কবীর চৌধুরী তন্ময়
শিরোনামের কথাটি আমার ব্যক্তিগত নয় তবে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের এমন ধরনের কথায় কিংবা বাংলাদেশ এগিয়ে চলার পরিসংখ্যানে আমরা বাঙালিরা একদিকে যেমন আবেগে আপ্লুত, অন্যদিকে আরও উদ্যমী হয়ে পড়ি, আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চলার স্বপ্ন বুনি। কারণ, আমাদের অর্জনগুলো ঐতিহাসিক, ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাসও গণশ্রম বা পারিশ্রমিক মনোবলের বৃত্তিতে সৃষ্ট।
বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে কিংবা ভারতকে ছাড়িয়ে যেতে চলেছে- এমন খবর, আলোচনা-সমালোচনা আর ভারতের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, জনপ্রিয় ইউটিউবারদের একান্ত মতামত, পর্যবেক্ষণ এবং সর্বোপরি ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকাগুলোই মূলত আমাদের বেশি করে জানিয়েছে। ভারত অর্থনীতির দিক থেকে বাংলাদেশে পেছনে পরে যাবে-এটি যেমন ভারতকে নীরব কষ্ট দিচ্ছে, আরাব নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কও হচ্ছে। ভারত তার সরকারের কোথায় কী ভুল হয়েছে, কোথায় কী দুর্বলতা বা ঘাটতি রয়েছে কিংবা মোদি সরকার কী কী করেছে- এসব বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ নিয়ে সরব থাকলেও বাংলাদেশ যেন একপ্রকার নিরবতাই পালন করছে। আমাদের টক’শো গুলোতেও খুব বেশি মাতামাতি করতে দেখা যায়নি। সরকারের পক্ষ থেকেও এ নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি।
১৫ অক্টোবর ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয় নিবন্ধের শিরোনাম, ‘ভারত, পূর্বদিকে তাকাও : বাংলাদেশ ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে পেছনে ফেলে দিচ্ছে। আমাদের (ভারতের) জন্যও শিক্ষণীয়।’ আবার (১৪ অক্টোবর) আনন্দবাজার পত্রিকা তাদের শিরোনাম ছিল-‘পড়ছে ভারত! মাথাপিছু উৎপাদনে ‘অচ্ছে দিন’ যাচ্ছে বাংলাদেশে।’ ভারতের মূল গণমাধ্যমের সঙ্গে-সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোকেও বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার খবর নিয়ে ‘বেশ সরব’ হতে দেখা গেছে।
কারণ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত তার ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ নামক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ভারতের মাথা পিছু জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি দাঁড়াবে ১ হাজার ৮ শত ৭৭ ডলার। অন্যদিকে, বাংলাদেশের মাথা পিছু উৎপাদন হবে ১ হাজার ৮ শত ৮৮ ডলার।
আর এ নিয়ে বাংলাদেশে তেমন কোন আলোচনা না হলেও ভারতে বিষয়টি তুমুল আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। রাহুল গান্ধী টুইট করে বিজেপির কড়া সমালোচনা করে বলেছেন, ‘এটাই বিজেপির হিংসাত্মক রাজনৈতিক সংস্কৃতির অর্জন।’ অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান ইকোনমিস্ট অধ্যাপক কৌশিক বসু এই অবস্থায় ভারতকে ‘শক্তিশালী অর্থনৈতিক নীতি’ চালু করার আহ্বানও করেছেন।
দি প্রিন্ট-এর প্রধান সম্পাদক খ্যাতিমান সাংবাদিক শেখর গুপ্ত ১৫ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন- ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’-এর চলতি অর্থবছরের প্রতিবেদন ভারতের অর্থনীতির এ্যাকিলিস হিল বা সবচেয়ে দুর্বল স্থান চিহ্নিত করে দিয়েছে। এ সংস্থার আয়না ভারতের জন্য বড়ই নিষ্ঠুর!’
অন্যদিকে জনপ্রিয় ইউটিউবারদের বিশ্লেষণগুলো বেশ নজর কেড়েছে। অনেকে খুব সুন্দর করে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন, করার চেষ্টা করেছেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জনে সহযোগিতা করেছে-পঞ্চাশ বছর পর এমন সুখের ঢেকুর তোলা বন্ধ করে মোদি সরকার শেখ হাসিনার কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশে দুর্নীতি হচ্ছে, ধর্ষণ হচ্ছে, গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিস্তর কথা শোনা যায়, তারপরও শেখ হাসিনা কী করে মহামারী করোনার প্রাদুর্ভাবেও দেশের অর্থনীতিকে সঠিক পর্যায়ে রেখেছে এবং কী ধরনের নেতৃত্বের কৌশলে আজ ভারতকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে-এগুলো শেখার পরমার্শ দিয়েছেন, বাংলাদেশের দিকে ঘুরে তাকাতে বলেছেন।
আইএমএফ সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২০ সালে এই প্রথম মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতের থেকে ১১ ডলার এগিয়ে যেতে পারে। আইএমএফের এই পূর্বাভাস অনুযায়ী ভারত মাথাপিছু জিডিপির ক্ষেত্রে পাকিস্তান ও নেপালের থেকে সামান্য এগিয়ে থাকবে। সে হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, আফগানিস্তানের আগে চলে আসবে বাংলাদেশ।
আর বাংলাদেশ যে এবারই ভারতকে পেছনে ফেলেছে তা কিন্তু নয়। আর এ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে (১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত স্বাতী নারায়ণের এক প্রতিবেদনকে উল্লেখ করে নরেন্দ্র মোদি সরকারের এক মন্ত্রী বেশ ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘নাগরিকত্ব প্রদান করা হলে বাংলাদেশের অর্ধেক লোক ভারতে চলে আসবে।’ স্বাতী নারায়ণ তখন প্রশ্ন তুলে জিজ্ঞেস করেন- কেন আসবে? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাড়িতে টয়লেট, মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা, স্কুল-কলেজে ছাত্রী ভর্তি, নারীকর্মী, সাক্ষরতার হার- এসব অনেক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে। তারা বিনামূল্যে প্রতিবছর চার কোটির বেশি ছাত্র-ছাত্রীকে পাঠ্যবই দিচ্ছে। বাংলাদেশ কেবল মাথাপিছু জিডিপিতেই ভারতের থেকে সামান্য পিছিয়ে। শেখর গুপ্ত বলেছেন, এখন জিডিপিতেও ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার খবরে অনেকের (স্বাধীনতাকামী মানুষ) ভেতর নীরব উত্তেজনা কাজ করছে- আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কারণ, এক সময় দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষে জর্জরিত যে বাংলাদেশ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করত, সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বজয়ের নবতর অভিযাত্রায় এগিয়ে চলছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্ব, যোগ্যতা, নিষ্ঠা, মেধা-মনন, দক্ষতা, সৃজনশীলতা, উদার গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দূরদর্শী নেতৃত্বে। বিশ্বসভায় আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ, গৌরবময় হয়েছেন বাঙালী যা অর্জনে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন শেখ হাসিনা।
অন্যদিকে ৪ মিলিয়ন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক, শ্রমিক ও দিনমজুরসহ ৫ মিলিয়ন মানুষকে নগদ অর্থ সহায়তা, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গ্রাম পর্যায়ের প্রায় ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র হতে বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ প্রদান, সময় উপযোগী উদ্যোগ শেখ হাসিনার সফল সিদ্ধান্ত। সরকারী সহায়তার পাশাপাশি তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে তহবিল সংগ্রহ করেছেন। এতিম ও গরিব শিক্ষার্থী, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, স্কুল শিক্ষক, শিল্পী, সাংবাদিকসহ যারা সাধারণভাবে সরকারী সহায়তার আওতাভুক্ত নন, তাদের মধ্যে ২.৫ বিলিয়নের বেশি টাকা সুষ্ঠুভাবে বিতরণও করেছেন। সকল আলোচনা আর সমালোচনার মাঝেও একদিকে নাগরিকের জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত করেন, অন্যদিকে অর্থনৈতিক চাকাও সচল রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এদিকে শুধু জিডিপি নয়, ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (১৬ অক্টোবর) হাঙ্গার ইনডেক্স প্রকাশ করেছে, এখানেও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ অপুষ্টির হার কমিয়ে ক্ষুধা মুক্তির লড়াইয়ে অনেক এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫, আর ভারতের অবস্থান ৯৪। পাকিস্তানের ৮৮-এর অবস্থান থেকেও বাংলাদেশ এগিয়ে আছে, যেখানে গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৮।
পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে, বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা, নারীর ক্ষমতায়ন, বিশ্ব সুখ, টিকাদান, শিশুমৃত্যুরোধ ইত্যাদির মতো সমস্ত সূচকে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে। আর ভারত মাত্র দুটি সূচকে এগিয়ে ছিল- ১. মাথাপিছু আয়, ২. মানব উন্নয়ন। এবার মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া অত্যন্ত সম্মানের, গৌরবের।
আর তাই শেখ হাসিনার সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত আর বিচক্ষণ নেতৃত্ব নিয়ে গোটা বিশ্বে বাংলাদেশ আজ রোল মডেল। আর তাই আইএমএফের পূর্বাভাস প্রকাশের পর ভারতের অনেকেই নতুন করে বাংলাদেশের পলিসি থেকে, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশল থেকে ‘ভারত পলিসি নির্ধারণ’ করার আহ্বান করেন। আবার বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা উভয় দেশের জন্যই লাভজনক। আর তাই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিরোধের নানামুখী ইস্যুগুলোকে গুরুত্ব দেয়া, সীমান্ত হত্যা বন্ধসহ আরও ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক তৎপরতায় আন্তরিকতা নিয়ে ভারতকেই এগিয়ে আসতে হবে।
আর বাংলাদেশকে তার সম্ভাবনার সবটুকু কাজে লাগানোর উদ্যমী হয়ে পরিকল্পনা করেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের অর্থনীতিকে আমরা আগামী বছরগুলোতে কোথায় নিয়ে যেতে চাই, অর্থনীতির চাকা কতটা সচল দেখতে চাই- এই লক্ষ্য নির্ধারণ করে আমাদের কর্মপন্থা সাজাতে হবে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে নবতর অভিযাত্রায় এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ- জাতির এই প্রত্যাশা।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)।