কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভ্যন্তরীণ কিংবা বাহ্যিক যে কোন হুমকি মোকাবেলায় সেনাবাহিনীসহ সশস্ত্র বাহিনীকে সদা প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ যুদ্ধ নয় বরং শান্তি চায়, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রেখেই এগিয়ে যেতে চায়। আমরা শান্তি চাই, বন্ধুত্ব চাই। বৈরিতা চাই না, যুদ্ধ চাই না। তবে যদি কখনও আমরা আক্রান্ত হই সেটা মোকাবেলা করার মতো শক্তি যেন আমরা অর্জন করতে পারি, সেভাবেই আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে চাই এবং সেভাবেই আমরা তৈরি থাকতে চাই।
বুধবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৮টি ইউনিট/সংস্থার পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, পবিত্র সংবিধান এবং দেশমাতৃকার সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আপনাদের ঐক্যবদ্ধ থেকে অভ্যন্তরীণ কিংবা বাহ্যিক যে কোন হুমকি মোকাবেলায় সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে আবারও বলব- আমরা শান্তি চাই, বন্ধুত্ব চাই। কারণ যুদ্ধের যে ভয়াবহ রূপ তা আমার নিজের চোখে দেখা আছে। আমরাও ভুক্তভোগী। আর সেই ধরনের সংঘাতে আমরা জড়িত হতে চাই না। শান্তির পথ ধরে আমরা প্রগতির পথে এগিয়ে যেতে চাই।
সরকারপ্রধান আরও বলেন, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অত্যন্ত স্পষ্ট। যা জাতির পিতা দিয়ে গেছেন। সেই নীতি হলো- সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারোর সঙ্গে বৈরিতা নয়। আমরা কারো সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই না। আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই। এ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়েই আমরা বাংলাদেশকে আর্থ-সামাজিকভাবে উন্নত করতে চাই। কিন্তু যদি কখনও আমরা আক্রান্ত হই, তা মোকাবেলা করার শক্তি যেন আমরা অর্জন করতে পারি। সেভাবেই আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে চাই এবং সেভাবে আমরা তৈরি থাকতে চাই। প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাসের সেকেন্ড ওয়েভ সম্পর্কে সকলকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘শীতকাল আসছে, হয়ত করেনাভাইরাসের আরেকটা ধাক্কা আসতে পারে। তার জন্য সদা প্রস্তুত থেকে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে করোনা থেকে সুরক্ষিত থেকে আপনারা স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করবেন, এটাই আমরা আশা করি।’
প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ৭ম পদাতিক ডিভিশনের সদর দফতর লেবুখালী, পটুয়াখালী সেনানিবাসের অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন। মনোমুগ্ধকর কুচকাওয়াজের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রীয় সালাম জানানো হয়। লেবুখালীতে অবস্থিত শেখ হাসিনা সেনানিবাস প্রান্তে অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে সদর দফতর ৭ স্বতন্ত্র এডিএ ব্রিগেড (চট্টগ্রাম), সদর দফতর প্যারা কমান্ডো ব্রিগেড (সিলেট), সদর দফতর ২৮ পদাতিক ব্রিগেড, ৪৯ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি, ৬৬ ইস্টবেঙ্গল, ৪৩ বীর, ৪০ এসটি ব্যাটালিয়ন এবং ১২ সিগন্যাল ব্যাটালিয়নের আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেনাপ্রধান, সেনানিবাসের জিওসিসহ ঊর্ধ্বতন সেনাকর্মকর্তাগণ পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার লেবুখালীতে দেশের দক্ষিণবঙ্গের এই একমাত্র সেনানিবাসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। পায়রা নদীর তীরে অবস্থিত নয়নাভিরাম সৌন্দর্যমন্ডিত এই সেনানিবাসটি প্রায় ১৫শ’ ৩২ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, যখনই আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে তখনই সশস্ত্রবাহিনীর উন্নয়নে তাঁর সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা চেয়েছি সশস্ত্রবাহিনীর প্রতিটি সদস্যের জীবনমান উন্নত হোক এবং সমগ্র বাংলাদেশের মানুষেরই জীবনমান উন্নত হোক। আমরা সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের সরকার সেনাবাহিনীর উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নে বিশ্বাসী এবং সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই আমরা ফোর্সেস গোল-২০৩০ প্রণয়ন করি। ১৯৭৪ সালের প্রতিরক্ষা নীতির আলোকে আমরা উন্নয়ন করে যাচ্ছি।
সেনা সদস্যদের উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা বলেন, পবিত্র সংবিধান এবং দেশমাতৃকার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য আপনাদের ঐক্যবদ্ধ থেকে অভ্যন্তরীণ কিংবা বাহ্যিক যে কোন হুমকি মোকাবেলায় সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি শৃঙ্খলা এবং চেন অব কমান্ড বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, আপনারা সেনাবাহিনীর ভেতরের মূল চালিকা শক্তিগুলো অর্থাৎ ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের প্রতি আস্থা, পারস্পরিক বিশ্বাস, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, কর্তব্য পরায়ণতা, দায়িত্ববোধ এবং সর্বোপরি শৃঙ্খলা বজায় রেখে আপনাদের স্বীয় কর্তব্য যথাযথভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে যাবেন, সেটাই আমি আশা করি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের মানুষের ভরসা ও বিশ^াসের প্রতীক। সেভাবেই মানুষের আস্থা অর্জন করেই আপনাদের এগিয়ে যেতে হবে।
সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে দেশের জন্য কাজ করার লক্ষ্যে সর্বপ্রথম ‘পেশাদারিত্ব এবং প্রশিক্ষণ’ প্রয়োজন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পেশাদারিত্বের কাক্সিক্ষত মান অর্জনের জন্য আপনাদের সকলকে পেশাগতভাবে দক্ষ, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সৎ এবং মঙ্গলময় জীবনের অধিকারী হতে হবে।
সরকার প্রধান এ সময় পটুয়াখালীর লেবুখালীতে ৭ম পদাতিক ডিভিশনের সদর দফতর প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করে বলেন, পদ্মার এ পারে সশস্ত্রবাহিনীর কোন ব্রিগেড ছিল না, যে কারণে আমরা এখানে ৭ পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করেছি। আজ ৩টি ব্রিগেড সদর ও ৫টি ইউনিটের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সমৃদ্ধির পথে আরও এগিয়ে যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
তিনি বলেন, আমাদের সরকারের সময় সেনাবাহিনীতে অনেক আধুনিক যানবাহন, হেলিকপ্টার, সমরাস্ত্র ও সরঞ্জামাদি সংযোজন করা হয়েছে। এভাবেই দ্রুত ও সমন্বিত আধুনিকায়নের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে বিশ্বের দরবারে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনীতে রূপান্তরিত করার পদক্ষেপও তাঁর সরকার নিয়েছে এবং এতে সফলকাম হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
একদা বঞ্চিত দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে তাঁর সরকারের পদক্ষেপ হিসেবে লেবুখালী সেনানিবাসের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নবগঠিত সেনানিবাসের উন্নয়ন কাজ পরিকল্পতভাবে ও দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। এই অভাবনীয় অগ্রগতি ডিভিশনের প্রতিটি সদস্যের ত্যাগ, কঠোর পরিশ্রম ও আন্তরিক প্রচেষ্টার প্রতিফলন হবে, এটা আমি বিশ্বাস করি।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় সুদূরপ্রসারী নগর পরিকল্পনার আলোকে প্রাকৃতিক শোভাকে নষ্ট না করে পরিবেশবান্ধব সেনানিবাস গঠনের পরিকল্পনার জন্য তিনি সেনাবাহিনী প্রধান ও এই ডিভিশনের জিওসিসহ সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এ এলাকায় সেনানিবাস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী এ সম্পর্কে আরও বলেন, বরিশাল সেনানিবাসের উন্নয়ন এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে নতুন আশা যোগাচ্ছে এবং আপনাদের কাছে তাদের প্রত্যাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতোমধ্যেই রামুতে ১০ পদাতিক ডিভিশন, সিলেটে ১৭ পদাতিক ডিভিশন এবং পদ্মা সেতু প্রকল্পের নিরাপত্তা ও তদারকির জন্য ১টি কম্পোজিট ব্রিগেড প্রতিষ্ঠা করেছি। মিঠামইন এলাকায় একটি সেনানিবাস স্থাপনের কাজ চলছে। তিনি বলেন, এর আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই ২টি পদাতিক ব্রিগেড, স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন ছাড়াও ১০টি ব্যাটালিয়ন, এনডিসি, বিপসট, এএফএমসি, এমআইএসটি, এনসিও’স একাডেমি ও বাংলাদেশ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টাল সেন্টারের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিষ্ঠা করি।
দেশের উন্নয়নে এবং যেকোন দুর্যোগ-দুর্বিপাকে সশস্ত্রবাহিনীর বিশাল ভূমিকার জন্য সেনাবাহিনীর সকল সদস্যের প্রতি প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, বিশেষ করে এই করোনাকালীন আপনারা যেভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের সেবা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সারাবিশ্বে উজ্জ্বল করেছেন। সেই সঙ্গে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও আমাদের সশস্ত্রবাহিনী বিশাল ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা যেখানেই যান সামাজিক কাজ করেন, মানুষের সাহায্য করেন।
দেশের অবকাঠামো উন্নয়নেও সশস্ত্রবাহিনীর বিশাল ভূমিকার স্বীকৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশেষ করে হাওর অঞ্চলে মিঠামইন-ইটনা-অষ্টগ্রামে সড়ক নির্মাণ কাজ থেকে শুরু করে সর্ব কাজে তাঁরা সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। পদ্মা সেতু ও যমুনা বঙ্গবন্ধু সেতু সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাতেও সেনাবাহিনীর বিশাল ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন তিনি। সরকারের সীমিত সম্পদের মধ্যেও সশস্ত্রবাহিনীকে সবধরনের সহযোগিতা করতে সরকার তাঁর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
তিনি বলেন, কুমিল্লা, বগুড়া ও সৈয়দপুর সেনানিবাসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সাভার এবং সিলেট সেনানিবাসে একটি করে বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয়েছে। সিএমএইচসমূহের উন্নয়নের পাশাপাশি পাঁচটি আর্মি মেডিক্যাল কলেজ এবং ৩টি নার্সিং কলেজ স্থাপন করা হয়েছে। রামু ও সিলেট সেনানিবাসে পর্যাপ্ত সুবিধা সংবলিত ২টি সিএমএইচ-এর নির্মাণ কাজ চলছে।
সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সরকারের পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাঁজোয়া এবং আর্টিলারি কোরের জন্য আধুনিক গান ও মিসাইল ক্রয় করা হচ্ছে। পদাতিক বাহিনীর জন্য অত্যাধুনিক ইনফ্যান্ট্রি গেজেট ক্রয় করা হয়েছে। আমাদের মিলিটারি একাডেমির ভিত্তিটা জাতির পিতা করে গিয়েছিলেন, আজকে তা বিশে^ প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটি যে একদিন একটি বিশ^মানের প্রতিষ্ঠানে রূপ নেবে সেটা সে সময়ই জাতির পিতা তাঁর বক্তৃতাতেও আশাবাদ ব্যক্ত করে যান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এর মধ্যে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও করোনাভাইরাসের কারণে সেটা কিছুটা স্থবির হয়ে গেছে। তারপরও আমাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার জন্য আমরা সর্বদা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ! আমরা সফল হব।