়াম হার্ভে আবি®কৃত যন্ত্র ব্যবহার করে জন্তুর দেহে ইনজেকশনের মাধ্যমে তরল পদার্থ প্রবেশ করান। ডা. রিচার্ড লোয়ার ১৬৬৬ সনে সফলভাবে প্রথমবারের মতো একটি কুকুরের দেহ থেকে আরেকটি কুকুরের দেহে রক্ত সঞ্চালনের পরীক্ষা চালান। অবশ্য এর পরে পশুর দেহ থেকে মানবদেহে রক্ত পরিসঞ্চালন করতে গিয়ে চিকিৎসকদের হাতে প্রাণ হারান অনেক মানুষ। ফলে ১৬৭৮ সনে রক্ত পরিসঞ্চালনের ব্যাপারে পোপ নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেন। ডা. জেমস ব্লান্ডেল নামে একজন ইংরেজ ধাত্রীবিদ্যাবিশারদ ১৮১৮ সালে রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্যে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যা দিয়ে সফলভাবে একজন সুস্থ মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের দেহে রক্ত পরিসঞ্চালন করে তাকে বাঁচিয়ে তোলা হয়। তিনিই প্রথম মানুষের শরীরে কেবল আরেকজন মানুষের রক্তই দেয়া যাবে বলে নিশ্চিত করেন। ১৯০১ সনে ভিয়েনার ডা. কার্ল ল্যান্ডস্টেনার মানুষের রক্তের প্রধানত ৪টি গ্রুপ এ, ও, বি, এবং এবি. সনাক্ত করেন। ১৯১৪-১৯১৮ সনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এ সময়টায় যুদ্ধাহত হাজার হাজার মানুষকে বাঁচাতে অনেক রক্তের প্রয়োজন হয়েছিল। তখনই মানুষ রক্তদাতার শরীর থেকে বের করে সোডিয়াম সাইট্রেট মিশিয়ে জমাট বাঁধা থেকে রক্ষা করা এবং ফ্রিজে সংরক্ষণ করা আবিষ্কার করে। প্রথমবারের মতো ১৯১৬ সনে সফলভাবে সংরক্ষিত রক্তকে আরেকজনের দেহে প্রবেশ করান হয়। এই ধারণা থেকেই একজন আমেরিকান মেডিকেল গবেষক অসওয়াল্ড হোপ রবার্টসন ফ্রান্সে বিশ্বের প্রথম ব্লাড ব্যাংকের সূচনা করেন। তারপর ১৯২১ সনে লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে বৃটিশ রেডক্রসের সদস্যরা সবাই একযোগে রক্ত দেয়ার মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম স্বেচ্ছা রক্তদানের দৃষ্টান্ত সূচিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের ন্যায় উপমহাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদান শুরু হয়। ইম্পিরিয়াল সেরোলজিস্টরা ১৯২৫ সনে কোনো ধরনের সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছাড়া একজন রক্তদাতার দেহ থেকে একটি সিরিঞ্জের মাধ্যমে রক্ত করে রক্তগ্রহীতার দেহে পরিসঞ্চালনের ব্যবস্থা নিয়ে কলকাতার ট্রপিকেল মেডিসিন স্কুলে একটি রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র শুরু করে। ১৯৩৯ সনে ভারতের রেডক্রস সোসাইটি একটি ব্লাড ব্যাংক কমিটি গঠন করে। এই কমিটি যন্ত্রপাতি দিয়ে রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রটিকে সহায়তা করে এবং রক্তদাতাদের সংগঠিত করতে চেষ্টা করে। ফলে ফ্লাস্কে করে রক্ত সংগ্রহ করে তা কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত ফ্রিজে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়। মূলত চল্লিশের দশকে মেট্রোপলিটন শহরে এবং পঞ্চাশের দশকে জেলা শহরগুলোতে ব্লাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। সব ব্লাড ব্যাংকগুলোই পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে বলে অনেক বেসরকারি ব্লাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকে উৎসাহিত করা হয়। ১৯৮৫ সালে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে কলকাতায় প্রথমবারের মতো তিন দিনব্যাপী ন্যাশনাল সেমিনার এন্ড ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়। এই সেমিনারে রক্ত পরিসঞ্চালন বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে তখন থেকে ‘গিফট অফ ব্লাড’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। জনস্বার্থে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৮ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে সকল প্রকার রক্তের কেনাবেচা বন্ধের ঘোষণা দেয় এবং স্বেচ্ছা রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে স্টেট ব্লাড ট্রান্সফিউশন কাউন্সিল গঠনের জন্যে সরকারকে নির্দেশ প্রদান করে।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালের ১০ জুন জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ডা. নুরুল ইসলাম নিজ রক্তদানের মাধ্যমে বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদানের সূচনা করেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের কিছু ছাত্রের উদ্যোগে সন্ধানী নামে প্রথম রক্তদান সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া ১৯৮১ সনে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, ১৯৮২ সালে অরকা, ১৯৯৬ সনে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, ১৯৯৭ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে স্বেচ্ছায় রক্তদান সংগঠন ‘বাঁধন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ পথ ধরেই ৫ মে ২০০৫ সালে ব্লাড-ফ্রেন্ড সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রম নতুন মাত্রা যোগ করে। দেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে চার লক্ষ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনীয় রক্তের সরবরাহের অভাবে পেশাদার রক্ত বিক্রেতার দূষিত রক্ত পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে সিফিলিস, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি বা এইডসের মতো সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই দূষিত রক্তের পরিসঞ্চালন থেকে মুমূর্ষু মানুষকে রক্ষার জন্য নিরাপদ ও সুস্থরক্তের প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধ সচেতন নাগরিকদের সমন্বয়ে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠেছে।
রক্তের অপর নাম জীবনপ্রবাহ। ফলে রক্তদান এ অর্থে জীবনদান। তাই রক্তদান আত্মার বাঁধন তৈরি করে। রক্তদান নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। রক্তদান ও পরিসঞ্চালনের প্রতি ধর্মীয় ও সামাজিক উভয় প্রকার স্বীকৃতি রয়েছে। নিয়মিত রক্তদানে দাতার শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসহ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়। অন্যদিকে প্রতিদিন বিভিন্ন কারণে প্রয়োজনীয় হাজার হাজার ব্যাগ রক্তের চাহিদা পূরণ করে গ্রহীতাদের জীবনও রক্ষা করা সম্ভব হয়। নিয়মিত রক্তদানের মাধ্যমে মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে রক্তদানের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের আগ্রহ ও সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে রক্তদান কর্মসূচিতে মানুষ রক্ত দিতে ভিড় করে। বিশেষ করে এতে ছাত্রছাত্রী ও তরুণ সমাজের অংশগ্রহণ সন্তোষজনক। বেশিরভাগ রক্তদাতাই সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন। অনেক রক্তদাতা কেবল পরিচিতজনদের প্রয়োজনে রক্তদান করে। অনেকে সমাজ সেবামূলক কাজ হিসেবে রক্তদান করেন। কেউ কেউ তার ভবিষ্যত প্রয়োজনে রক্ত পেতে বিভিন্ন রক্তদাতা সংগঠনের সদস্যপদ গ্রহণ করে নিয়মানুযায়ী রক্তদান করেন। তবে জনগণকে আরও সচেতন করতে পারলে স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রম নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা খুব একটা কঠিন কাজ নয়।