ড্রাইভিং লাইসেন্স এর জন্য ২৫ লাখ আবেদন জমে আছে, ভোগান্তি চরমে

19

কাজিরবাজার ডেস্ক :
টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ে রশি টানাটানির কারণে সারাদেশে ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্যক্রম থমকে গেছে। অভিযোগ আছে, একটি কোম্পানিকে কাজ দিতে ইতোমধ্যে কয়েক দফা টেন্ডার পরিবর্তন করা হয়েছে। বিশেষ ব্যবস্থায় কিছু কার্ড ছাপানোর ব্যবস্থা হলেও সার্বিকভাবে বললে থমকে গেছে বিআরটিএ অন্যতম সেবা এই কার্যক্রম। মূলত স্মার্ট কার্ড সঙ্কটের কারণে লাইসেন্স দিতে পারছে না বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। অথচ প্রায় ২৫ লাখ আবেদন ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির কাছে জমা আছে। ফলে গ্রাহক ভোগান্তি বেড়েছে চরমে। বিআরটিএ নিয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা বদনামের মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে কার্ড না থাকা।
অভিযুক্তরা বলছেন, সঙ্কট প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় চলছে। সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরও নির্ধারিত তারিখে স্মার্ট কার্ড নিতে আসলে, দফায় দফায় সময় বাড়ানো হয়। আবার আবেদনের পর কার্ড কিংবা পরীক্ষার জন্য সময় দেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত! ফলে গ্রাহক ভোগান্তির যেন শেষ নেই। শীঘ্রই সঙ্কট সমাধানের কোন পথও দেখছেন না সংশ্লিষ্ট বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
যদিও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ও বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলছেন, সঙ্কট সমাধানের চেষ্টা চলছে। সব মিলিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে বিআরটিএ এখন মহা অশান্তির কারণ। রাজধানীর আশপাশের দুটি বিআরটিএ কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুব বেশি তদ্বির না থাকলে তারা এখন ড্রাইভিং লাইসেন্স করার আবেদন জমা নিচ্ছে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআরটিএ কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আবেদন জমা নিয়ে কি লাভ। জমা নেয়া মানেই লোকজন বার বার জানতে চান কবে লাইসেন্স দেয়া হবে। কার্ড সরবরাহ বাড়লে সবকিছু স্বাভাবিক হবে।
সঙ্কট দেড় বছরের বেশি : লাইসেন্স প্রার্থীরা বলছেন, মূলত দেড় বছর ধরেই বিআরটিএ ডিজিটাল লাইসেন্স কার্ড সঙ্কটের মুখে। লাইসেন্সের জন্য যোগ্য, গড়ে প্রতিদিন এ রকম ৪শ’ ব্যক্তি বিআরটিএর মিরপুর অফিসে ছবি তোলার জন্য গিয়ে থাকেন। মিরপুর ছাড়াও ঢাকার উত্তরা, ইকুরিয়া অফিসেও ভিড় থাকে। ঢাকাসহ সারাদেশে বিআরটিএর ৫৭টি সার্কেল অফিসও রয়েছে। সব অফিসেই সেবাপ্রার্থী সাধারণ মানুষের ভিড় ও ভোগান্তি চলমান লাইসেন্সের জন্য।
জানা গেছে, বিআরটিএতে বর্তমানে প্রায় ২৫ লাখ আবেদন জমা রয়েছে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য। অথচ দিনে গড়ে সরবরাহ করা হচ্ছে একশ’রও কম। গত বছরের নবেম্বর মাসে সারাদেশে কার্ড ডেলিভারির সংখ্যা ১ হাজার ৯৪২টি। ডিসেম্বরে এই সংখ্যা আরও কম। বিআরটিএর সাবেক চেয়ারম্যান ড. কামরুল আহসান বলেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স চাহিদা অনুযায়ী দেয়া যাচ্ছে না; এটা ঠিক। দরপত্র প্রক্রিয়া চলছে অনেকদিন থেকেই। সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ ও তদারকিতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি দূর করাই এখন বিআরটিএ মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
বিআরটিএর সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান খান বলেন, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কার্যকর করার পর সব পক্ষ থেকেই যানবাহনের বৈধ কাগজপত্র করা ও ড্রাইভিং লাইসেন্স করার তাগিদ বেড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় যদি গ্রাহকরা ভোগান্তির শিকার হন তাহলে আইন বাস্তবায়নেও সমস্যা সৃষ্টি হবে।
সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, অনেকেই দিনের পর দিন ঘুরে লাইসেন্স সমস্যার সমাধান পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু কার্ড না থাকলে সমস্যার সমাধান মিলবে কিভাবে।
দরপত্র আহ্বান এবং কার্যাদেশ নিয়ে বিপাকে বিআরটিএ : একাধিক কর্মকর্তা জানান, সারাদেশে এখন ড্রাইভিং লাইসেন্সের ভয়াবহ সঙ্কট চলছে। লাইসেন্স মুদ্রণে দরপত্র আহ্বান এবং কার্যাদেশ প্রদান নিয়ে রশি টানাটানির কারণে বিপাকে পড়েছে বিআরটিএ। মূলত একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার জন্য বারবার টেন্ডার আহ্বান করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। আর একারণেই সঙ্কটের শেকড় অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
বিআরটিএ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১০ জুন লাইসেন্স কার্ডের জন্য প্রথম টেন্ডার আহ্বান করে বিআরটিএ। এতে তিনটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এরপর একই টেন্ডার নোটিসে ২০১৯ সালের ২১ জুলাই, ২৮ জুলাই, আট ও ২৮ আগস্ট চারবার সংশোধনী আনা হয়। এরপর আগের টেন্ডার নোটিস বাতিল করে ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করে বিআরটিএ।
প্রশ্ন হলো টেন্ডার নিয়ে কেন এত জটিলতা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৯ সালে প্রথম আহ্বান করা টেন্ডারে দেশী-বিদেশী বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। কিন্তু মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রাইভেট লিমিটেডকে সুবিধা দিতে টেন্ডার প্রক্রিয়া পিছিয়ে দেয়া হয় এবং স্পেসিফিকেশনে পরিবর্তন আনা হয়। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স সর্বনিম্ন দরদাতা হতে পারেনি। টেন্ডারে অংশ নিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিবেচিত হয় ফ্রান্সের সেপল সিকিউর এবং তার লোকাল এজেন্ট আইবিসিএজ প্রাইমেক্স কোম্পানি।
তাদের টেন্ডার প্রক্রিয়া নস্যাৎ করতে ওঠেপড়ে লাগে মাদ্রাজ। তারা বিআরটিএতে দাখিল করা সেপল সিকিউর-এর টেন্ডারের কাগজপত্র সংগ্রহ করে বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত করে। প্রশ্ন হলো সরকারী প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র কিভাবে মাদ্রাজের হাতে গেল? তারপর মাদ্রাজ লিখিতভাবে সেপলের বিরুদ্ধে বিআরটিএতে কয়েকটি ঠুনকো অনিয়ম তুলে ধরে এর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে লিখিত আবেদন করে। এখানে প্রশ্ন হলো যদি কাগজপত্রে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে তা ধরার দায়িত্ব টেন্ডার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্টদের। বাইরের একটি প্রতিষ্ঠানের ত্রুটি চিহ্নিত করার এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন উঠে।
ত্রুটির বিষয়ে বিআরটিএ আনুষ্ঠানিক সেপলের কাছে জানতে চাইলে কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল করা হয়। এক পর্যায়ে মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের আবেদন আমলে নিয়ে সেপলের বিরুদ্ধে কয়েক দফা তদন্ত হয়। পরিবর্তীতে তা মন্ত্রণালয়ে যাচাই-বাছাই শেষে বিআরটিএ’র নির্দেশে টেন্ডার বাতিল করা হয়। অর্থাৎ সেপলের আবেদন আমলে নেয়া হয়নি। তখন সেপলের পক্ষ থেকে কয়েক দফা চিঠিতে কোন রকম কারণ ছাড়াই কেন টেন্ডার বাতিল করা হলো জানতে চাওয়া হয় দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির কাছে। এক পর্যায়ে বিআরটিএ’র পক্ষ থেকে জানানো হয়, যে কোন প্রয়োজনে টেন্ডার বাতিলের এখতিয়ার বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের রয়েছে। এরপর আবারও একই কাজের টেন্ডার আহ্বান করা হয়। প্রথম বারের চেয়ে কম দর দিয়ে টেন্ডারের জন্য মনোনীত হয় মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স! শুধু তাই নয় প্রতিষ্ঠানটির কাজ নিশ্চিত করা ও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে টেন্ডার নোটিস সংশোধন করে ৩৫ লাখ স্মার্ট কার্ডের স্থলে ৪০ লাখ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।