কাজিরবাজার ডেস্ক :
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ পণ্য নৌপথে পরিবহন হয়। এক্ষেত্রে বিশ্বের দশটি ব্যস্ততম সমুদ্রবন্দরের সাতটিই রয়েছে চীনে। তার কাছাকাছি সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়াতেও একটি করে বড় বন্দর আছে। চীনে প্রাণঘাতী নতুন ধরনের করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এসব সমুদ্রবন্দরে পণ্যবাহী জাহাজের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে বিশ্বের বড় বড় শিপিং কোম্পানি। ফলে বৈশ্বিক পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়ে পড়েছে। করোনা ভাইরাস ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরও। ইতোমধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ এই ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে নানা ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। শুধু জাহাজে পণ্য পরিবহনই নয়, আকাশপথে পণ্য পরিবহনও ব্যাহত হয়েছে। এদিকে চীন থেকে আমদানিকৃত চার মসলা জাতীয় ভোগ্যপণ্য পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও দারুচিনি নিয়ে নতুন সঙ্কট তৈরি হয়েছে দেশের বাজারে। আমদানি হ্রাস পাওয়ায় বাংলাদেশের বাজারে দাম বাড়তে শুরু করেছে এসব পণ্যের। তবে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি থাকলে চীন থেকে ভোগ্যপণ্য আমদানি সাময়িক স্থগিত করা হতে পারে বলে জানা গেছে। এই ভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী হলে চীনের সঙ্গে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ পরিস্থিতিতে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের বিষয়টি বাংলাদেশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
চীন থেকে বিশ্বজুড়ে পণ্য বহনকারী শিপিং সংস্থাগুলোকে উদ্ধৃত করে বৃহস্পতিবার বার্তা সংস্থা সিএনএন জানিয়েছে, ধমনীর মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে গেলে মানুষের যে অবস্থা হয় নভেল করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্ব বাণিজ্যেও সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। করোনা ভাইরাস ছড়ানো রোধে তারা নৌযান চলাচল কমিয়ে দেয়ায় বাজারে তাদের পরিষেবার চাহিদা কমে গেছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বলে শিপিং কোম্পানিগুলোর আশঙ্কা। আন্তর্জাতিক শিপিং এ্যাসোসিয়েশন বিআইএমকোর প্রধান বিশ্লেষক পিটার স্যান্ড বলেন, বিশ্ব বাণিজ্যের সংযোগস্থল চীনের বন্দরগুলোর কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হওয়ায় শিপিং ইন্ডাস্ট্রি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ আন্তঃএশীয় ও বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় চীন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে অনেক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কন্টেনার বোঝাই পণ্য পরিবহনের চাহিদা সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে।
গাড়ি, যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে পোশাকসহ অন্যান্য ভোক্তাপণ্য পর্যন্ত সব কিছুই কন্টেনারে পরিবহন করা হয়। কন্টেনার শিপিং বিপর্যস্ত হলে এর প্রভাব চীন ছাড়িয়ে বহু দূর গড়াবে। কারণ দেশটি কারখানা বন্ধ রেখে, শ্রমিকদের আবদ্ধ করে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলার চেষ্টা করছে।
এই স্বাস্থ্য সঙ্কট যত দিন স্থায়ী হবে, বিশ্বজুড়ে পণ্য পরিবহন তত বেশি কঠিন হয়ে পড়বে। করোনা ভাইরাসে ৫৬০ জনের বেশি মারা গেছেন, কমপক্ষে ২৮ হাজার সংক্রমিত হয়েছেন, যা মূলত চীনেই ছড়িয়েছে, সেখানকার শহরগুলোতে প্রায় ছয় কোটি মানুষ অবরুদ্ধ হয়ে আছে। গাড়ি নির্মাতা হুন্দাই এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। করোনা ভাইরাসের কারণে চীন থেকে যন্ত্রপাতি সরবরাহে বিপর্যয় উৎপাদন স্থগিতে বাধ্য করেছে বলে সংস্থাটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
নৌপথে পণ্য পরিবহনকারী আন্তর্জাতিক সমিতির মহাসচিব গাই প্লাটেন বলেন, পণ্য ওঠা-নামা কমে যাওয়ায় কিছু পণ্যবাহী জাহাজ চীনের বন্দরে ঢুকতে পারছে না। অনেক জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত কাজের জন্য শ্রমিকদের অপেক্ষায় ডকে আটকে আছে। আরও অনেক জাহাজ সাগরে ‘ভাসমান কোয়ারেন্টাইন এলাকায়’ অলস দাঁড়িয়ে আছে। কারণ চীনা বন্দরে ভেড়া এসব জাহাজের ক্রুদের ভাইরাসমুক্ত ঘোষণা না করা পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো তাদের নিজেদের বন্দরে ঢুকতে দিচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে জাহাজ সাগরে অলস পড়ে থাকায় খাদ্য সঙ্কটে পড়েছেন এমন একজন ক্রুর খবর প্ল্যাটেন নিজেই দিয়েছেন।
মার্স্ক, এমএসসি মেডিটেরানিয়ান শিপিং, হাপাগ-লয়েড ও সিএমএ-সিজিএমের মতো বড় বড় শিপিং কোম্পানিগুলো বলছে, চীন ও হংকং হয়ে ভারত, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম আফ্রিকার পথে চলাচলকারী নৌযানের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। এসব জাহাজ মালিকরা বলছেন, চীনে বার্ষিক ছুটির মৌসুমে এমনিতেই পণ্য পরিবহনের চাহিদা কমে যায়। তার মধ্যে করোনা ভাইরাসের কারণে চীনা কারখানাগুলোকে অলস রাখায় জাহাজের চাহিদা কমে গেছে। একারণে তারাও জাহাজ চলাচল কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।
প্রায় দুই হাজার জাহাজ মালিক, অপারেটর, ম্যানেজার, দালাল ও এজেন্ট নিয়ে গঠিত বিআইএমকোর সদস্যদের দেয়া তথ্য উদ্ধৃত করে প্ল্যাটেন বলেন, কয়লা, অপরিশোধিত তেল ও লোহার মতো সমুদ্রপথে পরিবহনযোগ্য পণ্যগুলোর জন্য চীনা ক্রেতাদের কোন চাহিদা নেই বললেই চলে। চাহিদা কমায় দাম পড়ে গিয়ে তেলের বাজার মন্দা পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। চীন থেকে পণ্য আসতে বিলম্বের বিষয়ে গ্রাহকদের সতর্ক করে দিয়ে জাহাজের বদলে বিমানে, এমনকি সম্ভব হলে ভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আনার পরামর্শ দিয়েছে লজিস্টিকস কোম্পানি ফ্রেইটোস। ফ্রেইটোস বলছে, সাধারণত চান্দ্র নববর্ষের পর জমে থাকা যেসব চালান আসে, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে বাজে অবস্থায় পড়বে। সমুদ্র পরিবহনের ভাড়া বেড়ে যাবে এবং অনেক বিলম্ব হবে।
শুধু জাহাজে পণ্য পরিবহনই নয়, আকাশপথে পণ্য পরিবহনও ব্যাহত হয়েছে।
ব্রিটিশ কোম্পানি আইএজি কার্গো চীনের মেইনল্যান্ডের সঙ্গে অন্তত এক মাসের কার্গো ফ্লাইট বাতিল ঘোষণা করেছে বলে সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে। জামান কুরিয়ার সার্ভিস ডিএইচএল চীনকে কেন্দ্র করে ‘আকাশপথে, ট্রাক ও রেলে পণ্য পরিবহনে মারাত্মক বিপর্যয়ের’ খবর দিয়েছে। এর ফলে চীনজুড়ে গাড়ি, ওষুধ ও মেডিক্যাল পণ্য ও উচ্চপ্রযুক্তি খাতের মতো শিল্পগুলোতে সরবরাহ ব্যবস্থা ও উৎপাদনের বড় ধরনের প্রভাব’ পড়বে বলে ডিএইচএলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ভাইরাসের কেন্দ্রস্থল উহান রাজ্যে পণ্য পৌঁছানো আপাতত বন্ধ রেখেছে ডিএইচএল। এছাড়া অদূর ভবিষ্যতে তাদের কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকবে বলে মনে করছে কোম্পানিটি। চীনে পণ্য আনা-নেয়া অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছে ইউপিএস ও ফেডেক্স। তবে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়া সেবার জন্য চাহিদা কমে গেছে বলে ইউপিএস জানিয়েছে।
সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ : এদিকে সমুদ্র পথে দেশের আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যের সিংহভাগ সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। প্রায় ৯০ শতাংশ বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্পন্ন হয়ে থাকে এ বন্দরে। দেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি হয়ে থাকে চীন থেকে। বন্দরের দেয়া তথ্যমতে, প্রতি মাসে চীন থেকে ১৪-১৫টি কন্টেনার জাহাজ এবং ৪ থেকে ৫টি জেনারেল কার্গো জাহাজ আসে চট্টগ্রাম বন্দরে। এ কারণে প্রতিদিন চীনের বিভিন্ন বন্দর থেকে পণ্য বোঝাই জাহাজ নিয়ে নাবিকরা আসেন চট্টগ্রাম বন্দরে। ফলে ‘করোনা ভাইরাস’ ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এই ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে নানা ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সমুদ্রগামী জাহাজের মাধ্যমে মরণঘাতী এই ভাইরাস যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে, সে লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মোঃ ওমর ফারুক।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত নাবিকের পরিচর্যায় বন্দর মেডিক্যাল বিভাগের বিশেষ টিমকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালের উদ্যোগে ভাইরাসটির সংক্রমণ প্রতিরোধের লক্ষ্য মৌলিক সুস্থতা অনুশীলনের নানাবিধ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বন্দরের হারবার ও মেরিন দফতরের এক জরুরী সভায় সমুদ্রপথে করোনা ভাইরাস প্রবেশ প্রতিরোধে জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং এজেন্টের মাধ্যমে কোন জাহাজ বহির্নোঙরে আসার সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে যথাযথ ঘোষণা দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বন্দরে আসা জাহাজের মাস্টারকে পোর্ট লিমিটে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা দিতে হবে যে, ওই জাহাজে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত নাবিক নেই বা আছে। এছাড়া পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে আসা জাহাজগুলোতে শতভাগ নাবিকের পোর্ট হেলথ অফিসার স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে নিরাপদ ঘোষণা করলেই বন্দরে ঢোকার অনুমতি দেয়া হবে। করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, নোংরা হাত দিয়ে নাক, কান ও মুখম-ল স্পর্শ না করা, আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরে থাকা ইত্যাদি বিষয়ে সতর্কীকরণ প্রচারের জন্য নৌ, ট্রাফিক, নিরাপত্তা বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডারদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত নিজ কক্ষে বা ঘরে অবস্থান, অন্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ পরিহার, সংক্রমণ প্রতিরোধ মাস্ক ব্যবহার এবং কর্মক্ষেত্র পরিষ্কার রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। জাহাজ থেকে হাসপাতালে দ্রুত রোগী স্থানান্তরের জন্য বন্দরের এ্যাম্বুলেন্স শিপও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এদিকে বন্দর ইমিগ্রেশন ডেস্কে পোর্ট হেলথ অফিসারের তত্ত্বাবধানে একটি মেডিক্যাল টিম সার্বক্ষণিক দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে। কোন নাবিক বাইরে যেতে চাইলে মেডিক্যাল স্ক্রিনিংয়ে সুস্থতা সাপেক্ষেই শুধু অনুমতি দেয়া হবে। এছাড়া সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে মাস্ক ও অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সবাইকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
চীন থেকে আমদানিকৃত চার ভোগ্যপণ্যের সঙ্কট
এদিকে চীন থেকে আমদানিকৃত চার মসলা জাতীয় ভোগ্যপণ্য পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও দারুচিনি নিয়ে নতুন সঙ্কট তৈরি হয়েছে। আমদানি হ্রাস পাওয়ায় বাংলাদেশের বাজারে দাম বাড়তে শুরু করেছে এসব পণ্যের। এছাড়া চীন থেকে আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্য কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত তা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি থাকলে চীন থেকে ভোগ্যপণ্য আমদানি সাময়িক স্থগিত করা হতে পারে। করোনা ভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী হলে চীনের সঙ্গে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে আলপিন থেকে শুরু করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির প্রায় সিংহভাগ আমদানি হয়ে থাকে চীন থেকে। একক দেশ হিসেবে চীনের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এই দেশটির সঙ্গে। গত দশ বছরে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে চীন থেকে। শুধু তাই নয়-পদ্মা সেতুসহ দেশের দশ মেগাপ্রকল্পে চীনের অংশীদারিত্ব সবচেয়ে বেশি। সম্প্রতি মসলা জাতীয় ভোগ্যপণ্যের বাজারও অনেকাংশে চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ভারত রফতানি বন্ধ করে দিলে চীন থেকে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে। এছাড়া আদা, রসুন, দারুচিনি, খাবারের সোডা, হাইড্রোস এবং গ্লোবাল সল্টের মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি হয় চীন থেকে। করোনা ভাইরাসের প্রভাব এবং নববর্ষের ছুটি চলায় চীনের সঙ্গে এলসি কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রয়েছে। ছুটি আরও দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইতোমধ্যে চীন থেকে আমদানিকৃত প্রায় সব ধরনের পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের দাম গত এক সপ্তাহ ধরে বেড়ে চলছে। চীন থেকে আমদানিকৃত প্রতি কেজি পেঁয়াজ বাজারে এখন ৮০-১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে দাম বেড়েছে ২০ টাকা পর্যন্ত। একই অবস্থা আদা ও রসুনের ক্ষেত্রে। গত বছরের পুরোটা সময় আদা ও রসুনের অতিরিক্ত দাম মানুষকে ভুগিয়েছে। দাম বেড়ে প্রতিকেজি আদা ১১০-১৮০, রসুন ১৫০-২২০ এবং দারুচিনি প্রতিকেজি ৪২০-৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মসলা জাতীয় এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের কষ্ট বেড়েছে। তবে আমদানিকৃত এসব ভোগ্যপণ্যে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি থাকলে আমদানি কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত করে দেয়ার কথা ভাবছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আমদানি) মোঃ শাখাওয়াত হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, মানুষের জীবন আগে। জীবন যদি না বাঁচে তাহলে পণ্য দিয়ে কি হয়? এ কারণে চীন থেকে আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের ব্যাপারে সতর্ক অবস্থানে থাকবে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, পেঁয়াজ, রসুন, আদা কিংবা অন্যান্য পণ্যে যদি কোন স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি প্রমাণিত হয় তাহলে এসব পণ্যের আমদানি সাময়িক স্থগিত করা হতে পারে। এক্ষেত্রে বিকল্প বাজার থেকে এসব পণ্যের আমদানি বাড়ানো হবে। তিনি বলেন, চীনের সঙ্গে মূলত ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য খুব বেশি নয়। তবে শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির বেশির ভাগ আসে চীন থেকে। চীনই এদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। তাই বিষয়টির গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে সরকার।
বিশ্বজুড়েও অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে ভোগ্যপণ্যের দাম : চীনে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে ভোগ্যপণ্যের দাম। জানা গেছে, গত অর্থবছর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চীন থেকে ৬৪ হাজার ৭৯৬ টন রসুন আমদানি হয়। এবার গত ডিসেম্বরে সাড়ে ১৮ হাজার টন রসুন আমদানি হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য মতে, গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৪০ হাজার ৩৮৩ টন। রসুন আমদানি হয়েছে ১৯ হাজার ২০০ টন এবং আদা আমদানি হয়েছে ১২ হাজার ১৬৬ টন। এর মধ্যে চীন থেকে পেঁয়াজ আমদানির পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ২৮৭ টন, রসুন ১৮ হাজার ৬৩৮ টন এবং আদার পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৪৫০ টন। এদিকে চীন যেসব পণ্য নিজেদের ব্যবহারের জন্য আমদানি করে, সেগুলোর দাম কমছে বিশ্বজুড়ে। অন্যদিকে যেসব পণ্য রফতানি করে, সেগুলোর দাম বাড়ছে। এর প্রভাব বাংলাদেশের বাজারেও পড়তে শুরু করেছে। চীন থেকে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ১৪ থেকে ২২ দিন সময় লেগে থাকে। কিন্তু চীনে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে ছুটি বাড়ানো হয়েছে। ফলে আমদানিতে এলসি কার্যক্রম থেকে শুরু করে পণ্য জাহাজীকরণ সবকিছু পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে ব্যবসায়ীদের।
চীনের সঙ্গে নিয়মিত ব্যবসা করেন এরকম কয়েকজন উদ্যোক্তা জানান, ভয়াবহ সঙ্কটে রয়েছেন তারা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। তাই এখনই এ বিষয়ে করুণীয় নির্ধারণ হওয়া উচিত। চীনের সঙ্গে শুধু অফিসিয়াল বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর বাইরেও আরও ৪-৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য রয়েছে দেশটির সঙ্গে। গত এক দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে চীন প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করেছে। আগামীতে আরও বড় অঙ্কের বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে চীন।
চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের বিষয়টি বাংলাদেশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে
চীন বাংলাদেশের বড় ব্যবসায়িক অংশীদার। দেশটি থেকে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস নিয়ে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতিতে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের বিষয়টি বাংলাদেশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। দেশের আমদানি-রফতানির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বাণিজ্য সচিব ড. মোঃ জাফর উদ্দীন একটি বৈঠক করেছেন। পরে বাণিজ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, আগামী তিন দিনের মধ্যে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেবে এফবিসিসিআই। এ প্রতিবেদনের ওপর সরকার পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে। তিনি আরও বলেন, তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে কোন সমস্যা নেই। তবে করোনা ভাইরাস সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে চিন্তার বিষয়। চীনের সঙ্গে যেসব সেক্টরে বাণিজ্য রয়েছে বিশেষ করে বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএসহ সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে কাজ করছে। কিছু দিনের মধ্যে বোঝা যাবে। ব্যবসায়ীরাও বিষয়টি পর্যালোচনা করছেন। যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
টিপু মুনশি বলেন, করোনা ভাইরাস নিয়ে যে সমস্যা চলছে, উভয় দেশের বাণিজ্য ক্ষেত্রে এর প্রভাব পর্যালোচনা করে সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এ সমস্যা বেশি দিন অব্যাহত থাকলে আগামী দিনের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকার এ বিষয়ে সতর্ক রয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সব দেশ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছে। বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ বিষয়ে কাজ করছে। এই মুহূর্তে চীন থেকে কোন পণ্য আমদানি বন্ধ আছে কি-না জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, এখনও পণ্য আমদানি বন্ধ হয়নি। তবে করোনা ভাইরাস দীর্ঘমেয়াদী হলে আমাদের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। ভোগ্যপণ্য হয়তো সহজেই অন্য দেশ থেকে আমদানি করা যাবে। কিন্তু তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি করা হয়, তা নিয়ে ভাবার বিষয়। কারণ এসব পণ্যের আমদানি বিকল্প দেশ খুঁজে পাওয়া কঠিন।