করোনায় পর্যটক শূন্য গোয়াইনঘাটের পর্যটন এলাকা, নেই প্রাণচাঞ্চল্য

11
করোনার কারণে ফাঁকা সিলেটের প্রকৃতি কন্যাখ্যাত জাফলংয়ের জিরো পয়েন্ট।

কে.এম লিমন গোয়াইনঘাট থেকে :
এক পাশে বিস্তীর্ণ বালুময় প্রান্তর, আরেক পাশে বিশাল পাহাড়ের সারি। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, সবুজ আঁচল ছড়িয়ে আছে পাহাড়গুলো! সেই পাহাড়ের ওপর শরতের নীল আকাশ। পাহাড় আর বালুময় প্রান্তরের মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছে টলটলে জলের ধারা। এই ধারায় পা ভিজিয়ে একটু এগিয়ে গেলেই কানে আসে জলের পতনের শব্দ। অন্তত ৩০০ ফুটের মতো উঁচু পাথুরে পাহাড় থেকে সবুজ গাছের ফাঁক দিয়ে এই ধারা গড়িয়ে নামছে বাঁধনহারার মতো। সব মিলিয়ে প্রকৃতির মায়াবী এক রূপ এ জন্যই হয়তো নাম হয়েছে মায়াবী ঝরনা! আর এই মায়াবী রূপের মায়ায় প্রতি বছর এই সময়ে পর্যটকদের পদচারনায় মাতোয়ারা থাকে পিয়াইনের মায়াবী ঝরনা। কিন্তু দুই সিজন থেকে দেশে করোনা মহামারীর কারনে এখন পর্যটক শূন্য জাফলং এর অন্যতম আকর্ষণ পিয়াইন’র এই মায়াবী ঝর্ণাসহ নয়নাভিরাম গোয়াইনঘাটের পর্যটন কেন্দ্র জাফলং জিরো পয়েন্ট, বিছনাকান্দি, সোয়াম ফরেষ্ট রাতারগুল ও পান্তুমাই ঝর্ণা।
গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং অনেক দিন ধরেই পর্যটকের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। এই সময়ে প্রতিদিন হাজার হাজার প্রকৃতিপ্রেমী ছুটে আসতেন সীমান্তের ওপারের পাহাড় থেকে নেমে আসা পিয়াইন নদীতে অবগাহন করে শরীর-মন জুড়াতে। সেইসঙ্গে স্বচ্ছ জলের মাঝে পাথরের রূপের সঙ্গে সীমান্তের ওপারে ঝুলন্ত সেতু দেখার সুযোগ তো আছেই। সাম্প্রতিক সময়ে পিয়াইনের সেই রূপে ভাগ বসিয়েছে কয়েকশ’ গজ দূরের মায়াবী ঝর্ণা। জাফলংয়ের প্রধান আকর্ষণ এখন যেন স্থানান্তরিত হয়েছে এই ঝর্ণা।
সেই সাথে উঁচু উঁচু পাহাড় যেন বাংলাদেশ-ভারতের সীমানাকে মজবুত এক ভিত্তির ওপর দাঁড় করে রেখেছে। পাহাড়ের পাদদেশ পুরোটা বাংলাদেশের জাফলং। পাহাড় থেকে ঝরনাধারার পানি জাফলংয়ের পিয়াইন নদে মিশেছে। পাহাড়-পাথর-জলের মেলবন্ধন ও পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দে অন্য রকম এক প্রাকৃতিক রূপের জাফলংকে ঘিরে সিলেটের পর্যটন ব্র্যান্ডিং। নাম ‘প্রকৃতিকন্যা’।
বর্ষকালীন প্রকৃতিকন্যার রূপ দেখতে বড় কোনো ছুটিতে দেখা যেত হাজার হাজার পর্যটক। ঈদের ছুটিতে এক জাফলংয়েই পর্যটকদের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যেত। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় পর্যটনকেন্দ্রে যাতায়াত নিষিদ্ধ। এ কারণে এবারের ঈদ পরবর্তী সময় থেকে বাইরের কোনো পর্যটক নেই। জাফলংয়ের শূন্যরেখার (জিরো পয়েন্ট) কাছের এলাকা আর সিলেট শহরের কিছু তরুণ তরুণী’র ভিড় দেখা গেল।
যেখানে শুক্রবার হলেই হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় মুখর থাকতো জাফলং জিরো পয়েন্ট ও পিয়াইনের মায়াবী ঝর্ণা সেখানেই এই শুক্রবার দুপুরে সরজমিন গিয়ে দেখাযায় এই দুটি এলাকা ছিল এক রকম ফাঁকা।
জাফলংয়ের শূন্যরেখার কাছে সাম্প্রতিক পাহাড়ি ঢলে জমেছে সাদা পাথর আর নুড়িপাথর। সেই স্থানটুকু বাদে চারদিক জলমগ্ন। একপাশে জল, আরেক পাশে পানি আর সীমান্তজুড়ে মেঘ-পাহাড়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে শুধু স্থানীয় লোকজনকে।
যে কোন ছুটিতে জাফলং, মায়াবী ঝর্ণা, বিছনাকান্দি, রাতারগুল ও পান্তুমাই ঝর্ণাসহ গোয়াইনঘাটের দর্শনীয় স্থান গুলোতে হাজার হাজার পর্যটকের ভিড় থাকত। এ কারণে সিলেট শহরসহ জাফলংয়ের বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, রেস্টহাউস ও রেস্তোরাঁগুলো ব্যস্ত সময় পার করত।
কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে গেল বছর থেকে সবকিছু একদম ফাঁকা। বাইরের পর্যটকদের যাতায়াত না থাকায় পর্যটনকেন্দ্রের আশপাশের এলাকার স্থানীয় লোকজনকে বেড়াতে দেখা গেছে। তবে হোটেল মোটেলসহ খাবারের রেস্তোরাঁ, দোকানপাট সবই বন্ধ আছে। এতে করে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, পর্যটন সংশ্লিষ্ট নৌকার মাঝি, পরিবহন সেক্টর, ট্যুরিস্ট গাইড, ফটোগ্রাফার ও ব্যবসায়ীরা। এ সংকটে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পথে বসার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
জাফলং ফটোগ্রাফার ও স্টুডিও মালিক সমিতির সভাপতি মুহিবুর রহমান মুহিব বলেন করোনার কারনে অনেক দিন বন্ধ থাকায় সম্ভাবনাময় এই শিল্পে এখন দুঃসময় ভর করছে। কর্ম না থাকায় জাফলং এ পর্যটকদের সেবায় নিয়োজিত প্রায় ৫ শতাদিক ফটোগ্রাফার বেকার হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে হলেও সিলেটের সব পর্যটনকেন্দ্র খুলে দেওয়ার দাবি তাঁর।
জাফলং ভিউ রেষ্টুরেন্ট’র পরিচালক ওমর সানি বলেন, সিলেটের পর্যটন খাতকে ঘিরে হোটেল, রেস্ট হাউজ, পরিবহন, রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন ব্যবসা জড়িত। এসব ব্যবসা করোনাভাইরাসের কারণে এখন গভীর সংকটের মধ্যে পড়েছে।
“পর্যটন বলতে শুধু পর্যটনকেন্দ্রই নয়, এর সঙ্গে অনেক মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক খাত জড়িত রয়েছে। পর্যটন সংশ্লিষ্ট সব খাত এখন চরম সংকটের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। এ সংকটে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পথে বসার উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাশাপাশি তিনি আরও বলেন এ অবস্থা চলতে থাকলে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নেবে। কেবল হোটেল নয়, পর্যটক নির্ভর করে সিলেটে অনেক রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রের নৌকার মাঝি, পরিবহন সেক্টর, ট্যুরিস্ট গাইড, ফটোগ্রাফার সবাই ক্ষতির মুখে।
জাফলং পর্যটন কেন্দ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ আলমগীর হোসেন বলেন করোনা মহামারীর কারণে দির্ঘদিন থেকে পর্যটন সংশ্লিষ্টদের কোন ব্যবসা নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নেবে। কেবল হোটেল নয়, পর্যটক নির্ভর করে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসা ও রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রের নৌকার মাঝি, পরিবহন সেক্টর, ট্যুরিস্ট গাইড, ফটোগ্রাফার সবাই ক্ষতির মুখে। পর্যটক না থাকায় তারা এখন গভীর সংকটে।
জাফলং গ্রীন পার্কের চেয়ারম্যান বাবলু বখত বলেন পর্যটন নগরী হিসেবে পরিচিত সিলেটে গত এক দশকে পর্যটক সমাগম বেড়েছে। তাই ছুটির দিনগুলোয় কোনো হোটেল-মোটেলে কক্ষ খালি পাওয়া কঠিন ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে একেবারে বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে এ খাত। সরকার ঘোষিত ‘সাধারণ ছুটি’ শেষে ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যান্য খাত সচল হতে শুরু করলেও পর্যটক নির্ভর সিলেটের হোটেল-মোটেলগুলোয় এখনও স্থবিরতা কাটেনি। স্বাভাবিক সময়ে পর্যটকে ভরপুর থাকে এসব হোটেল ও রেস্ট হাউজ। বর্তমান পরিস্থিতিতে পর্যটক না থাকায় সব হোটেল, মোটেল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে করে যেমন ব্যবসায়ীরা হচ্ছেন ক্ষতির সম্মুখীন ঠিক তেমনই ছাঁটাই হওয়া কর্মীরাও পড়েছেন সমস্যায়।
ট্যুরিস্ট পুলিশ জাফলং সাব জোনের ইনচার্জ মোঃ রতন শেখ বলেন করোনা মহামারীর নির্দেশনা উপেক্ষা করে যে সকল পর্যটকরা জাফলং ভ্রমণে আসে, করোনা মহামারী ঠেকাতে জাফলংয়ের প্রবেশদ্বারে বাংলাদেশ পুলিশের একাদিক চেকপোস্ট বসিয়ে তাদের ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করে ফিরিয়ে দিচ্ছে পুলিশ।
গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তাহমিলুর রহমান জানিয়েছেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জনসমাগম এড়াতে জেলা প্রশাসনের নির্দেশনায় পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ওই নির্দেশনার কারণে ঈদুল ফিতরে পুরোপুরি পর্যটকশূন্য ছিল জাফলং। এবারের ঈদে পরিস্থিতির কিছু পরিবর্তন হওয়ায় আমরা পর্যটনকেন্দ্রে যাতায়াত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ না করে নিরুৎসাহিত করছি। তবে বাইরের মানুষজন এখনো শূন্য। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ না কমা পর্যন্ত এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।