কাজিরবাজার ডেস্ক :
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী- মুজিববর্ষ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পিতা বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলেছেন, পিতা, তোমার কাছে আমাদের অঙ্গীকার, তোমার স্বপ্নের সোনার বাংলা আমরা গড়বই। আর সেদিন বেশি দূরে নয়। আজ জেগে উঠেছে বাংলাদেশের মানুষ সত্যের অন্বেষণে। ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না। আজ শুধু বাংলাদেশ নয়, তোমার (বঙ্গবন্ধু) জন্মবার্ষিকী পালিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশকে বিশ্ব চিনে নিয়েছে তোমার ত্যাগের মহিমায়।
মঙ্গলবার রাতে মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন। ভাষণটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে নির্মিত ‘মুক্তির মহানায়ক’ অনুষ্ঠানে সম্প্রচার করা হয়।
দেশবাসী, প্রবাসী বাংলাদেশী এবং বিশ্ববাসীকে মুজিববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমার নিজের এবং ছোটবোন শেখ রেহানার পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি বাংলাদেশের সকল বয়সের এবং শ্রেণী-পেশার মানুষকে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসজনিত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হয়েছে। তবে বছরব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমরা মুজিববর্ষ উদযাপন করব। একই কারণে বিদেশী অতিথিবৃন্দের সফর স্থগিত করা হয়েছে।
ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নমগেয়েল ওয়াংচুক, নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভা-ারি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং ওআইসি’র মহাসচিব ড. ইউসুফ আল ওথাইমিনসহ বেশ কয়েকজন বিদেশী শুভাকাক্সক্ষী ভিডিও বার্তার মাধ্যমে শুভেচ্ছা পাঠানোয় তার ব্যক্তিগত এবং বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে তাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান প্রধানমন্ত্রী।
মুজিববর্ষের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ছাড়াও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনে সকালে ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে রক্ষিত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে এবং টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টুঙ্গিপাড়ায় রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ও জাতির পক্ষ থেকে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর জন্মক্ষণ রাত আটটায় ঢাকাসহ সারাদেশে একযোগে আতশবাজি প্রদর্শন এবং ফানুস ওড়ানো হয়। জাতীয় সংসদ ভবনে বর্ণাঢ্য লেজার শো’র মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ প্রচারসহ নানা অনুষ্ঠান প্রদর্শন করা হয়। সরকারী ও বেসরকারী সকল টেলিভিশনে মুজিববর্ষের এসব অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে আরও বলেন, ১৭ মার্চ। ১৯২০ সালের আজকের দিনে এই বাংলায় জন্ম নিয়েছিলেন এক মহাপুরুষ। তিনি আমার পিতা, শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ নামের এই দেশটি তিনি উপহার দিয়েছেন। দিয়েছেন বাঙালীকে একটি জাতি হিসেবে আত্মপরিচয়ের মর্যাদা। তাইতো তিনি আমাদের জাতির পিতা। তিনি বলেন, দুঃখী মানুষকে ক্ষুধা-দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে নিজের জীবনের সব সুখ-আরাম বিসর্জন দিয়ে বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেছেন আজীবন। বারবার কারারুদ্ধ হয়েছেন। মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাকে ব্যথিত করতো। অধিকারহারা দুঃখী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যেকোন ত্যাগ স্বীকারে তিনি দ্বিধা করেননি। এই বঙ্গভূমির বঙ্গ-সন্তানদের একান্ত আপনজন হয়ে উঠেছিলেন – তাই তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’।
শেখ হাসিনা বলেন, (মঙ্গলবার) থেকে শুরু হয়ে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত মুজিববর্ষ উদ্যাপন করা হবে। ২০২১ সালে উদযাপিত হবে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিভিন্ন বন্ধুপ্রতিম দেশ, ইউনেসকো, ওআইসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মুজিববর্ষ উদযাপনে অংশীদার হয়েছে। সকলকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আর অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি। আমরা মুজিববর্ষ পালনের সুযোগ পেয়েছি। এ যে আমাদের জীবনে কত বড় পাওয়া, তা ভাষায় বোঝাতে পারব না। আমি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই দেশবাসীর প্রতি- যারা আমার দল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে, পরপর তিনবার সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে মুজিববর্ষ উদ্যাপনের সুযোগ করে দিয়েছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরে তারই কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ছোটবেলা থেকেই মানুষের দুঃখ-কষ্টে ব্যথিত হতেন জাতির পিতা। অকাতরে বিলিয়ে দিতেন তার জামাকাপড়, বই, ছাতা। যার যখন যা প্রয়োজন মনে করতেন, তাকে নিজের জিনিস দিয়ে দিতেন। নিজের খাবারও তিনি ভাগ করে খেতেন। দুর্ভিক্ষের সময় গোলার ধান বিলিয়ে দিতেন। মানুষের জন্য কিছু করতে পারার মধ্যেই তিনি আনন্দ পেতেন। আর বঙ্গবন্ধুর নিজের জীবনের কোন চাওয়া পাওয়া ছিল না। বাংলাদেশের মানুষকে উন্নত, সুন্দর জীবন নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। তার সে ত্যাগ বৃথা যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন। আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে। গড়তে হবে জাতির পিতার ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। আজকের শিশু-কিশোর, তরুণ সমাজের কাছে আমার আবেদন- তোমরা দেশকে এবং দেশের মানুষকে ভালবাসবে। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে চলার উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে তোমাদের নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। ঠিক যেভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের মানুষকে ভালবেসেছিলেন, সেভাবেই ভালবাসতে হবে। তার আদর্শে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে।
পিতা বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, ‘পিতা, ঘাতকের নির্মম বুলেট কেড়ে নিয়েছে তোমাকে। তোমার দেহ রক্তাক্ত করেছে। তোমার নাম বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু ওরা পারেনি। ঘাতকেরা বুঝতে পারেনি তোমার রক্ত ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে-বেয়ে ছড়িয়ে গেছে সারা বাংলাদেশে। জন্ম দিয়েছে কোটি কোটি মুজিবের। তাই আজ জেগে উঠেছে বাংলাদেশের মানুষ সত্যের অন্বেষণে। ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না। আজ শুধু বাংলাদেশ নয় তোমার জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশকে বিশ্ব চিনে নিয়েছে তোমার ত্যাগের মহিমায়।’
জাতির পিতাকে উদ্দেশ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আরও বলেন- ‘পিতা, তোমার কাছে আমাদের অঙ্গীকার, তোমার স্বপ্নের সোনার বাংলা আমরা গড়বই। আর সেদিন বেশি দূরে নয়। তুমি ঘুমিয়ে আছ টুঙ্গিপাড়ার সবুজ ছায়াঘেরা মাটিতে পিতা-মাতার কোলের কাছে। তুমি ঘুমাও পিতা শান্তিতে। তোমার বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। আমরা জেগে রইব তোমার আদর্শ বুকে নিয়ে। জেগে থাকবে এদেশের মানুষ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম- তোমার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে। তোমার দেয়া পতাকা সমুন্নত থাকবে চিরদিন। কবিগুরুর ভাষায় তাই বলতে চাই-তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি। তোমার সেবার মহৎ প্রয়াস সহিবারে দাও ভকতি।’ তিনি জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষ উদ্যাপনে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।