আলোচিত রায়হান হত্যাকান্ডের সাড়ে ৭ মাস পর ॥ এসআই আকবরসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল

25

সিন্টু রঞ্জন চন্দ :
আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর সিলেট নগরীর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশী নির্যাতনে রায়হান আহমদ হত্যার দায়েরকৃত মামলার দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ৭ মাস পর এসএমপি’র ৫ পুলিশসহ ৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
গতকাল বুধবার ৫ মে সকাল ১১টার দিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক আওলাদ হোসেন, সিলেট পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর খালেদ-উজ-জামানসহ পিবিআইর তদন্তকারী দল সিলেট আদালতের এসএমপি’র কোর্ট ইন্সপেক্টর প্রদীপ কুমার দাসের কাছে এই চার্জশিটটি (অভিযোগপত্র) হস্তান্তর করেন।
চার্জশিটে অভিযুক্তরা হচ্ছেন, বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া, এসআই হাসান উদ্দিন, এএসআই আশেক-ই-এলাহী, কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস, হারুনুর রশিদ ও সাংবাদিক নামধারী আব্দুল্লাহ আল নোমান। এসব আসামীদের মধ্যে ৫ পুলিশ সদস্য কারাগারে থাকলেও নামধারী কোম্পানীগঞ্জের সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমান মামলার শুরু থেকেই পলাতক রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে দাখিলকৃত চার্জশিটে ভিডিও ফুটেজ গায়েব ও অভিযুক্ত আকবরকে পালিয়ে যাওয়ার সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে, গতকাল বুধবার দুপুরে সিলেটের সদর দপ্তরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কর্মকর্তারা রায়হান হত্যার সার্বিক বিষয় নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন।
এ সময় সংবাদ সম্মেলনে বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, পিবিআই রায়হান হত্যা মামলার তদন্তভার পাওয়ার পর মহানগর পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষ্য নেয়া, সাক্ষিদের জবানবন্দিসহ নানা বিষয় পর্যালোচনা করে অভিযোগপত্র প্রস্তুত করে। অভিযোগপত্রসহ মোট কেস ডকেট ১ হাজার ৯৬২ পৃষ্টা রয়েছে। এরমধ্যে ২২ পৃষ্টা হচ্ছে শুধু চার্জশিট (অভিযোগপত্র)। পিবিআই তদন্ত করার সময় রায়হানের সাথে কোন পুলিশ সদস্যদের শক্রতা ছিলো কিনা সে বিষয়টি তদন্ত করা হয়। তবে এর সত্যতা মিলেনি। এছাড়াও পিবিআই আকবরের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত ডিভাইসগুলো অ্যানালাইসিস করে প্রাপ্ত তথ্য অভিযোগপত্রে দাখিল করা হয়। তিনি বলেন, ১১ অক্টোবর গোলাগঞ্জের প্রতারক সাইদুল শেখ ও রনি শেখ রাত ১টা ৪৫ মিনিটে কাস্টঘর সুইপার কলোনী থেকে ৪ পিস ইয়াবা ক্রয় করে। ক্রয়কৃত ইয়াবাগুলো আসল নয় তারা বুঝতে পারেন। এরপর এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রায়হান আহমদ মারপিট করে সাইদুল শেখের কাছ থেকে মোবাইল ও ৯ হাজার ৭০০ টাকা নিয়ে যায়। পরবর্তীতে কোতোয়ালি থানার নগরীর মাশরাফিয়া রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সিয়েরা-৪ ও রোমিও-৪ এর কাছে সাইদুল শেখ ও রনি শেখ মৌখিকভাবে অভিযোগ করেন।
পরে পুলিশ কাস্টঘরের চুলাই লালের ঘর থেকে রায়হান আহমদকে আটক করে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। এরপর পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই, পুলিশের সাথে খারাপ আচরণ করায় রায়হানকে ফাঁড়িতে নিয়ে এসআই আকবর বেতের লাঠি দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে মারপিট করেন। এরপর ১১ অক্টোবর সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রায়হানকে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য আসামীরা ভিকটিম রায়হানকে কাস্টঘরে ছিনতাকালে গণপিটুনিতে মারা মিথ্যা তথ্য প্রচার করে এবং ঘটনার সংশ্লিষ্ট আলামত ধ্বংস করে।
সংবাদ সম্মেলনে মো. হুমায়ন কবীর বলেন, রায়হানের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালে দ্রুত বিচার আইনে (ছিনতাই) একটি মামলা ছিল। পরবর্তীতে সেটির বিচার কাজ শেষ হয়। এরপর ২০১৮ সালে তার বিরুদ্ধে আরও একটি মাদক মামলা দায়ের করা হয়। সেটি বিচারাধীন রয়েছে। তিনি বলেন, রায়হান মাদক বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে কাষ্টঘর এলাকায় তার সব সময় আসা যাওয়া ছিল। ঘটনার দিন রাতেও তিনি সেখানে অবস্থান করছিলেন। পিবিআই পুলিশ সুপার বলেন, আমরা ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে কথা বলেছি। মামলার ১৯৬২ পৃষ্টার চার্জশিটে ৬৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ জন ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলার ধারায় আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হতে পারে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি আরও বলেন, চার্জশিটে অভিযুক্ত ৬ জনের মধ্যে ৫ পুলিশ সদস্যই জেলহাজতে রয়েছেন। পুলিশের বাইরে আলামত নষ্টকারী আব্দুল্লাহ আল নোমান পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেফতারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ খালেদ উজ জামান ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আওলাদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ খালেদ উজ জামান বলেন, আলোচিত এ মামলার আসামি পুলিশ হওয়ায় নিখুঁত তদন্তের স্বার্থে ক্রটিমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য চার্জশিট তৈরি করতে কিছুটা সময় লেগেছে। অভিযোগপত্রে আমরা রায়হানের সঙ্গে অভিযুক্ত এসআই আকবরসহ বাকি কারো কোনো পূর্ব শক্রতা ছিল কি না তা খতিয়ে দেখেছি। অভিযোগপত্রে ৫ পুলিশসহ ৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।
সিলেট আদালতের ইন্সপেক্টর প্রদীপ কুমার দাস বলেন, আলোচিত এ হত্যা মামলায় ১৯৬২ পৃষ্ঠার একটি চার্জশিট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক আওলাদ হোসেন জমা দিয়েছেন। করোনাভাইরাসের কারণে আদালতের কার্যক্রম ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে চলার কারণে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) আদালতে দাখিল করা হচ্ছে না। আদালতের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসলে দাখিলকৃত চার্জশিটটি আদালতে জমা দেয়া হবে বলে জানান তিনি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নগরীর আখালিয়া নেহারিপাড়ার বাসিন্দা রায়হানকে ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর রাতে সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। কাষ্টঘর সুইপার কলোনি থেকে তাকে ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যান এই ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া ও তার সহকারীরা। এরপর কয়েক ঘণ্টা চলে নির্যাতন। শেষ রাতে এক পুলিশ সদস্যের মোবাইল থেকে নিজের চাচাকে ফোন করে রায়হান। এসময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে দ্রুত ১০ হাজার টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে আসার জন্য চাচাকে অনুরোধ করেন। ভোরের ফজরের নামাজের পূর্ব মূহূর্তে টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে হাজির হন চাচা। তবে তখন তাকে রায়হানের সাথে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। এরপর (১১ অক্টোবর) সকালে আবার চাচা ফাঁড়িতে গেলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অসুস্থ হয়ে পড়ায় রায়হানকে ওসমানী হাসপাতপালে পাঠানো হয়েছে। পরে হাসপাতালের মর্গে গিয়ে রায়হানের লাশ দেখতে পায় পরিবার। এ ঘটনায় ১১ অক্টাবর রাতেই হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। পরে রায়হান হত্যার বিচার দাবিতে সিলেট জুড়ে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। অবশেষে প্রায় সাড়ে ৭ মাস পর আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) প্রদান করা হলো।
মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম এ ফজল চৌধুরী জানান, পিবিআই দাখিলকৃত চার্জশিটে (অভিযোগপত্র) আপাতত কোন অসংঙ্গতি চোখে পড়েনি। তবে অভিযোগপত্রসহ অন্যান্য কাগজপত্র তুলার পর বিস্তারিত জানা যাবে। এরপর অভিযোগপত্র নিয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
রায়হান হত্যার চার্জশিট দাখিলের পর এক শিক্ষার্থী বলেন, রায়হান আগে কি ছিল, তার বিরুদ্ধে ক’টি মামলা আছে, সে মাদক বিক্রির সাথে জড়িত কি না বা ছিনতাইকারী ছিল কি না, এসব প্রশ্ন এখন অবান্তর। আসল সত্য হচ্ছে, ফাঁড়িতে নেয়ার পর নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে। এই সত্যটা উপেক্ষার কোন উপায় নেই। সে ছিনতাইকারী হলে আটক করে আদালতে পাঠাতে পারতেন পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্তারা। তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হলো কেন?
এ ব্যাপারে এক ব্যবসায়ী জানান, ছিনতাইকারী এমনটা কোনদিন শুনিনি। আর ছিনতাইকারী হলেওতো তাকে পুলিশ পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারেনা। বাস্তবতাতো তাই। তারা প্রকৃত দোষীদের মৃত্যুদন্ডের দাবি জানান।
দাখিলকৃত চার্জশিট নিয়ে রায়হানের মা সালমা বেগম যা বললেন:
রায়হান আহমদের মৃত্যুর পর থেকেই হত্যাকান্ডের সুষ্ট বিচার দাবি করে আসছে তার পরিবার। পুলিশের নির্যাতনে হত্যা করা হয়েছে এমন দাবি করে এই হত্যাকান্ডের বিচার দাবিতে আন্দোলনে নামেন রায়হানের মা সালমা বেগম। তার এই আন্দোলন ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো সিলেটে। রায়হানের মৃত্যুর প্রায় সাড়ে ৬ মাস এই মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) জমা দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিশেন (পিবিআই)। অভিযোগপত্রে রায়হানকে পুলিশ ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালানোর প্রমাণ পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযুক্ত করা হয়েছে ৫ পুলিশ সদস্যসহ ৬ জনকে। গতকাল বুধবার সকালে জমা দেওয়া এই অভিযোগপত্র নিয়ে মা সালমা বেগমের সাথে কথা হয়।
অভিযোগপত্র নিয়ে তিনি বলেন, পিবিআই একটি দীর্ঘ অভিযোগপত্র দিয়েছে। এটি পুরোটা এখনও আমি পড়তে পারিনি। এছাড়া আমি একজন সাধারণ গৃহিনী। আইনী সব বিষয় বুঝিও না। এই অভিযোগপত্র নিয়ে আমার আইনজীবীদের সাথে কথা বলবো। তাদের পরামর্শ মতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো।
যদিও প্রথম থেকেই অভিযোগ করে আসছেন রায়হানের মা সালমা বেগম। অন্য কারো ইন্ধনে পূর্ব পরিকল্পনার জেরে রায়হানকে তুলে এনে নির্যাতন করেছে পুলিশ।
সালমা বেগম বলেন, পূর্ব বিরোধ না থাকলেও আমার ছেলেকে ধরে নির্যাতন করার অধিকার কারো নাই। সে অন্যায় করে থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশ মারধর করবে কেনো? সালমা বেগম বলেন, রায়হানকে রাত ১টার দিাকে তুলে নেয়। সকাল ৭টার দিকে সে মারা যায়। এই ৬ ঘন্টা ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে তাকে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমি এই হত্যাকান্ডের বিচার চাই। এখানে পূর্ববিরোধ বা তাৎক্ষণিক বিরোধ মূখ্য বিষয় নয়। রায়হানের মা বলেন, রায়হান অপরাধ করে থাকলে তাকে ধরার পর পুলিশ আমাদের অবহিত করবে। কিন্তু তা না করে শেষ রাতে টাকা চেয়ে ফোন করানো হলো। আর রায়হানের মৃত্যুর পর নিজেদের এক দালালের মাধ্যমে আমাদের কাছে খবর পাঠায় পুলিশ। এসব কেনো করা হলো?
সালমা বেগম বলেন, ইয়াবা-ছিনতাইসহ এখন নানা বিষয়কে রায়হানের সাথে জড়ানো হচ্ছে। রায়হান যেহেতু নেই তাই এমন বিষয়ের সত্য-মিথ্যা যাছাই করা সম্ভব নয়। এখন তো সে আর এসবের প্রতিবাদ করতে পারবে না। ফলে আমাদের দাবি একটাই, রায়হান হত্যার বিচার চাই।