কাজিরবাজার ডেস্ক :
ভারতে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সেই ঢেউ সুনামির মতো গ্রাস করছে পশ্চিমবঙ্গেও।
রাজ্যে প্রতিদিন ১৫ হাজারের বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত শনাক্তের সংখ্যা ১৬ হাজার পেরিয়ে গেছে। ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে ৭০ জনের বেশি।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার ২৬ এপ্রিল থেকে ৯ মে পর্যন্ত ভারত সীমান্তে চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে। আর তাতেই শোচনীয় দশায় পড়েছেন ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা।
এই মুহূর্তে শুধু পশ্চিমবঙ্গে কমবেশি ১০ হাজারের মতো বাংলাদেশি অবস্থান করছেন। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ রোগী। বাকিরা শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা দিয়েছে যারা দেশে ফিরবেন তাদের হাইকমিশন থেকে এনওসি সংগ্রহ করতে হবে এবং দেশে ঢুকতে তারা ব্যবহার করবে পশ্চিমবঙ্গের বেনাপোল-পেট্রোপোল, বুড়িমারী-চ্যাংড়াবান্ধা এবং আগরতলা-আখাউড়া সীমান্ত। ফলে এনওসি দেওয়ার চাপ বেড়েছে বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনগুলোতে। বিশেষ করে চাপ পড়েছে কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে।
মঙ্গলবার (২৭ এপ্রিল) কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনে আবেদন জমা পড়েছে চারশোর মতো। সোমবার জমা পড়েছে ২৫০ আবেদন। অপরদিকে কলকাতা ডেপুটি হাইকমিশনের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনার কবলে। ফলে অর্ধেক লোকবল নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের। এনওসি দিতেও রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে।
ডেপুটি হাইকমিশনের যখন এই অবস্থা তখন রোজার মধ্যে ৪১ ডিগ্রি তাপমাত্রা মাথায় নিয়ে ১৬ থেকে ১৭ ঘণ্টা এনওসির জন্য লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে বাংলাদেশিদের। অপরদিকে আর্থিক অবস্থাও দিন দিন খারাপ হওয়ায় আধপেটা খেয়ে অসুস্থ রোগী নিয়ে পথেই রাত কাটাতে হচ্ছে কাউকে কাউকে। এরই মধ্যে মাছির মতো একদল দালাল চক্রও কাজ করছে। ফলে লাইনে দাঁড়ানো বাংলাদেশিদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা।
দালাল চক্রের খবর পেয়ে বাইরে বের হয়ে আসেন মিশনের ভিসা প্রধান বসিরউদ্দিন। তাকে সামনে পেয়ে ক্ষোভ উগড়ে দিলেন বাংলাদেশিরা। তাদের মতে, কেন এই হঠাৎ সিদ্ধান্ত? আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, এর দায় কার? গেট পাসে না পাওয়া অবধি কোথায় রাত কাটাবো? ভারতে যে করোনা পরিস্থিতি ভালো নয় বলে সীমান্ত বন্ধ হলো এখন তাদের করোনা হলে কে দেখবে? সহানুভূতির সঙ্গে প্রতিটা কথার উত্তর দিয়েছেন ভিসা অফিসার।
খুলনাবাসী আলমগীর হোসেন বলেন, আমার তিন বছরের বাচ্চার হার্টে দুটো ছিদ্র আছে। ভেলোরে গিয়েছিলাম। তারা জানায় এখানে চিকিৎসা হবে না। যত তাড়াতাড়ি পারো দেশে ফিরে যাও। যখন তখন বিপদ ঘটতে পারে। এ অবস্থায় সোমবার রাত ১১টায় হাওড়া নেমে বর্ডারে চলে যাই। গিয়ে দেখি বর্ডার বন্ধ। কেন বন্ধ আগে থেকে জানতাম না। সেখানে থেকে জানালো হলো হাইকমিশনের পাস ছাড়া যাওয়া যাবে না। এখানে লাইনে কোনো শৃঙ্খলা নেই। তবে কাগজ জমা দিয়েছি। দুই রাত বাচ্চাটাকে ভালোভাবে খাওয়াতেও পারিনি।
সাত বছরের মেয়ে রিয়া মন্ডলকে নিয়ে বর্ডারে গিয়ে একই সমস্যার সম্মুখীন হয়ে এনওসির জন্য ফিরে কলকাতার বাংলাদেশ মিশনে ফিরে এসেছেন নড়াইলের এক বাবা। তিনি বলেন, এখানে এসে বিপদে পড়েছি। হাতে টাকা নেই, থাকার জায়গা নেই, ফুটপাতেই দিন কাটাচ্ছি। ব্যাঙ্গালোরে অপারেশন করে গতকাল বর্ডারে যাই। সেখানকার অথরিটি বলে, বাংলাদেশের সঙ্গ কথা চলছে আমরাও চেষ্টা করছি। সেই আশায় সন্ধ্যা সাতটা অবধি বসেছিলাম বর্ডারে। পরে তারা নিরুপায় হতে চলে আসি এখানে। খুব কষ্টে আছি।
ক্যান্সারে আক্রান্ত রুহিনার মা। কয়েক লাখ রুপি খরচ করে মাকে ক্যান্সারের চিকিৎসা করিয়েছেন। তিনিও জানতেন না বর্ডার বন্ধ। মঙ্গলবার জমা দিয়েছেন আবেদন। রুহিনা বলেন, আর একদিনও থাকলে হোটেলের ভাড়া দিতে পারবো না। আমাদের সরকারের কাছে আবেদন করছি খুব তাড়াতাড়ি এ যন্ত্রণা থেকে রেহাই দিন।
শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী সবাই আছে এই লাইনে। ৯ মে পর্যন্ত শুধু রোগীরাই ফেরার অনুমতি পাবেন জেনে ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন তারাও। শেষ সম্বলটুকু দিয়ে কলকাতা থেকে কেনাকাটা করেছেন ইফতেখার। দেশে গিয়ে ঈদেও দুটো পয়সার মুখ দেখবেন বলে। পরিস্থিতি যা তাতে ১১-১২ তারিখের আগে দেশে ফিরতে পারবেন না তিনি। তাহলে এসব পণ্য নিয়ে কী করবো? প্রশ্ন ইফতেখারের।
কলকাতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রোডে এখন কান পাতলে এরকমই হাহাকার শোনা যাচ্ছে। সবারই বাড়ি ফেরার তাড়া। কিন্তু উপায় কী? কে বলতে পারে? ডেপুটি হাইকমিশনের ভিসা প্রদানকারী বসিরউদ্দিন বলেন, স্বীকার করছি সমস্যার মুখে পড়েছেন বাংলাদেশিরা। আমরাও আপ্রাণ চেষ্টা করছি। সে কারণে রোজার মধ্যেই কম লোকবল নিয়ে রাত আটটা-নয়টা পর্যন্ত কাজ করছি। খুব তাড়াতাড়ি মিটে যাবে সমস্যা।
তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় গাদাগাদি ভিড়ের মধ্যে যেভাবে আবেদন জমা পড়ছে, তাতে বাংলাদেশ রেহাই পাবে তো করোনার নতুন স্ট্রেইন থেকে? কারণ পরিসংখ্যান বলছে, পশ্চিমবঙ্গে প্রতি চার জনের মধ্যে একজন করে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। গোটা ভারতে ১ মিনিটে ৫ জনের শরীরে ধরা পড়ছে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট। ফলে শেষ রক্ষা হবে তো?