কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে মিয়ানমারকে চাপ দেয়ার জন্য ডি-৮ সদস্য দেশগুলোর প্রতি অনুরোধ জানানোর পাশাপাশি সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এই সঙ্কটের সমাধান না হলে এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই সমস্যা বাংলাদেশের পরিবেশ, সমাজ এবং অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে গণভবন থেকে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জোট ডি-৮ দশম শীর্ষ সম্মেলনে (ভার্চুয়াল) সূচনা এবং পরে সভাপতির সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানিয়ে আরও বলেন, মানবিক বিবেচনাবোধ থেকে বাংলাদেশ মিয়ানমারের ১১ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিককে আশ্রয় দিয়েছে। শুরু থেকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিরাপদ, সম্মানজনক এবং টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য চেষ্টা করে আসছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিন বছরের বেশি সময় পার হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন এখনও শুরু হয়নি। সবাইকে সতর্ক করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সঙ্কটের সমাধান না হলে এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত দশম ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত ছিলেন মিসর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মালয়েশিয়া, নাইজিরিয়া, পাকিস্তান এবং তুরস্কের নেতারা। শীর্ষ সম্মেলনের শুরুতেই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান ডি-৮’র চেয়ারম্যানশিপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করেন। বাংলাদেশ আগামী দুই বছর ডি-৮’র চেয়ারের দায়িত্ব পালন করবে। এ বছর শীর্ষ সম্মেলনে মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়- ‘পরিবর্তনশীল বিশ্বে অংশীদারিত্ব : যুবশক্তি ও প্রযুক্তির প্রস্তুতি।’
বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় দশম ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে ডি-৮ ভুক্ত অন্য রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানগণের মধ্যে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে বক্তব্য রাখেন মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ সিসি, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো, ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি, মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট মুহিউদ্দিন ইয়াসিন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইমরান খান ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। অপর সদস্য নাইজিরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ বুহারি অসুস্থ থাকায় দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিউফ্রে অনিয়ামা তাঁর পক্ষে বক্তব্য রাখেন। এছাড়াও আইএসডিজি’র প্রেসিডেন্ট ড. ভান্ডার এমএইচ হাজজার বিশেষ অতিথি হিসেবে সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সূচনা বক্তব্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, যুব উন্নয়ন, তথ্য প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডি-৮ সদস্য দেশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর আহ্বান জানান। পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে যুব শক্তিকে কাজে লাগানো, তথ্যপ্রযুক্তি সম্ভাবনার পূর্ণ ব্যবহার, প্রয়োজনীয় আইনী, প্রাতিষ্ঠানিক ও অবকাঠামোগত কাঠামো তৈরি, কানেকটিভিটি বাড়ানো, ডি-৮ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চারটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। সেগুলো হচ্ছে- দক্ষতা বিকাশের মাধ্যমে আমাদের যুবকদের শক্তি বাড়ানো, আইসিটি সম্পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো, প্রয়োজনীয় আইনী, প্রাতিষ্ঠানিক এবং অবকাঠামোগত কাঠামো তৈরি করা এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুবিধার্থে সংযোগ স্থাপনের উন্নতি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়িক ধারণা, মডেল, উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তিতে তরুণদের শক্তি এবং সম্ভাবনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেসরকারী, এমনকি সরকারী থেকে বেসরকারী পর্যায়েও ব্যবসা উদ্যোগের মাধ্যমে আমাদের দেশগুলোর (ডি-৮) যুবকদের একত্রিত হতে উৎসাহিত করা যেতে পারে। ডি-৮ বিজনেস ফোরামের সঙ্গে প্রথম ডি-৮ ইয়ুথ সম্মেলনটি একটি বিরল সুযোগ তৈরি করেছে।
তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী ক্ষেত্রে কার্যকরী পার্টনারশিপ এবং বৃহত্তর সহযোগিতা প্রয়োজন। তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুবদের খুব ভাল সম্পৃক্ততা কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যেও আমাদের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে।
গত এক দশকে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তির ওপর জোর দিয়েছে এবং দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত করেছে বলে উল্লেখ করেন টানা তিন বারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ডি-৮ সদস্য দেশগুলোকে বাণিজ্য বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ডি-৮ সেক্রেটারিয়েট সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ক্ষেত্রে সম্ভবনার তথ্য সরবরাহ করতে পারে। এই ধরনের তথ্য সদস্য দেশগুলোর মধ্যে আরও বেশি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ করতে সহায়তা করবে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় ডি-৮ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসায়ীদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করার পাশাপাশি কার্যকরী এবং টেকসই উন্নয়নে ডি-৮ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে জলবায়ু ইস্যুতে সহযোগিতা করার তাগিদ দেন।
মুজিববর্ষ উদযাপনের পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের সুপারিশ লাভ করেছে। এ ঐতিহাসিক মুহূর্তে ডি-৮-’র পরবর্তী দুই বছরের সভাপতিত্ব লাভ করার মাধ্যমে বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক ফোরামে বাংলাদেশের অবস্থান আরও দৃঢ় হবে বলে প্রধানমন্ত্রী প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
ডি-৮ শীর্ষ নেতাদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনুষ্ঠানের এই সময়ে, আসুন আমরা ডি-৮ কে আরও গতিশীল, আরও দূরদর্শী, আরও প্রত্যাশিত গোষ্ঠীতে রূপান্তর করি। আসুন আমরা ডি-৮ কে আরও নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাই, আরও ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সম্পর্কের জন্য কাজ করি। আসুন আমাদের জনগণের জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনের, আমাদের সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য একসঙ্গে কাজ করি।
তিনি বলেন, আমার উদ্বোধনী বক্তব্যে আমি উল্লেখ করেছি যে ডি-৮ এখন সমন্বয় তৈরির মাধ্যমে তার অর্থনৈতিক বিকাশের লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রস্তুত। আমি উল্লেখ করে খুশি যে, সমস্ত বিশিষ্ট রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকারও একই মত পোষণ করেন। এই সাধারণ অবস্থানটি সামগ্রিকভাবে সংস্থার উচ্চাভিলাষ পূরণ করতে আমাদের সহায়তা করবে। এই মুহূর্তে আপনাদের বক্তব্য এবং পরামর্শগুলো শুনে আমি আশাবাদী এবং আত্মবিশ্বাসী বোধ করছি যে, একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে ডি-৮ সদস্য দেশগুলোর এক বিলিয়ন প্লাস লোকের জন্য একটি ভাল আগামীকাল তৈরি করতে পারব।
প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি প্রতিরোধে অভিযোজন এবং প্রশমনের পদক্ষেপসমূহ গ্রহণে কার্যকর সহযোগিতার জন্য ডি-৮ নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান এবং ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) বর্তমান চেয়ার হিসেবে বাংলাদেশ অন্যান্য ডি-৮ সদস্যরাষ্ট্রকে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে সদা প্রস্তুত মর্মে উল্লেখ করেন।
বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কোভিড-১৯’র নেতিবাচক প্রভাবের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শীর্ষ সম্মেলনে বলেন, এ সঙ্কট হতে উত্তরণের জন্য প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন খাতে কার্যকর এবং বৃহত্তর সহযোগিতার প্রয়োজন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, এ সঙ্কটকালীনও ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। তিনি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য নারীর ক্ষমতায়নের গুরুত্ব, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন এডুকেশন প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনটি সফলভাবে আয়োজন করেছিল। এবার দশম ডি-৮ সম্মেলনও আয়োজন করেছে ঢাকা।