ফারমার্স ব্যাংকের এক হাজার ৮শ’ কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারি ॥ ১৪ মামলার তদন্ত দু’বছরে শেষ করতে পারে নি দুদক

15

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দুই বছর সময় নিয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত চালিয়েও ফারমার্স ব্যাংকের এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় করা ১৪টি মামলায় অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দাখিল করতে পারেনি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব মামলার তদন্ত শেষ হয়নি এখনও। এ পর্যন্ত দুটি মামলায় চার্জশীট দিলেও সংশ্লিষ্ট আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ
পর্যায়ে ঝুলে রয়েছে। ব্যাংক খাতে বহুল আলোচিত এই দুর্নীতির ঘটনায় ২০১৮ সালে ফারমার্স ব্যাংকের অডিট ও ইসি কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ও তার ছেলে ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডার রাশেদুল হক চিশতীসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা করে দুদক। এরমধ্যে রাশেদ চিশতীর বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় ৫টি মামলা। করোনার এই সময়ে ১১ কার্যদিবসে সবগুলো মামলায় জামিন নিয়েছেন তিনি। অবশ্য জামিন পাওয়া সবগুলো আদেশের বিরুদ্ধেই উচ্চ আদালতে আপীল করেছে দুদক। ইতোমধ্যে দুটি মামলায় জামিন স্থগিতও করেছে হাইকোর্ট। আজ মঙ্গলবার আপীল বিভাগের ভার্চুয়াল চেম্বার আদালতে এ বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। এদিকে ব্যাংকটির নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীসহ তিনজনের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ফ্রিজ (স্থগিত) করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা গেছে, ২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেয়া হয় নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংককে (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক)। অনুমোদন নিয়ে কার্যক্রম শুরুর পরই অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে ব্যাংকটি। আস্থার সঙ্কট তৈরি হলে আমানতকারীদের অর্থ তোলার চাপ বাড়ে। পরিস্থিতির অবনতি হলে ব্যাংকটির অডিট ও ইসি কমিটির চেয়ারম্যানের পদ ছাড়তে বাধ্য হন মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী। পরিচালকের পদ থেকেও পদত্যাগ করেন তিনি। পরে বাবুল চিশতী ও ছেলে রাশেদ চিশতীসহ সংশ্লিষ্ট কয়েক ব্যাংকারের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সব মিলিয়ে ১৬টি মামলা করে দুদক। এ পর্যন্ত দুটি মামলায় চার্জশীট দিলেও সংশ্লিষ্ট আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে ঝুলে রয়েছে। গত দুই বছর সময় নিয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত চালিয়েও ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় করা ১৪টি মামলায় অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দাখিল করতে পারেনি দুদক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকটির জনবল নিয়োগ হয়েছে মূলত মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীর সুপারিশেই। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে তারা নিয়োগ দিয়েছেন। এ ছাড়া মাহবুবুল হক চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আরসিএল প্লাস্টিকের সঙ্গে ব্যাংকের গ্রাহকদের অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্যও বেরিয়ে আসে।
সূত্রমতে, দুদকের মামলায় রাশেদ চিশতী ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল থেকে কারাগারে আটক আছেন। তার বিরুদ্ধে ঢাকায় চারটি এবং টাঙ্গাইলে একটি মামলা রয়েছে। এরমধ্যে গত ১৮ ও ১৯ মে ঢাকার চারটি মামলায় এবং ২৭ মে টাঙ্গাইলের মামলায় জামিন পান তিনি। টাঙ্গাইলের ভার্চুয়াল আদালত দুদকের বক্তব্য না শুনেই রাশেদ চিশতীর জামিন মঞ্জুর করেছে। এর বিরুদ্ধে দুদক হাইকোর্টে রিভিশনও দায়ের করে। গত ২ জুন ওই জামিন বাতিল করে ফের টাঙ্গাইল আদালতে পুনঃ শুনানির নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। এ ছাড়া ঢাকার তিনটি মামলায় হাইকোর্ট রাশেদুল হকের জামিন বহাল রাখলেও তার বিরুদ্ধে আপীল করেছে দুদক। আজ মঙ্গলবার আপীল বিভাগের ভার্চুয়াল চেম্বার আদালতে এ বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসামিরা বিত্তশালী। করোনা পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল আদালতের সীমাবদ্ধতাকে তারা কাজে লাগিয়েছে। দুদকের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে রাশেদুল হকের জামিন বাতিলে সব ধরনের আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
জানতে চাইল দুদকের আইনজীবী মোহাম্মদ খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘ব্যাংক কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা রাশেদ চিশতী তার বিরুদ্ধে থাকা ৫টি মামলাতেই নিম্ন আদালত থেকে জামিন পেয়েছিলেন। ভার্চুয়াল আদালতের ফাঁকফোকরে তার জামিন হয়েছিল। বিশেষ করে টাঙ্গাইলের মামলায় আদালত দুদকের বক্তব্য না শুনেই রাশেদ চিশতীকে জামিন দেয়া হয়েছিল। তবে দুদক থেকে প্রতিটি মামলায় হাইকোর্টে আপীল করা হয়েছে। যারমধ্যে ইতোমধ্যে টাঙ্গাইলে মামলায় তার জামিন স্থগিত করেছে। অপর একটি মামলায় আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম শুরু না হওয়া পর্যন্ত তার জামিন স্থগিত রয়েছে। আর অপর তিনটি মামলায় শর্তসাপেক্ষে জামিন হাইকোর্টে বহাল রাখা হলেও দুদক এরই মধ্যে আপীল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করেছে। ‘আশা করছি দুর্নীতির এত বড় মামলায় আসামিরা কোন অবস্থাতে বের হয়ে যেতে পারবে না। আমরা আইনগতভাবে বিষয়টি মোকাবেলা করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘অর্থপাচার মামলাগুলো এমনিতেই অত্যন্ত সেনসিটিভ। তারমধ্যে ব্যাংক খাতের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত ঘটনা হলো ফারমার্স ব্যাংকের দুর্নীতি। এই ব্যাংকে এতটাই দুর্নীতি হয়েছে যে, গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে সরকারকে ব্যাংকটির নামই পরিবর্তন করতে হয়েছে। যেটি এখন পদ্মা ব্যাংক নামে পরিচিত। শুধু তাই নয় ব্যাংকটিকে সচল রাখতে সরকার পরবর্তীতে বিভিন্ন খাত থেকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে তহবিলেরও জোগান দিয়েছে। আর ব্যাংকের এই দুরবস্থার জন্য যারা দায়ী তারা যদি মামলার এ পর্যায়ে জামিন নিয়ে বের হয়ে যায়, সেটি হবে দুঃখজনক। দুদক এ ক্ষেত্রে বসে থাকতে পারে না।’
দুদক সূত্রে জানা গেছে, বাবুল চিশতী ও রাশেদ চিশতী ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে কৌশলে প্রায় ১৮শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব টাকায় কেনা স্থাবর সম্পদের বাজার মূল্য দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকারও বেশি। আদালতের নির্দেশে এসব সম্পত্তি ইতোমধ্যে জব্দ করা হয়েছে। আসামিরা জামিন পেলে জব্দ করা সম্পত্তি বেহাত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘এ ধরনের রাষ্ট্রীয় আর্থিক ক্ষতির সঙ্গে যারা জড়িত তারা সবসময়ই খুব শক্তিশালী হয়। কারণ তারা বিত্তশালী। করোনা পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল আদালত চালু হওয়ার পরে তারা সেই সুযোগটা নিয়েছে। তবে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষ এ বিষয়ে তৎপর আছে। ইতোমধ্যে দুটি মামলায় রাশেদুল হক চিশতীর জামিন উচ্চ আদালতে স্থগিত হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি সঙ্গে জড়িতরা জামিনে বের হয়ে যেতে নানা রকম চেষ্টা করছে। এজন্য রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদককে সবসময়ই হুঁশিয়ার থাকতে হচ্ছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ফারমার্স ব্যাংকটি কিছু লোক দুর্নীতি করে ডুবিয়েছে। ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে এসব দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা উচিত। রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদককে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করাই তাদের নৈতিক দায়িত্ব। আশা করছি তারা এ বিষয়ে তৎপর থাকবেন।
মাহবুবুল হক চিশতীসহ ৩ জনের ব্যাংক হিসাব স্থগিত : ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) অর্থ আত্মসাতসহ নানা কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ব্যাংকটির নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীসহ তিনজনের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ফ্রিজ (স্থগিত) করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্য দুইজন হলেন- ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম শামীম এবং ব্যাংকের আইটি বিভাগের প্রধান ও ইভিপি মোঃ শাহ আজম। রবিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে তাদের তিনজনের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়। বাবুল চিশতীর তথ্য বিবরণীতে ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে পলাশতলা, নতুনবাজার বকশীগঞ্জ জামালপুর, ২১৪০। এছাড়া অন্য তথ্যের মধ্যে মাহবুবুল হক চিশতীর স্ত্রী রুজী চিশতী, ছেলে মোঃ রাশেদুল হক চিশতী, মেয়ে রিমি চিশতী ও তাই ভাই মোঃ মাজেদুল হক চিশতীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের হিসাবও ফ্রিজ করা হবে।