কাজিরবাজার ডেস্ক :
চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিক, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও কেন্দ্রীয় ১৪ দলের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিম। রাজধানীর সোবহানবাগ জামে মসজিদ এবং বনানী কবরস্থান মসজিদে স্বাস্থ্য বিধি মেনে দু’দফা জানাজা শেষে রবিবার বেলা ১১টায় একাত্তরের এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
অনন্তলোকে গিয়েও প্রমাণ করে গেলেন কত বড় গণমানুষের নেতা ছিলেন শহীদ জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর পুত্র মোহাম্মদ নাসিম। করোনা সংক্রমণরোধে আগে থেকেই জানাজায় এবং দাফনের সময় মানুষকে আসতে বারণ করা হয়েছিল। চারদিকে পুলিশের ব্যারিকেড দিয়েও শোকার্ত মানুষকে থামানো যায়নি। শোকার্ত মানুষের আর্তনাদ ও আহাজারিতে শেষ বিদায়ের শ্রদ্ধায় দেশ যেন সেই স্বীকৃতি দিল তাকে। দেশের বর্ষীয়ান জনপ্রিয় নেতা ছিলেন ঠিকই। কিন্তু দেশের মানুষ যে তাকে হৃদয়ের মনিকোঠায় স্থান দিয়েছিল, কতটা ভালবাসত- করোনার কারণে স্বশরীরে উপস্থিত হতে না পারলেও তা দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের শোকবার্তা, সামাজিক গণমাধ্যমে ব্যাপক ভালবাসার অর্ঘ তারই প্রমাণ দিয়েছে।
প্রথমে সিদ্ধান্ত ছিল বনানী কবরস্থানে মা আমেনা মনসুরের কবরেই দাফন করা হবে তার প্রিয় পুত্র জাতীয় নেতা মোহাম্মদ নাসিমের মরদেহ। কিন্তু ইসলামের শরিয়ত মতে, একই কবরে তিনজনের বেশি দাফন করা যায় না। বড় বড় আলেমদের সঙ্গে আলোচনার পর পরিবারের সদস্যরা নিজেরা বসে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। মোহাম্মদ নাসিমের কবরে পরিবারের অন্য সদস্যরা ভবিষ্যতে যাতে ঠাঁই নিতে পারেন, সেই বিবেচনায় বনানী কবরস্থানের মায়ের কবরের অদূরে ঠিক করা সম্পূর্ণ আলাদা জায়গায় চিরনিন্দ্রায় শায়িত করা হয় রাজনীতির এই উজ্জ্বল নক্ষত্রকে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে মোহাম্মদ নাসিমের বড় ছেলে সাবেক এমপি প্রকৌশলী তানভীর শাকিল জয় বলেন, ‘প্রথমে আমার দাদির (আমেনা মনসুর) কবরের পাশে বাবাকে দাফন করার কথা ছিল। পরে পারিবারিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামকে অনুরোধ করে আলাদা একটা জায়গায় দাফন করেছি। আমার আম্মাসহ পারিবারিকভাবে আমরা চেয়েছি বাকি সবার কবর যেন একসঙ্গে হয়। তাছাড়া বড় বড় আলেম ও হুজুররা বলেছেন, এক কবরের উপর তিন জনের বেশি কবর দেয়া শরিয়তমত ঠিক হবে না। তাই আমার চাচা মারুফ আহমেদের কবরের কাছাকাছি বাবাকে দাফন করা হয়েছে। এ বিষয়টি আমরা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকেও আমরা জানিয়েছি।’ তিনি জানান, ভারতীয় হাইকমিশনারও রবিবার আমাদের পরিবারের কাছে শোকবার্তা পাঠিয়ে আব্বার (মোহাম্মদ নাসিম) মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
বনানীতে দ্বিতীয় জানাজা শেষে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এ সময় বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। পরে জাতীয় ও দলীয় পতাকায় মোড়ানো হয় মোহাম্মদ নাসিমের কফিন। এরপর রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের পক্ষে তার সামরিক সচিব মোহাম্মদ নাসিমের কফিনে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে তার সামরিক সচিবও প্রয়াত জাতীয় এই নেতার কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান।
পরে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের পক্ষ থেকে প্রয়াত এই নেতার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এর আগে সকাল সাড়ে নয়টায় রাজধানীর সোবহানবাগ মসজিদে মোহাম্মদ নাসিমের প্রথম জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর কিছুক্ষণের জন্য মরদেহ তার ধানমন্ডির বাসভবনে নেয়া হয়। বনানীতে জানাযা ও শ্রদ্ধা জানানো শেষে মোহাম্মদ নাসিমের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বনানী কবরস্থানে। সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাকে দাফন করা হয়।
সামাজিক দূরত্ব রক্ষায় জানাযা ও দাফন কাজে পুলিশের ব্যাপক তৎপরতা ছিল। বনানী কবরস্থানেই শায়িত আছেন মোহাম্মদ নাসিমের বাবা শহীদ জাতীয় চার নেতার অন্যতম ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও মাতা আমেনা মনসুর। বনানীতে জানাযায় উপস্থিত ছিলেন মরহুম মোহাম্মদ নাসিমের দুই ছেলে সাবেক এমপি তানভির শাকিল জয় এবং তন্ময় মনসুর। এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, এডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু, এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, মির্জা আজম, এস এম কামাল হোসেন, দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, উপ-দফতর সম্পাদক সায়েম খান, কেন্দ্রীয় ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, জাতীয় পার্টির (জেপি) প্রেসিডিয়াম সদস্য এজাজ আহমেদ মুক্তা, গণআজাদী লীগের সভাপতি এসকে শিকদারসহ ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্র পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
জানাজায় শরিক হন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ, সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ঢাকা সিটি উত্তর সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের পক্ষ থেকেও মোহাম্মদ নাসিমের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। মরহুমের পরিবারের পক্ষে জানাজায় পিতার জন্য দোয়া কামনা করেন মোহাম্মদ নাসিমের বড় ছেলে তানভির শাকিল জয়।
করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় সীমিত পরিসরে মোহাম্মদ নাসিমের জানাজার ব্যবস্থা করে আওয়ামী লীগ। বারবার সবার উদ্দেশে স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। কিন্তু মানুষের অনেক ভিড় ছিল অনেক। করোনা সংক্রমণ রোধে বনানী কবরস্থানে প্রবেশের সব প্রবেশমুখে কড়া ব্যারিকেড বসিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করা হয়, শ্রদ্ধা জানাতে আসা সাধারণ মানুষকে প্রবেশ না করতে বারংবার অনুরোধ করা হয়।
এদিকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের মরদেহে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন করোনা থেকে মুক্ত হওয়া গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। রবিবার সকালে ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে সরাসরি বনানী কবরস্থানে যান ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তার সঙ্গে ছিলেন ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লোট’ কিট প্রকল্পের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডাঃ মুহিব উল্লাহ খোন্দকার এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দফতর প্রধান জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু। প্রয়াত নেতার কফিনের সামনে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধা জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নাসিমকে স্যালুট করেছেন।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক সাংবাদিকদের কাছে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘মোহাম্মদ নাসিম ভাইকে হারিয়ে আওয়ামী লীগ এবং দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হারিয়েছেন একজন বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাকে। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ছিল মোহাম্মদ নাসিম ভাইয়ের।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা, অসম সাহসের অধিকারী, জনবান্ধব আপোসহীন নেতা ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি তিনি ছিলেন অবিচল।’
চট্টগ্রাম থেকে ফিরে সরাসরি বনানী কবরস্থানে গিয়ে মোহাম্মদ নাসিমের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলকে সংহত করতে মোহাম্মদ নাসিমের ভূমিকা ছিল অনন্য। তার মৃত্যু দেশ, রাজনীতি ও একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ব্রেন স্ট্রোক হয়েছিল ৭২ বছর বয়সী মোহাম্মদ নাসিমের। লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় শনিবার বেলা ১১টা ১০ মিনিটে মারা যান তিনি। ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর কারাগারে নিহত জাতীয় চার নেতার একজন এম মনসুর আলীর ছেলে মোহাম্মদ নাসিম সংসদে ষষ্ঠবারের মতো সিরাজগঞ্জ-১ আসনের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। ১৯৮৬ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মোহাম্মদ নাসিম। এরপর ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করার পর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান মোহাম্মদ নাসিম। পরের বছর মার্চে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও তাকে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মোহাম্মদ নাসিম এক সঙ্গে দুই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯৯ সালের ১০ মার্চ পর্যন্ত। পরে মন্ত্রিসভায় রদ বদলে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০১৪ সালে তাকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী করেন শেখ হাসিনা। এবার মন্ত্রিত্ব না পেলেও দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য থাকার পাশাপাশি ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিও ছিলেন তিনি। রাজনীতির পাশাপাশি সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। ঢাকাসহ নিজ এলাকা সিরাজগঞ্জে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। মোহাম্মদ নাসিমের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর উপজেলায় এম মনসুর আলী ও মা মোসাম্মৎ আমেনা মনসুরের ঘরে।