কাজিরবাজার ডেস্ক :
ভারতে ডাবল ও ট্রিপল মিউট্যান্ট করোনা ভাইরাসের ধরনের অস্তিত্ব মিলেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ার কারণে করোনার এই নতুন ধরন বাংলাদেশে চলে আসার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। যদি ঢুকেই পড়ে তবে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ওটাকে সামাল দিতে প্রস্তুত নয় বলে আশঙ্কা তাদের। কারণ এই কারণগুলো রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে সক্ষম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে এখনও এই ধরনের অস্বিস্ত পাওয়া যায়নি। কিন্তু বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে সীমান্তের স্থলবন্দর দিয়ে যাতায়াতও চলছে, তাই দেশে এই ধরন আসতে বেশি দেরি লাগবে না। এসে পড়লে পরিস্থিতি ভয়ানক হবে।
এদিকে নতুন-পুরাতন ধরনের কারণে ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ বেড়েছে। বিশেষ করে নয়াদিল্লী ও মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বেশ নাজুক। গুরুতর রোগীদের জন্য অক্সিজেন সঙ্কটও দেখা গেছে। প্রথমবারের মতো ভারতে একদিনে মৃত্যু আড়াই হাজার ছাড়িয়েছে। এছাড়া একদিনে শনাক্তের সংখ্যা পৌঁছাল সাড়ে তিন লাখে। গত ২৪ ঘণ্টায় দুই লাখের বেশি সুস্থ হয়েছে। নতুন আক্রান্ত একদিনে দাঁড়াল ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৭৮৬। গত এক বছরে সেখানে মোট করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ১ কোটি ৬৬ লাখ ১০ হাজার।
ভারতে করোনাভাইরাসের ‘ডাবল মিউট্যান্ট’ আতঙ্ক কাটতে না কাটতেই সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে ‘ট্রিপল মিউট্যান্ট ধরনের কথা। ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গসহ দেশটির অন্তত চারটি রাজ্যে এ ধরন শনাক্ত হয়েছে। বাকি রাজ্যগুলো হচ্ছে দিল্লী, মহারাষ্ট্র ও ছত্তিশগড়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড-১৯ ভাইরাসের তিনটি আলাদা স্ট্রেইন মিলে তৈরি নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের ক্ষমতা তিনগুণ বেশি। নতুন এই ধরনে আক্রান্তদের শারীরিক অবস্থারও দ্রুত অবনতি ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়মতো লাগাম পরানো না গেলে এবার সংক্রমণের সুনামি ঘটবে। ভারতে করোনাভাইরাসের ‘ডাবল মিউট্যান্ট- ই.১.৬১৭ ধরন শনাক্তের পর থেকেই এ নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে ধরনটি ভারতের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে।
ভারতের জিনোম বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের যে ‘ডাবল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্ট’ চিহ্নিত করেছেন, সেটি নিয়েও উদ্বেগ আছে। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এই ডাবল মিউটেশনের কারণে ভাইরাসটি মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ফাঁকি দিতে পারে। টিকা তখন কাজ করে না।
যুক্তরাষ্ট্রের লুইসিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির হেলথ সায়েন্স সেন্টারের ভাইরোলজিস্ট ড. জেরেমি কামিল জানিয়েছেন, ভারতের একটি মিউটেশন, ই৪৮৪কিউ অনেকটা দক্ষিণ আফ্রিকার বা ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্টের কাছাকাছি।
ড. কামিলের মতে, ভারতে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের তীব্রতার পেছনে সম্ভবত এই ধরনই ভূমিকা রেখেছে। অবস্থাদৃষ্টে দেখা গেছে, এটি ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা ৫০ শতাংশ বেশি এবং ৬০ শতাংশ বেশি মারাত্মক। আগের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রতি একজনের মৃত্যুর তুলনায় এটিতে মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৬। তবে ড. কামিলের মতে, দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্য মানুষের উদাসীনতাই বেশি দায়ী।
বাংলাদেশে এখনও ভ্যারিয়েন্ট রিপোর্টেড হয়েছে বলে জানা যায়নি। কিন্তু যদি চলে আসে তবে সেটা বাংলাদেশের জন্য কী পরিমাণ ঝুঁকির কারণ হবে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং কোভিড ১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডাঃ নজরুল ইসলাম বলেন, ভারত থেকে যদি চলেই আসে তবে তা আমাদের জন্য অনেক ঝুঁকির হবে, আর এটা যে আসবেই তা সহজে ধরে নেয়া যায়। সুপারিশমতো কোয়ারেন্টাইনও আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা ডাঃ মুশতাক হোসেন বলেন, ভারতের এই ভাইরাস আমাদের দেশে ছড়ানোর সমূহ আশঙ্কা আছে। একে তো আমাদের প্রতিবেশী দেশ, তার ওপর স্থলবন্দর দিয়ে প্রচুর মানুষ যাতায়াত করছে।
ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ একদম বন্ধ করা সম্ভব নয় বিভিন্ন কারণে। আর এ কারণে এই ধরন আসতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ রিদওয়ানুর রহমান। তিনি বলেন, বন্দরগুলোতে এ্যান্টিজেন টেস্ট চালু করা উচিত। এতে ২০ মিনিটের মধ্যে ফলাফল জানা যাবে। কোয়ারেন্টাইনও সেরা উপায়। কিন্তু যদি সেটা সম্ভব না হয়, তবে পরীক্ষা করিয়ে দেশে ঢোকাতে হবে। এতে অন্তত ৯০ শতাংশ শনাক্ত করা যাবে।
ভাইরাস মিউটেশন নিয়ে কাজ করছে আইইডিসিআর। আমাদের দেশে এই ডাবল বা ট্রিপল মিউটেশনের ধরন পাওয়া গেছে কিনা বা এ নিয়ে কাজ হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা ডাঃ মুশতাক হোসেন বলেন, আমাদের জিনোম সিকোয়েন্স করা আরও বেশি প্রয়োজন। সরকারীভাবে আইইডিসিআর থেকে জিনোম সিকোয়েন্স করা হচ্ছে। তবে এটা আরও বাড়ানো দরকার।
একইসঙ্গে ভারতের ধরনটি সত্যিই বেশি বিপজ্জনক কিনা তা এখনও প্রমাণ হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট, অর্থাৎ একে খতিয়ে দেখা হবে।
এদিকে, কোয়ারেন্টাইন এবং টেস্টের পরও ঝুঁকি থাকে বলে মন্তব্য করে অধ্যাপক রিদওয়ানুর বলেন, ইতোমধ্যেই এটা বাংলাদেশে এসে গেছে কিনা জানা দরকার। এর জন্য পুরো দেশ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে সিকোয়েন্সিং করতে হবে। পাশাপাশি দেশজুড়ে ডাটাবেজও ডেভেলপ করা দরকার।
ভারতের এই ডাবল বা ট্রিপল মিউটেন্ট যদি বাংলাদেশে চলেই আসে তবে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সামাল দিতে পারবে কিনা প্রশ্নে অধ্যাপক ডাঃ নজরুল ইসলাম বলেন, এখনই তো সামাল দেয়া যাচ্ছে না। সেখানে ওটা কী করে সামাল দেব। আমাদের দেশে যা হবার তা-ই হবে। আমরা কিছু পারিনি, পারবও না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ও অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ রোবেদ আমিন বলেন, তারা আমাদের এখন পর্যন্ত ডাবল বা ট্রিপল মিউট্যান্ট ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে জানায়নি। কিন্তু ভারত থেকে এই ধরন দেশে আসার আশঙ্কা রয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, যেহেতু প্রতিবেশী দেশ, এয়ার ট্রাভেল বন্ধ করার আগেও চলে আসতে পারে। আমাদের এখন কন্টাক্ট ট্রেসিংও হচ্ছে না। তাই দেশে এসেছে কিনা সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।