জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী ॥ করোনা থেকে মানুষকে রক্ষা করা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ধৈর্য ও সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন

8
জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনা ভাইরাস নিয়ে সংকটময় সময়ে সবাইকে ধৈর্য্য ধরে সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবাইকে যার যার ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি এ সব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে যে কোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকার প্রস্তুত রয়েছে জানিয়ে সংকট মোকাবেলায় তার সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। পাশাপাশি এই সংকটময় সময়ে সবাইকে ধৈর্য্য ধরে সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, এই সংকটময় সময়ে আমাদের সহনশীল এবং সংবেদনশীল হতে হবে। কেউ সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করবেন না। বাজারে কোনো পণ্যের ঘাটতি নেই। দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরের সঙ্গে সরবরাহ চেইন অটুট রয়েছে। অযৌক্তিকভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করবেন না। জনগণের দুর্ভোগ বাড়াবেন না। সর্বত্র বাজার মনিটরিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এ সময় সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিশ্চয়ই বিশ্ববাসী এ দুর্যোগ থেকে দ্রুত পরিত্রাণ পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, যুগে যুগে জাতীয় জীবনে নানা সংকটময় মুহূর্ত আসে। জনগণের সম্মিলিত শক্তির বলেই সে সব দুর্যোগ থেকে মানুষ পরিত্রাণ পেয়েছে। ইতিপূর্বে প্লেগ, গুটি বসস্ত, কলেরার মতো মহামারী মানুষ প্রতিরোধ করেছে।
আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আতঙ্ক মানুষের যৌক্তিক চিন্তা-ভাবনার বিলোপ ঘটায়। সব সময় খেয়াল রাখুন আপনি, আপনার পরিবারের সদস্য এবং আপনার প্রতিবেশীরা যেন সংক্রমিত না হন। আপনার সচেতনতা আপনাকে, আপনার পরিবারকে এবং সর্বোপরি দেশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন।
এ সময় করোনাভাইরাস মোকাবেলায় স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে স্বাস্থ্যকর্মীদেরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে এবং যথেষ্ট পরিমাণ সরঞ্জাম মজুদ আছে। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীরও পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এ ব্যাপারে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না।
করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন সরকারপ্রধান। ভাষণে প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের গৃহিত পদক্ষেপ কথা তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। আমাদের তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। নিম্ন আয়ের ব্যক্তিদের ‘ঘরে-ফেরা’ কর্মসূচির আওতায় নিজ নিজ গ্রামে সহায়তা প্রদান করা হবে। গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য বিনামূল্যে ঘর, ৬ মাসের খাদ্য এবং নগদ অর্থ প্রদান করা হবে। জেলা প্রশাসনকে এ ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ভাষানচরে এক লাখ মানুষের থাকার ও কর্মসংস্থান উপযোগী আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে কেউ যেতে চাইলে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বিনামূল্যে ভিজিডি, ভিজিএফ এবং ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। একইভাবে বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসাসেবাও দেয়া হচ্ছে।
নিম্ন আয়ের মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের শিল্প উৎপাদন এবং রফতানি বাণিজ্যে আঘাত আসতে পারে। এই আঘাত মোকাবেলায় আমরা কিছু আপৎকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য আমি পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করছি। এ তহবিলের অর্থ দ্বারা কেবল শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা যাবে।
তিনি বলেন, আজ সমগ্র বিশ্ব এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে চলছে। তবে যে কোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আমাদের সরকার প্রস্তুত রয়েছে। আমরা জনগণের সরকার। সব সময়ই আমরা জনগণের পাশে আছি। আমি নিজে সর্বক্ষণ পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছি। আমাদের এখন কৃচ্ছতা সাধনের সময়। যতটুকু না হলে নয়, তার অতিরিক্ত কোনো ভোগ্যপণ্য কিনবেন না। মজুদ করবেন না। সীমিত আয়ের মানুষকে কেনার সুযোগ দিন।
পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ বছর রোপা আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারি গুদামগুলোতে ১৭ লাখ মেট্রিক টনের বেশি খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। বেসরকারি মিল মালিকদের কাছে এবং কৃষকদের ঘরে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুদ আছে। চলতি মৌসুমে আলু-পেঁয়াজ-মরিচ-গমের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষক ভাইদের প্রতি অনুরোধ- কোনো জমি ফেলে রাখবেন না। আরও বেশি বেশি ফসল ফলান। দুর্যোগের সময়ই মনুষত্ব্যের পরীক্ষা হয়। এখনই সময় পরস্পরকে সহায়তা করার; মানবতা প্রর্দশনের।
ভাষণে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি ও বিশ্বে এর প্রভাব তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস জনস্বাস্থ্যসহ বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক থাবা বসাতে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা আভাস দিচ্ছেন। আমাদের ওপরও এই আঘাত আসতে পারে। এ সময় প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মানুষকে রক্ষা করাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে উল্লেখ করেন সরকারপ্রধান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে সব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলুন। মাত্র ১৪ দিন আলাদা থাকুন। আপনার পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী, এলাকাবাসী এবং সর্বোপরি দেশের মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য এ সব নির্দেশনা মেনে চলা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, বাঙালি বীরের জাতি। নানা দুর্যোগে-সংকটে বাঙালি জাতি সম্মিলিতভাবে সেগুলো মোকাবেলা করেছে। ১৯৭১ সালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা শত্রুর মোকাবেলা করে বিজয়ী হয়েছি। করোনাভাইরাস মোকাবেলাও একটা যুদ্ধ। এ যুদ্ধে আপনার দায়িত্ব ঘরে থাকা। আমরা সবার প্রচেষ্টায় এ যুদ্ধে জয়ী হব, ইনশাআল্লাহ। আবারও বলছি: স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। সবাই যার যার ঘরে থাকুন, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, নিরাপদ থাকুন। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।