কাজিরবাজার ডেস্ক :
উন্নত রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দলিল ‘রূপকল্প ২০৪১’ চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে। ২০ বছর মেয়াদি দেশের দ্বিতীয় রূপকল্পের প্রেক্ষিত পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নত রাষ্ট্রে পৌঁছে যাবে বাংলাদেশ। একটি উন্নত রাষ্ট্র হওয়ার মাধ্যমে গোটা জাতি উন্নত হবে যা সবার একটি স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্নের ধাপগুলোর বাস্তবায়নের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয় দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ এর অনুমোদনের মাধ্যমে। এই পরিকল্পনাকে ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার’ অংশ হিসেবে সম্মানের মনে করছেন দেশের অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদসহ বিশিষ্টজনরা। এছাড়াও সোনাদিয়া দ্বীপে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলাসহ কক্সবাজার বিমানবন্দরকে বড় করে গড়ে তোলার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী ও এনইসি চেয়ারপার্সন শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় (এনইসি) এটি চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে এ পরিকল্পনাটি তৈরি করেছে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ গত এক দশকে নি¤œ আয়ের দেশ থেকে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। ইতোমধ্যেই প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হবার সকল শর্ত পূরণ করেছে। সরকার রূপকল্প ২০২১ এবং রূপকল্প ২০৪১ ঘোষণা করেছিলেন। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১ এর সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১ গ্রহণ করা হয়। যে পরিকল্পনায় ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়াবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারের বেশি। ওই সময়ে হতদরিদ্রের হার কমে শূন্যের ঘরে নেমে আসবে। আর মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। তাই নয়, তখন মানুষের গড় আয়ু ৮০ বছরে উন্নীত করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ ও উচ্চ আয়ের দেশগুলো যে উন্নয়ন পথ পাড়ি দিয়েছে তাদের ইতিবাচক অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে সে পথে এগিয়ে যেতে চায় বাংলাদেশ।
চার ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে ২০ বছর মেয়াদি উন্নত রাষ্ট্র গড়ার পরিকল্পনার নানা বিষয় উপস্থাপন করা হয়। এনইসি বৈঠক শেষে দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা নিয়ে ব্রিফ করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। এ সময় দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা তৈরির নেতৃত্ব দেয়া সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম, পরিকল্পনা সচিব মো. নূরুল আমিন, ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য শামীমা নার্গীস এবং পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সদস্য সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, নানা স্বপ্ন সামনে রেখে প্রেক্ষিত পরিকল্পনার খসড়া অনুমোদন পেয়েছে। ২২৯ পাতার এই পরিকল্পনায় উন্নয়নের একটা আলোর ছাপ দেখা গেছে। এ অনুযায়ী কাজ করে উন্নত বাংলাদেশ গড়ব আমরা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ব্রিফিংয়ে জানান, উন্নত দেশে উন্নীত হতে এ পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করা হবে। তাছাড়া প্রেক্ষিত পরিকল্পনাটি তৈরির ক্ষেত্রে বেশির ভাগ পুরনো সালের তথ্য ধরা হয়েছে। সেটি আপডেট করতে হবে। যতোটা সম্ভব ২০১৯ সাল পর্যন্ত নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। পরিকল্পনাটির শুরুতেই একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যুক্ত করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়াতে হবে। বয়স্ক ও ডিভোর্সি নারীদের বেশি করে ভাতার আওতায় আনতে হবে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে বলেও পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এক প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, যে কোন পরিকল্পনাই হোক না কেন তা নিজস্ব সম্পদের উপরই নির্ভর করতে হবে। আগে বৈদেশিক সহায়তা নির্ভর ছিল আমাদের অর্থনীতি। এখন অনেক অগ্রগতি হওয়ায় সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. অধ্যাপক আবুল বারকাত জনকণ্ঠকে বলেন, উন্নত রাষ্ট্রের পরিকল্পনা চূড়ান্ত অর্থাৎ ২০৪১ সাল নাগাত এটি হবে। যেসব অর্থনীতির মাপকাঠিতে আমরা মেপে থাকি মানে বিবেচনায় নেই জিডিপি, শিক্ষার হার, মাথাপিছু আয় ইত্যাদি ইত্যাদি মাপকাঠিতে মাপা হয় তাতে এটি সম্ভব।
প্রতিবেদন তৈরির নেতৃত্ব দেয়া জিইডির সদস্য (সিনিয়র সচিব) শামসুল আলম বলেন, এটি আমাদের কাছে একটি স্বপ্ন দলিল। নতুন এই প্রেক্ষিত পরিকল্পনাটি চারটি প্রাতিষ্ঠানিক স্তম্ভের ওপর নির্ভরশীল। সেগুলো হচ্ছে সুশাসন, গণতন্ত্রায়ণ, বিকেন্দ্রীকরণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি। এটি হলো মোটাদাগে বাংলাদেশের উন্নয়নের পথচিহ্ন। কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সেই কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হবে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চারটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করতে হবে। ড. শামসুল আলম তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের বরাত দিয়ে বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্লক চেইন, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, আইওটি ইত্যাদি বিষয় যুক্ত করতে হবে। এছাড়া, বৈঠকের আলোচনায় এসেছে খরা ও লবণাক্ত সহিষ্ণু জাতের ফসল আবিষ্কার বাড়াতে হবে। মাটি ছাড়া ভাসমান চাষ পদ্ধতির ব্যাপক প্রসার ঘটানোর কথাও।
সোনাদিয়া দ্বীপ নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়। অপরূপ সৌন্দর্যের আধার কক্সবাজারের মহেশখালীর ওসানাদিয়া। এ উপদ্বীপে প্রধানমন্ত্রী পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন। সেখানে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের বিষয়টি দীর্ঘদিন বিবেচনাধীন। এটি আরও পর্যালোচনা করতে হবে। অন্য কোথায় গভীর সমুদ্রবন্দর করা যায় কিনা সেটাও ভাবা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, সেখানে সমুদ্রবন্দর থেকে সরে আসবÑ বিষয়টা এরকম না। এখানে আলোচনা হয়েছে যে, সোনাদিয়া সুন্দর জায়গা। এর বৈচিত্র্য রক্ষা করা হোক। গভীর সমুদ্রবন্দর হবে নাকি অগভীর হবে, না পর্যটন হবে উই উইল ডিসাইড ইন ফিউচার (ভবিষ্যতে আমরা সিদ্ধান্ত নেব)। মূল কথা হলো, সোনাদিয়াকে অক্ষত রাখা হবে।
প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ তুলে ধরে জিইডি সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে বড় করে তুলতে হবে। এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর হবে। কারণ এটা আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের রুটের মধ্যে। আর সোনাদিয়া দ্বীপে জীববৈচিত্র্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সেজন্য গভীর সমুদ্রবন্দর করলে সেটি বাধাগ্রস্ত হতে পারে; বাস্তুুতন্ত্রে, ইকোলজিতে। তাই সেখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে,
এদিকে, প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে বৈষম্য হ্রাস, ধারাবাহিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন, দারিদ্র্য নিরসন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রফতানি বহুমুখীকরণ, গ্রামীণ উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য টেকসই কৃষি, বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা, লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা, পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা, টেকসই বিদ্যুত ও জ্বালানি, টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাপনা এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রস্তুতি থাকছে। পরিকল্পনায় আরও যেসব বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার, জ্বালানি খাতের উন্নয়ন, যোগাযোগ খাতের বিশেষ উন্নয়ন, তথ্য ও প্রযুক্তি থাতের উন্নয়ন, স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণসহ বিভিন্ন বিষয়। অর্থাৎ একটি দেশ উন্নত দেশে পরিণত হতে হলে যা যা প্রয়োজন তার প্রায় সব কিছুই পরিকল্পনাটিতে আনা হয়েছে।
দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০ বছর পর বার্ষিক মাথাপিছু আয় হবে ১২ হাজার ৫০০ ডলার ছাড়িয়ে যাবে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে ১০ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা প্রায়। বর্তমানে দেশের মানুষের বার্ষিক মাথাপিছু আয় (২০১৮-২০১৯ অর্থবছর) এক হাজার ৯০৯ ডলার। যা এক ডলার সমান ৮৫ টাকা ধরে বাংলাদেশী মুদ্রায় এক লাখ ৬২ হাজার ২৬৫ টাকা। তবে ২০ বছর পরে এই আয় বেশ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। এছাড়া পরিকল্পনায় ২০ বছর পর মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেড়ে ৮০ বছরে দাঁড়াবে বলে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। অবশ্য ২০১৮ সালের হিসেবে বর্তমানে মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৩ বছর। যা আবার ২০৩১ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। শিশুমৃত্যুর হার (১ হাজার জীবিত জন্মে) ২৪ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। এ ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে হতদরিদ্র নির্মূল হবে (৩ শতাংশে নামলে নির্মূল বলা হয়)। আর ২০৪১ সালে হতদরিদ্রের হার কমে দশমিক ৬৮ শতাংশ হবে, যা বর্তমানে ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ২০৪১ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। এই হার বর্তমানে ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ। বর্তমানে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির ৩২ দশমিক ৭৬ শতাংশ, যা ২০৩০ সালে বেড়ে দাঁড়াবে জিডিপির ৪০ দশমিক ৬০ শতাংশ। আর ২০৪১ সালে মোট বিনিয়োগ দাঁড়াবে ৪৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। অন্যদিকে বর্তমানে মোট রাজস্বের পরিমাণ জিডিপির ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ। সেটি ২০৩০ সালে বেড়ে ১৯ দশমিক ০৬ শতাংশ হবে। আর ২০৪১ সালে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ দাঁড়াবে জিডিপির ২৪ দশমিক ১৫ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী দিনে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে পরিণত করতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করাই হবে চ্যালেঞ্জ। এ জন্য অতিরিক্ত তহবিলের প্রয়োজন হবে, যা দরিদ্র মানুষের কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করাসহ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও মানসম্মত শিক্ষার মতো সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনী নিশ্চিত করবে। দারিদ্র্য নিরসনে মানব উন্নয়নের জন্য সাক্ষরতার হার শতভাগ, ১২ বছর পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা এবং সাশ্রয়ী মূল্য চিকিৎসাসুবিধা ও স্বাস্থ্যবীমা স্কিম নিশ্চিত করতে কর্মসূচী নেওয়া হবে।