করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সবাই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়

10

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রথম ধাক্কা সামলানোর আগে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় দেশের অর্থনীতিতে নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে। শিল্প মালিক থেকে শুরু করে দোকান মালিক পর্যন্ত সবাই রয়েছেন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। কঠোর লকডাউনে আবার সবকিছু স্থবির হয়ে পড়েছে। চাপে ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের ব্যবসায়ীরা। চাকরিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। শিল্পকারখানা খোলা থাকলেও রফতানি আদেশ অনুযায়ী বিদেশী ক্রেতারা পণ্য নেবেন কিনা সেখানেও রয়েছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা। কারণ রফতানি পণ্যের প্রধান ক্রেতা ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ এখন আবার লকডাউন ঘোষণা করেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার প্রথম ধাক্কার পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে রয়েছে দেশ। ঠিক সেই মুহূর্তে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় চাপে পড়েছে অর্থনীতি। তবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আশাবাদী হয়ে বলেছেন, প্রথমবারের মতো করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা থেকে দেশের অর্থনীতি সামলে উঠতে সক্ষম হবে। এ লক্ষ্যে নতুন করে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সরকার।
জানা গেছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কবলে পড়েছে দেশের অর্থনীতির প্রাণ রফতানি ও রেমিটেন্স আহরণ খাত। ক্রেতা দেশগুলোর অর্ডার কমে যাওয়ায় রফতানি প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এছাড়া রেমিটেন্সেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়বেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। লকডাউনের কারণে তাদের দোকানপাট বন্ধ করে অলস সময় পার করতে হচ্ছে। এছাড়া দিনমজুর বিশেষ করে রিক্সা, ভ্যান ও ঠেলাচালক শ্রেণীর শ্রমজীবী মানুষ বেকার হয়ে পড়বেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের শিল্প খাত সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্যমতে, সারাদেশে প্রায় ২০ লাখ দোকান রয়েছে। এসব দোকানে প্রায় ৬০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। লকডাউনের কারণে সবাই এখন বসে আছেন। এভাবে চলতে থাকলে সবার পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়বেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ হেলাল উদ্দীন বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলা তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। ইতোমধ্যে পহেলা বৈশাখের কেনাকাটা না হওয়ায় তারা পুরোপুরি লোকসান করেছেন। এখন লকডাউনের কারণে মার্কেট, শপিংমলসহ সব কিছু বন্ধ রয়েছে। এ কারণে ঈদ বাণিজ্যেও ধস নামার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিলে ব্যবসায়ীরা নিঃস্ব হয়ে যাবেন।
জানা গেছে, করোনার কারণে সরকারের রাজস্ব আদায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। করোনার ভ্যাকসিনসহ সরঞ্জামাদি কিনতে আবার নতুন করে কেনাকাটা করতে হবে। খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের আমদানি ব্যয় বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ কারণে বৈদেশিক ঋণের ওপর বেশি নির্ভরতা বাড়বে। করোনার কারণে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ রয়েছে। ফলে কর্মসংস্থানের বাজার না বেড়ে বরং সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। এ অবস্থায় প্রয়োজনীয় ও সঠিক উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হলে গভীর সঙ্কটে পড়তে পারে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে টিকা কিনতে ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। ওই প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য দাতা সংস্থার কাছে চিঠি দিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। বিশ্বব্যাংক আভাস দিয়েছে, নতুন এই ধাক্কা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। গত জুন মাসের পর অর্থনীতি যে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, তা টেকসই নয়। সার্বিকভাবে করোনার নতুন ঢেউ অর্থনীতিতে শঙ্কার পদধ্বনি জানান দিচ্ছে। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ আবার লকডাউনে গেছে। ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের চাহিদাও কমেছে। রফতানিও আগের মতো হচ্ছে না। প্রবাসী আয়ে বড় ধাক্কা আসতে পারে। কারণ, করোনার কারণে এক বছর ধরে বিদেশে শ্রমিক যাওয়া অনেক কমেছে, বরং অনেকে দেশে ফিরে আবার যেতে পারছেন না।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, দেশ এখন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। করোনার নতুন ঢেউয়ের কারণে এই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বড় ধরনের ধাক্কা খাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে তৈরি পোশাক রফতানি খাত। তিনি আরও বলেন, কাক্সিক্ষত সরকারী সহায়তা না পেলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু এই ধাক্কা তাদের পথে বসিয়ে দিতে পারে।
প্রবাস আয় ও রফতানিতে বিপর্যয় তৈরি হতে পারে ॥ করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে বাংলাদেশের রফতানিতে বড় ধরনের বিপর্যয় তৈরি হতে পারে। দেশের বড় বাজার ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে লকডাউন থাকায় তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ কমে গেছে। ফলে বাংলাদেশের সার্বিক রফতানিও কমেছে। তিন মাসে (ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) একদিকে রফতানির লক্ষ্য যেমন অর্জিত হয়নি, তেমনি একই সময়ের তুলনায় আগের বছরের চেয়ে রফতানির পরিমাণও কমেছে। কিন্তু গত জুন মাসে কলকারখানা পুরোদমে খুলতে শুরু করলে রফতানিও বাড়তে থাকে। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস রফতানির লক্ষ্য যেমন অর্জিত হয়েছিল, তেমনি আগের বছরের চেয়েও বেশি পণ্য রফতানি হয়েছে। গার্মেন্টস মালিকরা বলছেন, আগের বারের মতো আবারও সব কিছু বন্ধ করে দিলে রফতানিতে ধস নামতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় শক্তি প্রবাসী আয়। করোনার প্রথম ধাক্কায় প্রবাসী আয় না কমলেও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে শ্রমিক যাওয়া ব্যাপক কমেছে। ফলে মাসওয়ারি ভিত্তিতে প্রবাসী আয় কমতে শুরু করেছে। দ্বিতীয় ধাক্কায় পরিস্থিতি আরও বেগতিক হতে পারে। বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২০ সালের নবেম্বর মাস পর্যন্ত আগের বছরের তুলনায় প্রবাসে শ্রমিক যাওয়া কমেছে ৭১ শতাংশ। এর প্রভাবও পড়েছে প্রবাসী আয়ে। গত সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে আগের মাসের তুলনায় প্রবাসী আয় কমেছে। তবে করোনার আগের তুলনায় আয় বেড়েছে। মূলত ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনার ফলে বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানো বেড়েছে।
জানা গেছে, গত বছরে দেশে দুই হাজার ১৭৪ কোটি ১৮ লাখ (২১.৭৪ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠান প্রবাসীরা। এর আগে এক বছরে বাংলাদেশে এত রেমিটেন্স আর কখনও আসেনি। এটি এর আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৩৪০ কোটি ৯৬ লাখ ডলার বা ১৮.৬০ শতাংশ বেশি। রেমিটেন্সের ওপর ভর করেই বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবার ৪৪ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে। করোনা মহামারীর নতুন বিস্তারের মধ্যে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে পণ্য রফতানি আয়ে বাংলাদেশ আগের একই সময়ের চেয়ে সামান্য পিছিয়ে রয়েছে। গত মার্চ মাসে অবশ্য রফতানি আয়ে বেশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বাংলাদেশ পণ্য রফতানি করে দুই হাজার ৮৯৩ কোটি ৮৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার আয় করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ০.১২ শতাংশ কম। মার্চ মাসে বাংলাদেশ থেকে ৩০৭ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে, যা আগের বছরের মার্চের তুলনায় ১২.৫৯ শতাংশ বেশি। এর আগে বছরের প্রথম দুই মাসে রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়।
চাপে পড়বে এসএমই খাত ॥ লকডাউনের কারণে বেশি ঝুঁকিতে আছে দেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেবে, সারাদেশে এখন প্রায় ৪২ হাজার এমন কলকারখানা আছে। এসব খাতেই দেশের ৩৫ শতাংশ কর্মসংস্থান হয়। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা এই খাতে। প্রথম ধাক্কায় অনেকেই লোকসানে পড়েছেন। এখন কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। তবে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় দেশের অর্থনীতি সামলে উঠতে পারবে এবং এর প্রভাবে অর্থনীতি কোন চাপে পড়বে না বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সম্প্রতি অর্থনৈতিক বিষয়ক ও ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে তিনি বলেন, করোনা প্রতিরোধে আমাদের সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে আশা করছি, নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ফলে কোন সমস্যা হবে না। বিশ্ব অর্থনীতি একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আমাদের ক্রেতারা যদি করোনার কারণে অতিমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা হলে বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়তে পারে। অচিরেই করোনা নিয়ন্ত্রণে আসবে। আশা করছি, কোন সমস্যা হবে না। অর্থমন্ত্রী জানান, ‘অর্থনীতির দুটি উৎস। একটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ এবং অপরটি আন্তর্জাতিক। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বিশ্ব-অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে নয়। তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে এর প্রভাব সারা বিশ্বেই পড়বে। করোনা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কারণ ব্যাখা করে বলেন, প্রত্যেক দেশে টিকা দেয়া শুরু হয়েছে। এই কার্যক্রম শেষ হলে করোনার সংক্রমণ কমে আসবে। যেসব দেশে টিকা দেয়া হয়েছে, সেখানে করোনা কমেছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও শাশা ডেনিমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজটি যথাযথ বাস্তবায়ন হওয়া সবচেয়ে বেশি জরুরী। করোনায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের উদ্যোক্তারা। এবার করোনার দ্বিতীয় ধাপ এবং লকডাউন সামাল দিতে সরকারকে ভীষণ বেগ পেতে হবে। এসএমই খাত না টিকলে অর্থনীতি টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।