কাজিরবাজার ডেস্ক :
মহামারী করোনাভাইরাসের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় সামাজিক সুরক্ষা খাতে দেশের আড়াই কোটি সাধারণ মানুষকে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই কর্মসূচীর আওতায় নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা, চিকিৎসা, আবাসন, দারিদ্র্য হ্রাস এবং কর্মসংস্থানের মতো চাহিদা পূরণ করা হবে। এ লক্ষ্যে আসন্ন বাজেটে এ খাতে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্য প্রবণ ১৫০ উপজেলায় বিশেষ নজর দেয়া হবে। সামাজিক সুরক্ষায় নির্ধারিত ১২৩ কর্মসূচী বাস্তবায়ন হবে ৩০ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত এবং দুর্নীতি হ্রাসে বেশিরভাগ উপকারভোগীরা টাকা পাবেন মোবাইল ব্যাংকে। আগামী ৩ জুন বৃহস্পতিবার মহান সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন। ৬ লাখ ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকার জীবন-জীবিকার বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানোর নানা পরিকল্পনার কথা জানাবেন অর্থমন্ত্রী।
জানা গেছে, করোনার কারণে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। বিশেষ করে কয়েক দফা লকডাউন এবং করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ কাজ হারিয়ে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষের আয় উপার্জন কমে যাওয়ার কারণে সামষ্টিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হয়েছে। কিন্ডারগার্টেন, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এ খাতে অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় সামাজিক সুরক্ষায় বেশি সংখ্যক মানুষকে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হয়েছে। সামাজিক খাতে বাড়ানো হবে বাজেট বরাদ্দ। এই কর্মসূচীর আওতায় উপকারভোগীরা খাদ্য সহায়তা, নগদ ভাতা, চিকিৎসা সহায়তা, শিক্ষা সরঞ্জামাদি, থাকার জন্য পাকা ঘর, গভীর নলকূপ স্থাপন, স্যানিটেশন এবং গ্রামীণ প্রকল্প থেকে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন। এছাড়া গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ এবং দারিদ্র্র্য নির্মূলে আরও কয়েক কোটি মানুষকে অস্থায়ীভাবে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।
আগামী বাজেটে শুধু সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১ লাখ ৫ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে। চলতি বাজেটে এই খাতের বরাদ্দ ৯৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশের উত্তরণ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করতে হলে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক কর্মকা- আরও বেগবান করার তাগিদ রয়েছে। কাউকেই আর পিছিয়ে রাখার সুযোগ নেই। অর্থনীতির মূল ধারায় সাধারণ মানুষকেও নিয়ে আসার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের সামনে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম বেগবান করতে উন্নত দেশের রোল মডেল অনুসরণ করবে বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বেশি সংখ্যক মানুষকে নিয়ে আসা হবে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি ভাল অবস্থায় রয়েছে। এ কারণে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্বল্পোন্নত (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে বাংলাদেশ। মধ্যম আয়ের যেতে গত এক দশক ধরে দারিদ্র্য বিমোচনে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে। কমেছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। আগামী বাজেটেও ধারাবাহিকভাবে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় কর্মসূচী ও বরাদ্দ বাড়ানো হবে। গ্রামীণ কর্মসংস্থানে নজর বাড়াবে সরকার।
জানা গেছে, কোভিড-১৯ সঙ্কট মাথায় রেখে চলতি অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়। যা মোট বাজেটের ১৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ০১ শতাংশ। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাতে ৭৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৮১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা করা হয়। দারিদ্র্য বিমোচন ও গ্রামীণ কর্মসংস্থানের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা করার বরাদ্দ দেয়া হবে। আসন্ন বাজেটেই প্রথম দেশের ১৫০ উপজেলার সব বয়স্ক মানুষ ও বিধবা নারীকে ভাতা দেয়া হবে। এছাড়া নতুন করে ভাতা পাবেন করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন শ্রমিকরা। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বাড়বে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতাও।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ জনকে এই সুবিধার আওতায় আনা হচ্ছে। এর বাইরে শিক্ষা কার্যক্রম বিস্তারে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে সরাসরি উপবৃত্তি দেয়া হবে ৮০ লাখ ছাত্রছাত্রীকে। এছাড়া করোনার ক্ষতি মোকাবেলায় নগদ সহায়তা পাবেন আরও ৫০ লাখ মানুষ। এ প্রসঙ্গে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মোঃ আশরাফ আলী খান সম্প্রতি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় চলতি বাজেটে ১১২ উপজেলার সব বয়স্ক ব্যক্তি এবং স্বামী পরিত্যক্ত ও বিধবা নারীদের ভাতা দেয়া হচ্ছে। আগামী বাজেটে এটি ১৫০ উপজেলার সব বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারী এবং বয়স্কদের ভাতার আওতায় আনা হচ্ছে। অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় বাড়ানো হবে।
১৫০ উপজেলায় বিশেষ নজর ॥ দারিদ্র্য প্রবণ ১৫০ উপজেলার দিকে বিশেষ নজর দেয়া হবে। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও এ ব্যপারে সম্প্রতি একটি বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে স্বচ্ছতা আনায়নে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া সমাজকল্যাণসহ ৩০ মন্ত্রণালয়েল মাধমে ১২৩ কর্মসূচী বাস্তবায়নের বিষয়টি সামনে আনা হয়। অন্য মন্ত্রণালয়গুলো যাতে ঠিকমতো কর্মসূচী পালন করে সেজন্য একটি গাইডলাইন করা হতে পারে। কোভিড-১৯-এর কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বেশি আঘাত এসেছে। এজন্য নতুন বাজেটে ১৫০ উপজেলায় সব বয়স্ক ব্যক্তিকে ভাতার আওতায় আনা হবে। বর্তমানে ১১২ উপজেলার প্রত্যেক বয়স্ক ব্যক্তিই ভাতা পাচ্ছেন। ওই হিসাবে আসন্ন বাজেটে বয়স্ক ভাতা পাবেন ৫৭ লাখ জন। বর্তমানে দেয়া হচ্ছে ৮৯ লাখ জনকে। ১৫০ উপজেলার সব বয়স্কজনকে অন্তর্ভুক্ত করায় আরও ৮ লাখ সুবিধাভোগী যুক্ত হচ্ছেন নতুন করে। এই কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ থাকছে ৩ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। চলতি বছর এ খাতে বরাদ্দ আছে ২ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।
পাশাপাশি ১৫০ উপজেলায় প্রত্যেক বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তাকে ভাতার আওতায় আনা হচ্ছে। এতে সুবিধাভোগী ২০ লাখ ৫০ হাজার থেকে বেড়ে ২৪ লাখ ৭৫ হাজারে দাঁড়াবে। এজন্য বরাদ্দ থাকছে ১ হাজার ২৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। চলতি বাজেটে এই কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ আছে ১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। আগামী বছর আরও যারা কর্মসূচীর আওতায় আসছেন, এর মধ্যে রয়েছে ১৮ লাখ অসচ্ছল প্রতিবন্ধী। এছাড়া ৭ লাখ ৭০ হাজার দরিদ্র মায়ের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা, পৌনে তিন লাখ ল্যাকটেটিং মা। আরও ভাতা পাবেন মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার পরিবার। এ বছর নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। ওই তালিকা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সংখ্যা কমে আসবে। চলতি বছর ২ লাখ মুক্তিযোদ্ধা পাচ্ছেন এ ভাতা। নতুন বছরে সেটি আরও কমে আসবে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতার পরিমাণ ১২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে। এই ভাতা বাড়ানোর বিষয়টি ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন। সে আলোকে অর্থ ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ছে ॥ নতুন বাজেটে হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মানোন্নয়নে সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হবে। বর্তমানে ৮৬ হাজার জনকে এ ভাতা দেয়া হচ্ছে। আসন্ন বাজেটে এ ভাতা দেয়া হবে ৯৫ হাজার জনকে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় আসছেন সড়ক ও নৌপরিবহন শ্রমিকরা। সম্প্রতি করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে গণপরিবহন ও নৌপরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে এসব যানবাহনে কর্মরত ড্রাইভার, হেল্পার ও সুপারভাইজারদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া একই জেলার ভেতরে চলাচলের সুযোগ দেয়া হলেও এ ধরনের যানবাহনে যাত্রীর সংখ্যা খুবই কম। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সড়ক ও নৌ খাতের পরিবহন শ্রমিকদের নগদ সহায়তা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ খাতের শ্রমিকদের ২ হাজার ৫০০ টাকা করে নগদ সহায়তা দেয়া হবে। এজন্য আগামী বাজেটে একটি বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার হিসেবে ৩৫ লাখ কর্মহীন দরিদ্রকে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে নগদ সহায়তা দেয়া হয়েছে। ৩৫ লাখের মধ্যে পরিবহন শ্রমিকও রয়েছেন। তাদের বাদ দিয়ে বাকি পরিবহন শ্রমিকদের তালিকা জেলা প্রশাসকদের কাছে চাওয়া হয়েছে। তালিকা পাওয়ার পর মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের মাধ্যমে এ সহায়তা দেয়া হবে। এছাড়া দরিদ্র মায়ের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা, সরকারী চাকরিজীবীদের অবসরকালীন পেনশনও দেয়া হবে এই কর্মসূচীর আওতায়।
জানা গেছে, এলডিসি উত্তরণ, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্নপূরণে দেশ থেকে চরম বা অতিদারিদ্র্য দূর করতে হবে। এ কারণে প্রতিবছর বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। আগামী পাঁচ বছরে এই বরাদ্দের পরিমাণ দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের পদক্ষেপে সন্তুষ্ট দাতাদেশগুলো। দ্রুত দারিদ্র্য বিমোচন ও আয় বৈষম্য কমিয়ে আনতে ইতোমধ্যে বাজেটে কিছু কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দশ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ দ্রুত শেষ করতে নেয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। সরকারের নেয়া এসব কর্মসূচী দেখে সন্তুষ্ট দাতাসংস্থাগুলো। এ প্রসঙ্গে বিআইডিএস-এর সাবেক ডিজি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরী বলেন, সামাজিক নিরাপত্তার কর্মসূচীর মাধ্যমে অনেকে উপকৃত হচ্ছেন। কিন্তু এখাতে বরাদ্দকৃত অর্থের কিছু অপব্যবহারও হচ্ছে। সমাজের পিছিয়ে পড়া যাদের পাওয়া দরকার তাদের অনেকে এই সুবিধা পাচ্ছেন না। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীতে স্বচ্ছতা ও উপকারভোগী নির্বাচন ঠিক করে বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশ থেকে দারিদ্র্য নির্মূল করা সম্ভব হবে।