জুমাতুল বিদা

11

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

রমাদান মাসের শেষ জুম্মাকে জুমাতুল বিদা বলা হয় এই কারণে যে, রমাদানের এই জুম্মাতে জুম্মার খুতবায় মাহে রমাদানুল মুবারককে এক বছরের জন্য ‘আল বিদা’ জানানো হয়।
রমাদান মাস বছরের শ্রেষ্ঠ মাস আর জুম্মার দিন সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন। এই দুই শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারীর মিলনের সমাপ্তি দিনে এক করুণ বিরহ-বিচ্ছেদের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মসজিদগুলোতে জুম্মার সালাত আদায়ের জন্য মুসল্লিদের ভিড় জমে এমন করে যে, মসজিদ পেরিয়ে রাস্তার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত তা বিস্তৃত হয়। এ দিনে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়, যেন হৃদয়ের গভীরের আপনজনের বিদায় দিতে সবাই সমবেত হয়েছে। পবিত্রতার সৌরভ মাখা জুম্মার এ দিন সকলের চিত্তে দারুণ শোক-বেদনা সঞ্চারিত হয়। এদিনকার খুতবায় ইমাম সাহেব যে খুতবা দেন তাতে বার বার উচ্চারিত হতে থাকে ‘আল বিদা’ ‘আল বিদা’ ইয়া শাহরা রমাদান-বিদায় হে রমাদান মাস।
রমাদান মাসে সিয়াম পালনের মাধ্যমে সায়িম বা রোজাদার আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি, ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার যে প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ লাভ করে সেই প্রশিক্ষণের সমাপনীর ঘোষণা ঘোষিত হয় জুমাতুল বিদার খুতবায়।
ইমাম সাহেব অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ও দরদমাখা স্বরে খুতবায় বলেন : হে মাহে রমাদান, তোমাকে জানাই বিদায়। তুমি এসেছিলে আমাদের ঘরে ঘরে পবিত্রতার এক অনন্য বিভা নিয়ে। হে ধৈর্যের মাস, তোমাকে বিদায়। এই ধৈর্যের বিনিময় তো জান্নাত। হে কুরআন নাযিলের মাস, তোমাকে সালাম, হে হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেয় লাইলাতুল ক্বদরের মাস, তোমাকে সালাম।
ইমাম সাহেবের খুতবার উচ্চারণ শুনে শুনে মুসল্লিদের অনেকের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়। সিয়াম, ইফতার, সেহরি, তারাবি, ইতিকাফ, লাইলাতুল ক্বদরের এই মুবারক মাসটিকে বিদায় দেয়াটা যেন কঠিন হয়ে পড়ে। বুক ফেটে কান্নার ধারা প্রবাহিত হয়।
ইমাম সাহেব খুতবায় আরও বলেন, হে মাহে রমাদান। তোমাকে জানাই বিদায়, তোমার সঙ্গে আগামী বছর সাক্ষাত হবে কিনা তা জানি না। তোমার সাক্ষাত যে লাভ করে সে তো হয় অধিক সৌভাগ্যের অধিকারী, সে হয় কতই না ভাগ্যবান! হে রহমত বরকত মাগফিরাত ও দোযখের আগুন থেকে মুক্তির মাস তোমাকে সালাম। তুমি যখন আস তখন মসজিদগুলো জেগে ওঠে, আলোয় আলোয় গভীর রাত পর্যন্ত ভরপুর থাকে মসজিদগুলো। তোমার বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে তারাবির সালাতের অবসান ঘটবে। রাতের বাতিগুলো নিভে যাবে। আবার তুমি যখন আগামী বছর ফিরে আসবে, তখন মসজিদগুলো জেগে উঠবে। কিন্তু তখন আমাদের অনেকেই হয়ত থাকবে না। যারা তোমাকে আবার ফিরে পাবে তাদের মতো ভাগ্যবান আর কে আছে!
ইমাম সাহেবের খুতবায় বার বার বিদায় বিদায় শব্দ উচ্চারিত হয়। তিনি বলেন, ‘আল বিদা’ ‘আল বিদা’ হে রমাদান মাস। তোমার বিচ্ছেদ বেদনা দারুণ, দারুণ কষ্টের, অসহনীয় বেদনার।
জুম্মার দিনকে বলা হয়েছে সাইয়েদুল আইয়াম- দিনসমূহের সরদার বা নেতা। একে সাপ্তাহিক ঈদের দিনও বলা হয়েছে। ইয়াওমূল মাজীদ অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি ও মর্যাদাসম্পন্ন দিবস বলতে এই দিবসকেই বোঝানো হয়েছে। অন্যদিকে রমাদান মাসকে মহান প্রাচুর্যের মাস বলা হয়েছে। এই মাসে একটি নফল করলে অন্য মাসের একটি ফরজের সওয়াব লাভ হয়, এই মাসে একটি ফরজ করলে তা অন্য মাসে ৭০টা ফরজ করলে যে সওয়াব তার সমান সওয়াব লাভ হয়, স্বাভাবিকভাবেই রমাদান আর জুম্মার একত্র হবার মধ্য দিয়ে যে অনন্য আনন্দ অনুভব সঞ্চারিত হয় তা শেষ হয়ে যায় রমাদানের শেষ জুম্মায়। জুম্মা প্রতি মাসের প্রতি সপ্তাহে আসবে, মসজিদে মসজিদে মুসল্লিও আসবে, ইমাম সাহেব খুতবাও দেবেন, কিন্তু জুমাতুল বিদার খুতবার মধ্যে যে আকুতি, যে আবেগ, যে অন্তরানুভূতি অনুরণিত হয় তা অন্তরকে নাড়া দেয় এক অন্য রকম আবেদনে।
রমাদানুল মুবারকের বিদায় দেয়ার এই জুম্মায় মু’মিন অন্তরকে যে ভীষণতরো ও গভীরতরো পরিচ্ছন্নতার ছোপ দিয়ে যায় তা ধরে রাখার মধ্যেই সার্থকতার শেষ মনজিল নিহিত রয়েছে। জুমু’আতুল বিদার পর আসে ১ শাওয়াল- ঈদ-উল-ফিতর। এদিন বাকি এগারো মাস সিয়ামের শিক্ষায় বলবত থাকার শপথে বলীয়ান হবার দিন। এই শপথের দৃঢ়তার জন্য যে মনোমঞ্চ গড়ে তোলার প্রয়োজন তা গড়ে তোলার আবেগ সঞ্চার করে দেয় জুমাতুল বিদা।
মাহে রমাদান আর জুম্মা মিলে বিশ্ব মুসলিম মননে পবিত্রতার জোরালো ও মজবুত মাত্রা সংযোজন করে। এই মাত্রা যাতে সারা বছর সমানভাবে অব্যাহত থাকে সেই উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত করে জুমু’আতুল বিদা।
লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ।