॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
ঈমানের অন্যতম রুকন হচ্ছে তাক্বদীরে বিশ্বাস। জগত সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ তা’আলা তাঁর সৃষ্টিকুলের ভাগ্য নির্ধারণ করে স্বীয় দফতর লাওহে মাহফূযে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। এ বিশ্বাসই তাক্বদীরে বিশ্বাস। এর বিপরীত বিশ্বাস বা ধারণা করা হ’ল ঈমান বিরোধী।
তাক্বদীরের পরিচয় : ‘তাক্বদীর’ শব্দের অর্থ নির্ধারণ করা বা নির্দিষ্ট করা। শারঈ পরিভাষায় তাক্বদীর হল আল্লাহ কর্তৃক বান্দার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল বিষয় নির্ধারণ করা।
আল্লামা সা‘দ বলেন, ‘সৃষ্টির যাবতীয় বিষয় তথা ভালো-মন্দ, উপকার-অপকার, ইত্যাদি স্থান-কাল এবং এ সবের শুভ ও অশুভ, ইষ্ট-অনিষ্ট, পরিণাম পূর্ব এবং ছওয়াব ও আযাব হতে নির্ধারিত হওয়া’। মূলত: তাক্বদীর বলতে জগতের যাবতীয় বস্তু তথা মানুষ ও জিনসহ যত সৃষ্টি রয়েছে সবকিছুর উৎপত্তি ও বিনাশ, ভালো ও মন্দ, উপকার ও অপকার ইত্যাদি কখন কোথায় ঘটবে এবং এর পরিণাম কি হবে প্রভৃতি মাখলূক সৃষ্টির পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলা নির্ধারণ করে রেখেছেন। জগতে যা কিছু ঘটছে এবং ঘটবে সবই তাক্বদীরে লিপিবদ্ধ আছে। এর বাইরে কিছুই নেই। ছাহাবীগণ এভাবেই তাক্বদীর-এর পরিচয় তুলে ধরেছেন। ত্বাউস বলেন,‘আমি বহু ছাহাবীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম, তাঁরা বলতেন, প্রত্যেক জিনিসই তাক্বদীর অনুসারে সংঘটিত হয়’। রাসূল (সাঃ) বলেছেন,প্রত্যেক জিনিসই তাক্বদীর অনুসারে সংঘটিত হয়ে থাকে। এমনকি অক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তা’।
তাক্বদীর লেখার সময় : আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক মানুষের তাক্বদীর লিপিবদ্ধ করেছেন আসমান-যমীন সৃষ্টির ৫০ হাযার বছর পূর্বে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টি জগতের ভাগ্য লিখে রেখেছেন আকাশ সমূহ ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বে’। তাক্বদীর-এর বিষয় অজ্ঞাত : তাক্বদীর একটি গায়েবী বিষয়, যা মহান আল্লাহ ব্যতীত কেউ অবগত নয়। আল্লাহ তা’আলা তাক্বদীরের বিষয় সৃষ্টিকুল থেকে গোপন রেখেছেন। এজন্য রাসূল (সাঃ) এ প্রসঙ্গে অহেতুক বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে নিষেধ করেছেন।একদিন ছাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সাঃ)-এর কাছে কেবল তাক্বদীরের উপর ভরসা করে সকল আমল ছেড়ে দেওয়ার আবেদন জানালে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘তোমরা নেক আমল করে যাও। কেননা যাকে যেজন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তার পক্ষে সে কাজ সহজসাধ্য হবে। যারা সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত তাদের জন্য সেরূপ আমল এবং যারা দুর্ভাগাদের অন্তর্ভুক্ত তাদের জন্য সেরূপ আমল সহজ করে দেওয়া হয়েছে’।
তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনার গুরুত্ব : তাক্বদীর ঈমানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুকন। হাদীছে জিবরীলে এ ব্যাপারে উল্লেখ আছে যে, জিবরীল (আঃ) যখন রাসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ঈমান কি? তখন রাসূল (সাঃ) বললেন,أَ ‘ঈমান হচ্ছে আল্লাহর উপরে তাঁর ফেরেশতার উপরে, তাঁর রাসূলগণের উপরে, তাঁর কিতাব সমূহের উপরে, বিচার দিবসের উপরে এবং তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপরে বিশ্বাস রাখা’। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘কোন বান্দাই মুমিন হ’তে পারবে না যতক্ষণ না এই চারটি কথায় বিশ্বাস করবে, ১. এ সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল। তিনি আমাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন। ২. মৃত্যুতে বিশ্বাস করবে। ৩. মৃত্যুর পর পুনরুত্থানে বিশ্বাস করবে। ৪. তাক্বদীরে বিশ্বাস করবে’।
তাকদীর অস্বীকার করার বিধান : তাক্বদীর অস্বীকার করা কবীরা গুনাহ এবং অস্বীকারকারী মুমিন থাকে না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘কাদারিয়ারা এ উম্মতের অগ্নিপূজক। তারা অসুস্থ হলে দেখতে যাবে না এবং তারা মারা গেলে জানাযায় হাযির হবে না’।
তাক্বদীর বা ভাগ্যে বিশ্বাসের রুকন : তাক্বদীর বা ভাগ্যে বিশ্বাসের মূল চারটি বিষয় রয়েছে। এ চারটি বিষয়ে বিশ্বাসের সমন্বিত নাম পূর্ণ তাক্বদীর বিশ্বাস। যথা- ১. আল্লাহর জ্ঞান সম্বন্ধে বিশ্বাস, ২. আল্লাহর লিখন বা লাওহে মাহফূযে বিশ্বাস, ৩. আল্লাহর ইচ্ছা সম্পর্কে বিশ্বাস ও ৪. আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে বিশ্বাস।১. আল্লাহর জ্ঞান সম্বন্ধে বিশ্বাস : আল্লাহ সকল বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন, তাঁর জ্ঞানের বাইরে কিছুই নেই। তিনি আদি-অনন্ত ও অন্তর্যামী। আর সকল বিষয় ঘিরে আছে তাঁরই জ্ঞান। আল্লাহ বলেন‘তুমি কি জানো না যে, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহ জানেন’ (হজ্ব ২২/৭০)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আর গায়েবের চাবিকাঠি তাঁর কাছেই রয়েছে। তিনি ব্যতীত কেউই তা জানে না। স্থলভাগে ও সমুদ্রভাগে যা কিছু আছে, সবই তিনি জানেন। গাছের একটি পাতা ঝরলেও তা তিনি জানেন। মাটিতে লুক্কায়িত এমন কোন শস্যদানা নেই বা সেখানে পতিত এমন কোন সরস বা শুষ্ক ফল নেই, যা (আল্লাহর) সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই’ (আন‘আম ৬/৫৯)। তিনি আরো বলেন,‘তিনি অদৃশ্য বিষয়ে জ্ঞাত। নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে অনু পরিমাণ বস্ত্তও তাঁর অগোচরে নয়। আর তার চাইতে ছোট ও বড় সবকিছু সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে’ (সাবা ৩৪/৩)। হাদীছে এসেছে, ‘রাসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয় মুশরিকদের ছোট বাচ্চা সম্বন্ধে (তারা জান্নাতে যাবে না জাহান্নামে যাবে)। তিনি বললেন, আল্লাহ ভালো জানেন, সে (বড় হয়ে) কি আমল করত’। কুরআন-হাদীছের বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আকাশ ও পৃথিবীর সমস্ত বিষয়ের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ রাখেন। এসবের অণুপরিমাণ তাঁর জ্ঞানের বাইরে নেই। এমনকি মানুষ অন্তরে যে কল্পনা করে আল্লাহ তাও জানেন। সুতরাং এ বিশ্বাস থাকতে হবে যে আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে বা তাঁর অজানা কিছুই নেই।
সব কিছুই লাওহে মাহফূযে লিপিবদ্ধ রয়েছে : সৃষ্টির পূর্বে ও পরে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে সে বিষয় আল্লাহ স্বীয় জ্ঞানে একটি কিতাব লিখে রেখেছেন, যা কুরআনের ভাষায় লাওহে মাহফূয। ভাগ্যনামা লিখন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, আর প্রত্যেক বস্ত্ত আমরা স্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ রাখি’ (ইয়াসীন ৩৬/১২)। তিনি আরো বলেন,তুমি বল, আল্লাহ আমাদের ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন, তা ব্যতীত কিছুই আমাদের নিকট পৌঁছবে না। তিনিই আমাদের অভিভাবক’ (তওবা ৯/৫১)। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পিছনে ছিলাম। তিনি বললেন, হে বালক! আমি তোমাকে কিছু কথা শিক্ষা দিব। তুমি আল্লাহর অধিকার সংরক্ষণ কর, তবে তিনি তোমাকে হেফাযত করবেন। তুমি আল্লাহকে লক্ষ্য রাখবে, তাহ’লে তাঁকে তোমার সামনে পাবে। আর যখন তুমি কোন সাহায্য চাইবে, তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। আর তুমি একথা জেনে রাখো যে, সমস্ত মানুষ যদি একত্রিত হয় তোমার কোন উপকার করার জন্য, তবে তারা তোমার কোন উপকার করতে পারবে না অতটুকু ব্যতীত যা আল্লাহ তোমার ভাগ্যলিপিতে লিখে রেখেছেন। আর যদি তারা সকলে একত্রিত হয় তোমার কোন ক্ষতি করার জন্য, তাহ’লে তারা তোমার কোন ক্ষতিও করতে পারবে না অতটুকু ব্যতীত যা আল্লাহ তোমার ভাগ্যলিপিতে লিখে রেখেছেন। ভাগ্যনামা লিখার কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর ঐ খাতাগুলো শুকিয়ে গিয়েছে’।
আল্লাহর ইচ্ছা কার্যকর : অর্থাৎ এ কথা বিশ্বাস করা যে, আল্লাহর ইচ্ছায় সবকিছু কার্যকর হয়ে থাকে। আকাশ ও যমীনে আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত কিছুই হয় না। তিনি যা করেন তাকে জিজ্ঞেস করার কেউ নেই। কিন্তু অপর সকলেই জিজ্ঞাসিত হয়। তিনি যা করতে ইচ্ছা করেন তখন সে বস্তুকে আদেশ দান মাত্র তা হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন,‘যখন তিনি কিছু করতে ইচ্ছা করেন তখন তাকে কেবল বলে দেন, হও। অতঃপর তা হয়ে যায়’ (ইয়াসীন ৩৬/৮২)। অন্যত্র তিনি বলেন,‘আর তোমরা ইচ্ছা করতে পারো না কেবল অতটুকু ব্যতীত যা আল্লাহ ইচ্ছা করেন। যিনি বিশ্বচরাচরের পালনকর্তা’ (তাকভীর ৮১/২৯)। তিনি আরো বলেন,- ‘আর তুমি কোন বিষয়ে বলো না যে, ওটা আমি আগামীকাল করব। (বরং তুমি বলো) ‘যদি আল্লাহ চান’ (কাহফ ১৮/২৩)। আল্লাহ আরো বলেন,- ‘অতঃপর আল্লাহ যাকে পথ প্রদর্শন করতে চান তার বক্ষকে ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। আর যাকে বিপথগামী করতে চান তার বক্ষকে অত্যধিক সংকীর্ণ করে দেন’ (আন‘আম ৬/১২৫)।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আদম সন্তানের অন্তঃকরণ সমূহ করুণাময়ের আঙ্গুল সমুহের মধ্যেকার দু’টি আঙ্গুলের মাঝে একটি অন্তরের মত। তিনি যেভাবে ইচ্ছা করেন তাকে পরিবর্তন করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, হে আল্লাহ, হৃদয় সমূহের পরিবর্তনকারী! আমাদের হৃদয়গুলোকে তোমার আনুগত্যে ফিরিয়ে দাও’।
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, কোন বিষয়ে কার্যকর হওয়ার জন্য সৃষ্টিকুলের ইচ্ছা যথেষ্ট নয়। তাদের ইচ্ছার সাথে আল্লাহর ইচ্ছার মিল অবশ্যই থাকতে হবে। তাহ’লেই তা কার্যকর হবে। কারণ কাজ করার জন্য সৃষ্টিকুলের যে শক্তির প্রয়োজন হয় তা কেবল সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ই দিয়ে থাকেন। এজন্য আল্লাহর ইচ্ছার প্রয়োজন। তাই সৃষ্টিকুলের ইচ্ছা আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। অনেক সময় মানুষ কিছু করার সংকল্প করে। কিন্তু পরে দেখা যায় তা কার্যকর হয়নি। অতএব কেউ যদি নিজের ইচ্ছাকে সবকিছু মনে করে আল্লাহর ইচ্ছাকে অস্বীকার করে তবে সে বেঈমানে পরিণত হবে।
আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে বিশ্বাস : আল্লাহ ব্যতীত কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। একমাত্র তিনিই জগতের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, প্রত্যেক বিচরণকারী এবং তার কাজও তিনি সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন,‘আর তিনি সমস্ত বস্ত্ত সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে যথাযথ পরিমিতি দান করেছেন’ (ফুরক্বান ২৫/২)। তিনি আরো বলেন‘যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টি করেছেন অন্ধকার ও আলো’ (আন‘আম ৬/১)। অন্যত্র তিনি বলেন,‘তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিন এবং সূর্য ও চন্দ্র। প্রত্যেকেই আকাশে আপন কক্ষপথে বিচরণ করে’ (আম্বিয়া ২১/৩৩)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন জীবন এবং মরণ যাতে তোমাদের পরীক্ষা করেন কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ’ (মুলক ৬৭/২)। তিনি বলেনআল্লাহ ব্যতীত কোন সৃষ্টিকর্তা আছে কি যিনি তোমাদেরকে আকাশ ও যমীন থেকে রিযিক দান করেন’? (ফাতির ৩৫/৩)। তিনি আরো বলেন ‘আল্লাহ তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা যেসব কাজ কর তাকেও’ (ছফফাত ৩৭/৯৬)।
অতএব আকাশ ও পৃথিবীর সকল কিছুই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ মানুষের কর্মশক্তি এবং তারা যা তৈরী করে তাতে আল্লাহর লিখন ও ইচছা মিলিত হ’লে তা তৈরী হয়। তাই কেউ যদি আল্লাহর কোন সৃষ্টিকে অবিশ্বাস করে তাহ’লে তাকদীরকে অবিশ্বাস করা হবে। ফলে সে ঈমান থেকে খারিজ হয়ে যাবে।
তাকদীরের প্রকারভেদ : তাকদীর সাধারণত দুই প্রকার হয়ে থাকে। অপরিবর্তনীয়।পরিবর্তনশীল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে’ (আলে ইমরান ৩/১৮৫)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন ‘প্রত্যেক বস্ত্তই ধ্বংস হবে তাঁর চেহারা ব্যতীত’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৮)।প্রথম আয়াতে বলা হয় প্রত্যেক প্রাণীকেই মরতে হবে। ২য় আয়াতে আল্লাহ ব্যতীত সকল জিনিসের ধ্বংস হওয়া অনিবার্য। এতে কোন পরিবর্তন নেই। এটা অপরিবর্তনীয় ভাগ্য। ২য় বিষয় যে কোন প্রাণী কখন মরবে তা আল্লাহর ইচ্ছায় কিছু আগে পরে হ’তে পারে। তাই ভাগ্যের কিছু অংশ পরিবর্তনশীল থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ যা ইচ্ছা মিটিয়ে দেন এবং বহাল রাখেন। আর তাঁর নিকটেই রয়েছে মূল কিতাব’ (রা‘দ ১৩/৩৯)।
এই আয়াতের তাফসীরে ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস বলেছেন, দু’টি কিতাব আছে। একটিতে কম-বেশী হয়ে থাকে। কারো দো‘আ কিংবা ভাল-মন্দ কাজের কারণে ভাগ্যলিপিতে যে পরিবর্তন হয় সেটা কোন সময়ে বিশেষ শর্তের সাথে সংযুক্ত থাকে। শর্ত পাওয়া গেলে পরিবর্তন হবে, আর শর্ত না পাওয়া গেলে পরিবর্তন হবে না। ভাগ্য পরিবর্তনের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর ফায়ছালাকে কোন বস্ত্ত পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে না দো‘আ ব্যতীত’। অর্থাৎ আল্লাহ স্বীয় ফায়ছালার পরিবর্তন করেন যখন বান্দা তাঁর নিকটে দো‘আ করে। ছহীহ হাদীছে রয়েছে যে রক্ত সম্পর্ক রক্ষাকারীর আয়ু বৃদ্ধি পায়। আনাস বিন মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে তার রোজী বৃদ্ধি হোক এবং তার আয়ু দীর্ঘায়িত হোক সে যেন তার আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে’। উক্ত আয়াত ও হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, দোয়া ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখলে রিযক্ব ও আয়ু বৃদ্ধি পায়।
তাক্বদীর নিয়ে বিতর্ক করা : তাক্বদীরের উপর ঈমান রাখা আবশ্যক। তাক্বদীর নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। কারণ এ বিতর্ক অনেক ক্ষেত্রে কুফরী ও নাস্তিকতার পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বের হয়ে আমাদের নিকট আসলেন আমরা তখন তাক্বদীর সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত ছিলাম। এ দেখে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের উপর এত রাগ করলেন যে, রাগে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চেহারা মোবারক লাল হয়ে গেল, যেন তাঁর গন্ডদেশে আনারের দানা নিংড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপর তিনি বললেন, তোমাদেরকে কি এ বিষয়ে হুকুম করা হয়েছে, না কি আমি এ নিয়ে তোমাদের নিকট প্রেরিত হয়েছি। তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা এ বিষয়ে বির্তকে লিপ্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সাথে তোমাদেরকে বলছি, তোমরা এ বিষয়ে কখনো যেন বিতর্কে লিপ্ত না হও’।
তাক্বদীরের স্তরসমূহ : কুরআন-হাদীছের আলোচনায় দেখা যায় ভাগ্যের পাচঁটি স্তর রয়েছে। ১. সাধারণ ভাগ্য ২. মানুষের ভাগ্য ৩. সারা জীবনের ভাগ্য ৪. বার্ষিক ভাগ্য ৫. দৈনন্দিন ভাগ্য।
সাধারণ ভাগ্য হচ্ছে সমস্ত সৃষ্টি জগতের ভাগ্য যা আকাশ এবং যমীন সৃষ্টির ৫০ হাযার বছর পূর্বে আল্লাহ লাওহে মাহফূযে লিখে রেখেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, সৃষ্টি জগতের ভাগ্য আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বে লিখিত হয়েছেন। এই সাধারণ ভাগ্যলিপির মাঝে সকল সৃষ্টিই অন্তর্ভুক্ত।দ্বিতীয় প্রকার ভাগ্য মানুষের ভাগ্য লিপি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আর (স্মরণ কর) যখন তোমার প্রতিপালক বনু আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের সন্তানদের বের করলেন এবং তাদেরকে তাদের উপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলল, হ্যাঁ। আমরা সাক্ষী থাকলাম। (এটা এজন্য) যাতে তোমরা ক্বিয়ামতের দিন বলতে না পার যে, আমরা এ বিষয়ে জানতাম না’ (আ‘রাফ ৭/১৭২)।ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে এ আয়াত সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করেন। তারপর তিনি ডান হাত আদমের পিঠে বুলান। অতঃপর তা থেকে কিছু সন্তান বের করেন। তারপর বলেন, এদেরকে আমি জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেছি এবং এরা জান্নাতীদের মত আমল করবে। এরপর তিনি আবার আদমের পিঠে হাত বুলান তা থেকে কিছু সন্তান বের করে বলেন, এদেরকে আমি জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। এরা জাহান্নামীদের মত কাজ করবে। তখন একজন লোক বলল, তবে আমল কিসের জন্য হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেন এমনকি তখন তাকে জান্নাতীদের কাজে ব্যবহার করবেন এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে জান্নাতীদের কাজ করা অবস্থায়। অতঃপর আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর যদি কোন বান্দাকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেন তাকে জাহান্নামীদের কাজে ব্যবহার করেন। জাহান্নামীদের কাজে তার মৃত্যু হবে। আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন’।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন ‘আমরা বহু জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য। যাদের হৃদয় আছে কিন্তু বুঝে না। চোখ আছে কিন্তু দেখে না। কান আছে কিন্তু শোনে না। ওরা হ’ল চতুষ্পদ জন্তুর মত, বরং তার চাইতে পথভ্রষ্ট। ওরা হ’ল উদাসীন’ (আ‘রাফ ৭/১৭৯)।
যারা তাদের জ্ঞান দ্বারা ভালো-মন্দের বিচার করে না বরং নিষিদ্ধ কাজ করে বেড়ায়। তারা চোখ দিয়ে দেখে, কান দিয়ে শুনে উপদেশ গ্রহণ করে না, অন্যায়-অপকর্মে লিপ্ত হয়ে থাকে। এসব মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট। এরাতো তারা যাদেরকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহ এসব লোকদের জাহান্নামে দিচ্ছেন তাদের কৃতকর্মের জন্য। তিনি ইচ্ছা করে জাহান্নামে দিচ্ছেন না।
ভাগ্যের তৃতীয় স্তর হল সারা জীবনের ভাগ্য : আল্লাহ যখন মায়ের গর্ভে মানুষের আকৃতি সৃষ্টি করে তার ভিতরে রূহ দান করে তাকে জীবিত করেন, তখন তার ভাগ্যলিপিতে কিছু বিষয় লিখে দেওয়া হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকে তার মায়ের পেটের মধ্যে চল্লিশ দিন বীর্য রূপে জমা থাকে। তারপর পরিবর্তিত হয়ে রক্তপিন্ডের আকার হয়। তারপর পরিবর্তিত হয়ে গোশতপিন্ড হয়। তারপর আল্লাহ তার কাছে ফেরেশতা পাঠিয়ে রূহ ফুঁকে দেন। আর তার প্রতি চারটি নির্দেশ করা হয়। লিখে দেওয়া হয় তার আয়ু এবং তার রোজী, তার আমল এবং সে দুর্ভাগা না সৌভাগ্যবান। অতঃপর তার মাঝে রূহ ফুঁকে দেওয়া হয়। তোমাদের অপর কেউ জাহান্নামের কাজ করবে, অবশেষে তার এবং জাহান্ননের মাঝে এক গজ বাকী থাকবে। তখন তার ভাগ্যলিপি অগ্রগামী হয়ে যাবে। ফলে সে জান্নাতীদের মত কাজ করবে আর সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’। তোমাদের একজন জান্নাতবাসীদের মত কাজ করতে থাকে পরিশেষে তার ও জান্নাতে মাঝে এক গজ বাকী থাকে। এ অবস্থায় তার ভাগ্যলিপি অগ্রগামী হয়ে যায়। ফলে সে জাহান্নামীদের মত কাজ করবে, আর সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’। হাদীছটিতে মানুষের সারা জীবনের কর্ম সম্পর্কে উল্লিখিত হয়েছে, যা তার মায়ের পেটে রূহ দেওয়ার সাথে লিখে দেয়া হয়েছে। (অসমাপ্ত)