কাজিরবাজার ডেস্ক :
কোভিড-১৯ মহামারীর পরিস্থিতিতে নগদ সহায়তা ও প্রণোদনাসহ সঠিক পদক্ষেপের কারণে সরকার অর্থনীতি গতিশীল রাখতে সক্ষম হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশি বেশি গবেষণা পরিচালনা ও গবেষণা প্রকাশের ব্যবস্থা নেয়ার দিকে জোর দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় অর্থ সঙ্কট সমস্যা নয় বলেও উল্লেখ করেছেন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
সভায় এক হাজার ৬৫৯ কোটি ৩৪ লাখ টাকা খরচে চারটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সরকার দেবে ৭৪০ কোটি ১৪ লাখ এবং বিদেশী অনুদান ৯১৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপার্সন শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এসব প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-সচিবরা রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত এনইসি সম্মেলন কক্ষ থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে একনেক সভায় অংশ নেন। সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাসহ প্রকল্প নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে বিস্তারিত তুলে ধরেন।
একনেক সভায় সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা শিল্প ও অন্যান্য খাতে প্রণোদনা প্রদানের পাশাপাশি কৃষিখাতে বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছি। আমরা ক্ষুদ্র, মাঝারি, বড় এবং পোশাক শিল্পে আলাদা করে প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছি। এছাড়া, কোভিড-১৯ মহামারীর পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে সকল খাতে প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তার সরকারের প্রণোদনা প্রদান ‘অত্যন্ত সময়োপযোগী’ হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কত টাকা আছে, কি আছে না আছে, সেটা চিন্তা করিনি বরং একটাই চিন্তা করেছিলাম-এই দুঃসময়ে আমাদের অর্থনীতির চাকাটাকে যদি গতিশীল রাখতে হয় তাহলে অবশ্যই মানুষের হাতে আমাদের টাকা পৌঁছে দিতে হবে।
সরকার প্রধান বলেন, যদি টাকা না থাকে তাহলে সাধারণ মানুষদের জীবনটা চালানোই মুশকিল হয়ে পড়ে। কাজেই তাদের সাহায্যে নগদ অর্থ এবং বিভিন্ন সেক্টরে আমরা সরাসরি যে টাকা পাঠিয়েছি সেটা কিন্তু কাজে লেগেছে। গ্রামে মানুষের কিছু একটা করে খাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেটা তারা করতে পেরেছে। তিনি বলেন, সর্বাগ্রে আমি কৃষির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বলেছি কৃষিকে আমাদের ধরে রাখতে হবে এবং খাদ্য উৎপাদনটা বাড়াতে হবে। মানুষের যেন খাবারের কষ্ট না হয় সেটা আমরা নিশ্চিত করেছি। শেখ হাসিনা বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমরা যে প্রণোদনাটা দিয়েছি সেই প্রণোদনাটা যখনই সকলে নিতে শুরু করেছে তখনই কিন্তু আস্তে আস্তে নিজ নিজ ব্যবসা-বাণিজ্যে তারা ফিরে আসতে পেরেছে। কারণ, আমরা এমন কোন খাত বাদ নাই যাদের সাহায্য করি নাই। শুধু বড়লোক বা বিত্তশালী নয়, সব ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরাই প্রণোদনাটা পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী প্রণোদনা বা নগদ সাহায্য প্রদানের ধরন সম্পর্কে বলেন, নতুন একটা পদ্ধতিতে আপনারা কাজটা করেছেন। কিন্তু রেজাল্ট যেটা দেখলাম সেটা আসলেই গ্রহণযোগ্য। তিনি এ জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, মাঠ পর্যায়ের কর্মী এবং বিবিএসকে ধন্যবাদ জানান। তিনি দেশের এক শ্রেণীর তথাকথিত সমালোচকদের উদ্দেশে বলেন, ‘অনেকেই অনেক কথা বলছেন, আসলে এই রেজাল্টটা প্রচার করলে, না জেনে যারা নানা কথা বলে যাচ্ছেন- এটা হলো না, সেটা হলো না, তারা একটু তথ্য পাবেন। যদিও বলাটাই তাদের একটা অভ্যাস, তারা বলবেই।’ শেখ হাসিনা বলেন, কোন একটা কাজের পর সেটার কি (ফলাফল) হলো, মানুষের কাছে এর কতটুকু (সুফল) পৌঁছল, সেই ফলাফলটা জানা খুব দরকার। তিনি বলেন, এরফলে পরবর্তীতে কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া দরকার এবং কোন কোন জায়গায় আরও গুরুত্ব দিতে হবে বা কোথায় আরও সহযোগিতা পৌঁছাতে হবে সেই কাজটা সঠিকভাবে করার একটা সুযোগ হয়। এটাই সব থেকে বড় কথা।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি বেশি গবেষণা পরিচালনা ও গবেষণা প্রকাশের ব্যবস্থা নেয়ার দিকে জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই থাকে। এগুলো যেন হাটবাজারে পরিণত না হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক গবেষণা হতে হবে। সেসব গবেষণা বেশি বেশি প্রকাশের ব্যবস্থাও নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তার (প্রধানমন্ত্রীর) মন্তব্য ছিল আমরা বিশ্ববিদ্যালয় বানাব। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শহর হয়ে যায় অনেক সময়। হাজার হাজার লাখ লাখ শিক্ষার্থী এক জায়গায় পড়ে। এতে পড়াশোনার মান রক্ষা হয় না এবং পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটা যেন বিশ্ববিদ্যালয় থাকে। সংখ্যাটাকে নিয়ে ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি কাজ করছে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ট্র্যাকিং করা হবে। মাত্রা নির্ধারণ করা হবে। পুনরায় তিনি এ বিষয়টা বলেছেন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাককানইবি) ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের একটি প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাবে অনুমোদন দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতীয় কবির নামে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন করা হয়েছে। তাই এখানকার মানসম্মত শিক্ষার বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশি বেশি গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় অর্থ সঙ্কট সমস্যা নয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, গবেষণা হোক। এজন্য অর্থ কোন সমস্যা নয়। প্রয়োজনে আমি নিজেই টাকার ব্যবস্থা করব। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা, প্রকাশনা হতে হবে। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে, আমরা যতটা আশা করি প্রকাশনা হওয়া উচিত, সেটা পাই না। প্রকাশনা আরও কম হয়। তিনি এ বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এটা বাড়াতে হবে। টাকার কথা প্রায়ই বলা হয়। এটা যথাযথ নয়। প্রায়ই দেখা যায় টাকা থাকে, টাকা ব্যবহার করা হয় না। টাকা যদি চায়, দেব। এ বিষয়ে একটা জেনারেল অর্ডার আছে। প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার বলেছেন, টাকা আমি ব্যবস্থা করে দেব; গবেষণা করেন, কাজ করেন, প্রকাশনা করেন। বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় জার্নাল আছে, সেসব জায়গায় কেন পাবলিশ হবে না?’- যোগ করেন এম এ মান্নান।
ব্রিজ-কালভার্ট প্রকল্পগুলো শীতের মধ্যেই শেষ করতে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী তাগাদা দিয়েছেন বলেও জানান পরিকল্পনামন্ত্রী। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এমনভাবে ব্রিজ-কালভার্ট সংক্রান্ত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে যেন সেটি শীতের মধ্যেই শেষ করা যায়। প্রকল্পগুলো যেন বর্ষাকাল পর্যন্ত না যায়। পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, বিটাকের প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত কার্যক্রম সারাদেশে ছড়িয়ে দিতেও নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে এর কার্যক্রম সম্প্রসারণের মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
বিবিএসের সাম্প্রতিক এক জরিপের তথ্য তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, বেকারত্বের রাশ টেনে ধরতে চায় সরকার। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, সব খাত দ্রুতই আগের অবস্থায় ফিরছে। দেশে প্রায় ১০ গুণ বেড়েছিল এখন আমাদের বেকারের হার ৪ শতাংশ।
একনেকে তিনটি সংশোধিত প্রকল্প এবং একটি নতুন প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন (প্রথম সংশোধন)’ প্রকল্প। সংশোধনীতে প্রকল্পের খরচ বাড়ানো হয়েছে। সময় একই রয়েছে। সংশোধনীতে ৪৯১ কোটি ৩৪ লাখ থেকে খরচ বেড়ে ৮৪০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘চট্টগ্রাম জেলা উপকূলীয় এলাকার পোল্ডার নং-৬২ (পতেঙ্গা), পোল্ডার নং-৬৩/১ বি (আনোয়ারা এবং পটিয়া) পুনর্বাসন’ প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধন আনা হয়েছে। এতে খরচ ও সময় বাড়ছে। ২৮০ কোটি ৩০ লাখ থেকে খরচ বেড়ে প্রথম সংশোধনীতে হয় ৩২০ কোটি ২৯ লাখ এবং এবার সংশোধনের পর আরও বেড়ে দাঁড়াল ৫৭৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের মে মাসে শুরু হওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২০ সালের জুন থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। স্থানীয় সরকার বিভাগের ‘জরুরী ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় মাল্টি-সেক্টর’ প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী আনা হয়েছে। এই প্রকল্পটিরও ব্যয় ও সময়ও বেড়েছে। এক হাজার ৫৭ কোটি ৮৪ লাখ থেকে ব্যয় বেড়ে এক হাজার ৯৮৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০২১ সালের নভেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন হবে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। শিল্প মন্ত্রণালয়ের ‘হাতেকলমে কারিগরি প্রশিক্ষণে নারীদের গুরুত্ব দিয়ে বিটাকের কার্যক্রম সম্প্রসারণপূর্বক আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্যবিমোচন (ফেজ-২)’ নামে একটি নতুন প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এতে খরচ করা হবে ১২৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
একনেক সভায় আরও অংশ নেন কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক; স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম; শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি; শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন; স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন; ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।