২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত অফিস আদালত বন্ধ, আজ থেকে মাঠে নামছে সেনাবাহিনী ॥ প্রধানমন্ত্রীর দশ নির্দেশনা ॥ জরুরী প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে নয় ॥ জরুরী সেবা অব্যাহত থাকবে ॥ সীমিত আকারে ব্যাংকিং ॥

13

কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে আগামী ২৯ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। এতে ২৬ মার্চসহ আগে ও পরে দুদিন করে সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় মূলত টানা ১০ দিন বন্ধ পাচ্ছেন সরকারী চাকুরেরা। সরকারী এ ঘোষণার মাধ্যমে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল সরকারী অফিস বন্ধ থাকবে। এছাড়া আজ মঙ্গলবার থেকেই সশস্ত্র বাহিনী মাঠে সক্রিয় থাকবে। বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে করোনাভাইরাস বিস্তাররোধের কার্যক্রমে মাঠ পর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসনকে তারা সহায়তা করবে। পাশাপাশি করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয়ভাবে সাধারণ ছুটি ঘোষণাসহ ১০ নির্দেশনা দিয়েছেন। দেশের জনগণের মঙ্গল কামনায় মন্ত্রিপরিষদ, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, স্বাস্থ্য এবং রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞগণের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রীয় এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সোমবার বিকেলে সচিবালয়ে জরুরী সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রীপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এ তথ্য জানান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০ নির্দেশনা পাঠ করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবরা এ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের সরকারী ছুটি এবং ২৭ ও ২৮ মার্চ সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় মূলত ২৬ মার্চ থেকেই সারাদেশের সরকারী অফিসগুলো বন্ধ থাকবে। এছাড়া ৩ ও ৪ এপ্রিল সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় ৫ এপ্রিল থেকে সরকারী অফিসগুলো খোলা থাকবে। সে হিসাবে টানা ১০ দিন বন্ধ থাকবে সরকারী অফিস। গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের উহানে প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাস এখন বৈশ্বিক মহামারী। এতে সারাবিশ্বে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষ। এছাড়া চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন প্রায় ৯৯ হাজার মানুষ।
বাংলাদেশে এ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে গত ৮ মার্চ। এরপর দিন দিন এ ভাইরাসে সংক্রমণের সংখ্যা বেড়েছে। সর্বশেষ হিসাবে দেশে এখন পর্যন্ত ৩৩ ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন তিনজন। সেলফ ও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছেন প্রায় ১৮ হাজার মানুষ। তাদের অধিকাংশই বিদেশফেরত।
করোনার বিস্তাররোধে এরই মধ্যে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে সভা-সমাবেশ ও গণজমায়েতের ওপর। চারটি দেশ ও অঞ্চল ছাড়া সব দেশ থেকেই যাত্রী আসা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
বন্ধ করে দেয়া হয়েছে দেশের সব বিপণিবিতান। এছাড়া মূলতবি করা হয়েছে জামিন ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি ছাড়া নিম্ন আদালতের বিচারিক কাজ। এমনকি মাদারীপুরের শিবচর উপজেলাকে লকডাউনও ঘোষণা করা হয়েছে।
নির্দেশনাগুলো হলো :
১. আগামী ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি রয়েছে। এরপর ২৭ ও ২৮ মার্চ সরকারী সাপ্তাহিক ছুটি আছে। ২৯ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত পরবর্তী পাঁচ দিন পর্যন্ত সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। এছাড়া ৩ ও ৪ এপ্রিলের সাপ্তাহিক ছুটি সাধারণ ছুটির সঙ্গে যোগ হবে। অর্থাৎ ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারী-বেসরকারী সব প্রতিষ্ঠান ছুটির আওতায় থাকবে। তবে কাঁচাবাজার, খাবার, ওষুধের দোকান, হাসপাতালসহ জরুরী যেসব সেবা রয়েছে তার জন্য এসব প্রযোজ্য হবে না। করোনাভাইরাস বিস্তৃতি রোধে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ কারণে জনসাধারণকে জরুরী প্রয়োজন ছাড়া (খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ ক্রয় ও চিকিৎসা গ্রহণ ইত্যাদি) কোনভাবেই ঘরের বাইরে না আসার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ইতোপূর্বে স্কুল ছুটি ঘোষণার পর দেখা গেছে অনেকেই দেশের বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে গিয়েছেন। সাধারণ ছুটি মানে সরাসরি আইসোলেশন না হলেও নিজেকে পৃথক রেখে অন্যকে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা।
২. এ সময়ে যদি কোন অফিস-আদালতে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করতে হয় তাহলে তাদের অনলাইনে সম্পাদন করতে হবে। সরকারী অফিস সময়ের মধ্যে যারা প্রয়োজন মনে করবে তারাই শুধু অফিস খোলা রাখবে।
৩. গণপরিবহন চলাচল সীমিত থাকবে। জনসাধারণকে যথাসম্ভব গণপরিবহন পরিহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। যারা জরুরী প্রয়োজনে গণপরিবহন ব্যবহার করবে তাদের অবশ্যই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়া থেকে মুক্ত থাকতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেই গণপরিবহন ব্যবহার করতে হবে। গাড়িচালক ও সহকারীদের অবশ্যই গ্লাভস এবং মাস্ক পরাসহ পর্যাপ্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৪. জনগণের প্রয়োজন বিবেচনায় ছুটিকালীন সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সীমিত আকারে ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু রাখার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে।
৫. ২৪ মার্চ থেকে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণ ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুবিধার্থে সশস্ত্র বাহিনী জেলা প্রশাসনকে সহায়তায় নিয়োজিত থাকবে। দেশের ৬৪ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাদের স্ব স্ব জেলার প্রয়োজন অনুযায়ী সশস্ত্র বাহিনীর জেলা কমান্ডারকে রিকুইজিশন দেবেন।
৬. করোনা ভাইরাসের কারণে কোন ব্যক্তি যদি স্বাভাবিক জীবনযাপনে অক্ষম হয় তাহলে সরকারের যে ঘরে ফেরার কর্মসূচী রয়েছে, সে কর্মসূচীর মাধ্যমে তারা নিজ নিজ গ্রামে ফিরে গিয়ে আয় বৃদ্ধির সুযোগ পাবে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকরা প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবেন।
৭. ভাসানচরে ১ লাখ লোকের আবাসন ও জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে সরকার। এ সময় যদি দরিদ্র কোন ব্যক্তি ভাসানচরে যেতে চান তাহলে তারা যেতে পারবেন। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকরা প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবেন।
৮. করোনাভাইরাসজনিত কার্যক্রম বাস্তবায়নের কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় অন্ন সংস্থানের অসুবিধা নিরসনের জন্য জেলা প্রশাসকদের খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে এ সহায়তা প্রদান করা হবে।
৯. প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য ৫০০ জন চিকিৎসকের তালিকা তৈরি ও তাদের প্রস্তুত রাখবে।
১০. সব ধরনের সামাজিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সমাগম সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিশেষ করে অসুস্থ জ্বর সর্দি কাশিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মসজিদে না যাওয়ার জন্য বারবার নিষেধ করা হয়েছে। তারপরও সম্প্রতি মিরপুরে একজন বৃদ্ধ অসুস্থ অবস্থায় মসজিদে যান। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ওই ব্যক্তি পরে মৃত্যুবরণ করেন। তাই ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের প্রতি অসুস্থ অবস্থায় মসজিদে নামাজ আদায় করতে না যাওয়ার অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।
এদিকে রবিবার করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও এর প্রাদুর্ভাবজনিত যে কোন জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সব স্তরের সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সার্বক্ষণিক কর্মস্থলে থাকার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক পত্রে এ নির্দেশনা দেয়া হয়।
এতে বলা হয়, করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রতিরোধ ও এর প্রাদুর্ভাবজনিত যে কোন জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বিভাগ/জেলা/উপজেলা পর্যায়ের সব সরকারী দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সার্বক্ষণিক কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিতকরণের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
সরকারী এই সিদ্ধান্তের পরও অনেক কর্মকর্তাকে সোমবার কর্মস্থালে অনুপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। প্রশাসনের প্রাণ কেন্দ্র সচিবালয়ও ছিল ফাঁকা। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী অনুপস্থিত থাকলেও কেউ এ নিয়ে কিছু বলছেন না। এমনকি কোন কোন সচিবকে দেখা গেছে কর্মস্থলে উপস্থিত না হয়ে বাসায় বসে একের পর এক ফাইল দেখছেন এবং প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। সচিবালয়ের উপস্থিতি একেবারেই কমে গেছে। নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারী যারা সোমবার সচিবালয়ে এসেছেন তাদের অনেকেই বলছেন সরকারের উচিত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা। এভাবে চলতে থাকলে অনেকেই অফিসে আসবেন না বলেও তারা জানান। এরই কিছুক্ষণ পর সরকার পাঁচদিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করল। সরকারের এই পাঁচ দিন ছুটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মূলত ১০ দিনের ছুটি কাটানোর সুযোগ পাবেন।