আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…

53

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বায়ান্নর রক্তঝরা দিনগুলো! ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেকে বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষাকে রক্ষা করেন। মায়ের ভাষা কেড়ে নেয়ার এই সংগ্রামে সেদিন ছাত্রজনতা একসঙ্গে রাজপথে নেমে পড়ে। পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষা নিয়ে এমন আন্দোলন আর কোথাও হয়নি। আজ সেই ভাষার মাসের প্রথম দিন। প্রতিবারের মতো আজ থেকে জাতীয় শহীদ দিবস সামনে রেখে প্রাণে প্রাণ মিলবে নানা কর্মসূচীতে। বেদনার সেই দিন হয়ে উঠবে বাঙালি জাতির প্রাণের মিলনমেলা। লাখো কণ্ঠে গাওয়া হবে অমর সেই গানটি। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি…।’ অমর একুশের চেতনার রঙে সাজতে শুরু করবে বাংলা। ভাষার মাস ঘিরে নতুন জাগরণের সৃষ্টি হবে।
মাতৃভাষা আন্দোলনের শুরুটা ১৯৪৭ সালের পর থেকেই। পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই পূর্ব বাংলার মানুষ বঞ্চিত ও শোষিত হয়ে আসছিল। পাকিস্তান কৌশলে বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভাষার ওপর প্রথম আঘাত হানে। মায়ের ভাষায় কথার বলাও তারা বন্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করে। কিন্তু বাংলার মানুষ সেই ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করতে একবিন্দু পিছু হটেনি। মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে প্রতিদিন রাজপথে চলতে থাকে মিছিল-সমাবেশ। শুরু হয় বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলন। মায়ের মুখের ভাষাকে কেড়ে নিয়ে তারা রাষ্ট্রভাষা উর্দু করতে চেয়েছিল। আন্দোলন/সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অনেক চড়াই-উতরাই পার করে চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। তবে তার আগেরদিনগুলো ছিল পাকিস্তানী শোষকগোষ্ঠীর অত্যাচার-নির্যাতনের। ১৯৫২ সালের আগুনঝরা দিনগুলো বিশ্বের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।
সবচেয়ে বড় আয়োজনটির নাম অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাংলা একাডেমি চত্বরে এর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাসব্যাপী মেলা শুধু বইয়ের নয়, বাংলা সংস্কৃতির। তাই এ মাসে বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। প্রতিবছরের মতো এবারও হাজারও অনুষ্ঠানমালা নিয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো জাগরিত হয়ে উঠবে।
পূর্ব পাকিস্তানে বহু আগেই ভাষাচেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বের আবিষ্কারকরা ঘন আবেগ বুঝতে পারেননি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প দিনের ব্যবধানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ পাকিস্তান বিরোধী হয়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে নামেন। ভাষার দাবি চিরতরে স্তব্ধ করতে পাকিস্তান সরকারের বর্বর পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালাতেও দ্বিধা করেনি। সেদিন আবুল বরকত, আবদুল জব্বার ও আবদুস সালাম, শফিক, রফিকসহ নাম না জানা অনেক ছাত্র-যুবা শহীদ হন। এর প্রতিবাদে ঢাকাবাসীসহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে ছাত্ররা সমবেত হন। ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ ফেটে পড়েন। পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি আবারও রাজপথে নেমে আসেন ছাত্র-জনতা। তারা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় অংশ নেন। স্বজন হারানোর স্মৃতি অমর করে রাখতে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে স্মৃতিস্তম্ভ¢। ২৬ ফেব্রুয়ারি এটি গুঁড়িয়ে দেয় পুলিশ বাহিনী। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল আসন নিয়ে জয়লাভ করে। ৯ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
এদিকে, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাষা বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের কাছে কানাডা প্রবাসী দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতে পালিত হচ্ছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে উত্থাপন করে বাংলাদেশ। ১১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের তথ্যবিষয়ক কমিটিতে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। এখন তাই শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং বিশ্ববাসী বাংলা ভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে আসছে।