কাজিরবাজার ডেস্ক :
আজ রবিবার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিনে শনিবার তুরাগ তীরে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে শনিবার লাখ লাখ মুসল্লির উদ্দেশে চলে পবিত্র কোরআন-হাদিসের আলোকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বয়ান। রবিবার সকাল ১০টা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে বলে ইজতেমা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। মোনাজাতের আগে অনুষ্ঠিত হবে হেদায়তি বয়ান। তবলীগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরব্বিদের পরামর্শের ভিত্তিতে এ পর্বে তবলীগ জামাতের মুরব্বি বাংলাদেশের কাকরাইল মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ জোবায়ের আরবী ও বাংলায় আখেরি মোনাজাত পরিচলনা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। মোনাজাতে বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ার মানুষের সুখ, শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে দোয়া করা হবে। বিদেশী নিবাসের পূর্বপাশে বিশেষ মোনাজাত মঞ্চ থেকেই রবিবার সকালে এ আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করা হবে। আখেরি মোনাজাতে প্রায় ২০/২৫ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি অংশ নিবেন বলে আয়োজকদের ধারণা। মাওলানা জোবায়ের অনুসারী আলেম ওলেমা কওমিপন্থী তবলীগ অনুসারীদের প্রথম পর্বের ইজতেমা রবিবার শেষ হওয়ার পর ১৭ জানুয়ারি হতে দ্বিতীয় ধাপের ইজতেমায় মাওলানা সা’দ কান্ধলভী অনুসারী ওয়াসেকুল ইসলামের তবলীগ অনুসারীরা অংশ নিবেন।
বিশ্ব ইজতেমায় আগত লাখ লাখ মুসল্লির পদভারে টঙ্গীর তুরাগ তীর মুখরিত। ইজতেমার প্রথম পর্বে শিল্প নগরী টঙ্গী ইতোমধ্যেই ধর্মীয় নগরীতে পরিণত হয়েছে। শনিবার সকালেই টঙ্গী শহর এবং ইজতেমাস্থল ও এর আশপাশ এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। ইসলামী দাওয়াতের মাধ্যমে ইমান আকিদা বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে ইহলৌকিক ও পরলৌকিক মঙ্গল কামনার জন্য মুসল্লিরা দেশের দূর-দূরান্ত থেকে ইজতেমা ময়দানে উপস্থিত হয়েছেন। শনিবারও টঙ্গী অভিমুখী বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে ছিল মানুষের ভিড়। রবিবার আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মানুষের এ ঢল অব্যাহত থাকবে। এবারের ইজতেমার শেষ দফায় (দ্বিতীয় পর্ব) মাওলানা সা’দ কান্ধলভী অনুসারী ওয়াসেকুল ইসলামের তবলীগ অনুসারীরা অংশ নিবেন। তবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বিদের গুরুত্বপূর্ণ বয়ান ও মুসল্লিদের নফল নামাজ, তাসবিহ তাহলিল, জিকির আসগারের মধ্য দিয়ে শনিবার বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় দিন অতিবাহিত হয়েছে।
আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে মুসল্লিদের সুবিধার্থে শনিবার মধ্যরাত থেকে ওই এলাকায় যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে পুলিশ। রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বিধিনিষেধ বলবৎ থাকবে। এবারের বিশ্ব এজতেমা নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রায় ১২ হাজার র্যাব ও পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি রয়েছে সাদা পোশাকে প্রায় ৩ হাজার গোয়েন্দা সদস্য। আকাশ ও নৌপথে রয়েছে র্যাবের সতর্ক নজরদারি।
দ্বিতীয় দিন শনিবার যারা বয়ান করলেন : ইজতেমার প্রথম দফার দ্বিতীয় দিন শনিবার ফজরের নামাজের পর থেকে বয়ান করেছেন ভারতের মাওলানা আব্দুর রহমান। আর বাংলাদেশের মাওলানা মোঃ আব্দুল মতিন তা বাংলায় তরজমা করেন। এ সময় ইংরেজী, উর্দুসহ বিভিন্ন ভাষায় বয়ান তরজমা করা হয়। এছাড়া বাদ জোহর সৌদি আরবের মুরব্বি মাওলানা শেখ ইসমাইল, বাদ আছর মাওলানা জুহাইরুল হাসান এবং বাদ মাগরিব মাওলানা ইব্রাহিম বয়ান করেছেন বলে জানান বিশ্ব ইজতেমার মুরব্বি ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুর রহমান।
যা বয়ান করলেন : দুদিন ধরে এজতেমা মাঠে সার্বক্ষণিক ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত রয়েছেন প্রতিদিন ফজর থেকে এশা পর্যন্ত এজতেমা মাঠে ইমান, আমল, আখলাক ও দ্বীনের পথে মেহনতের ওপর আম বয়ান অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শনিবার বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় দিনে দেশ বিদেশী আগত মুরব্বিগণ তবলীগের ছয় ওছুলের মধ্যে দাওয়াতে দ্বীনের মেহনতের ওপর গুরুত্বারোপ করে বয়ান করেন।
বয়ানে তবলীগ মুরব্বিগণ বলেন, আল্লাহ তায়ালা আপনাকে আমাকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন এবং আল্লাহ তায়ালা এটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, দুনিয়াতে যে একবার আসবে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। আল্লাহ পাকের এ সিদ্ধান্তের কোন পরিবর্তন হবে না। দুনিয়া হচ্ছে ধোকার ঘর, এ দুনিয়া হচ্ছে ধোকার জীবন। মিছে এই দুনিয়ার আরাম আয়েশের কথা ভুলে গিয়ে আখেরাতের কথা চিন্তা কর। দুনিয়ার জিন্দেগি ক্ষণস্থায়ী, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের দিল থেকে আসবাবের (সম্পদের) এক্বিন বের না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার দিলে কুদরতি এক্বিন পয়দা হবে না। সকলকে দ্বীনের জন্য মেহনত করতে হবে। আল্লাহর কাছে আমল ছাড়া এ দুনিয়ার জিন্দেগির কোন মূল্য নেই। বয়ানে আরও বলা হয়, দ্বীনের দাওয়াতের মাধ্যমে ইমান মজবুত হয়। ইমান মজবুত হলে আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর এ সম্পর্ক গড়ে উঠলে দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াবি হাসিল হয়।
তাশকিলের কামরায় চিল্লাভুক্ত মুসল্লি : ইজতেমার প্যান্ডেলের উত্তর-পশ্চিমে তাশকিলের কামরা স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন খিত্তা থেকে বিভিন্ন মেয়াদে চিল্লায় অংশ গ্রহণেচ্ছু মুসল্লিদের এ কামরায় আনা হচ্ছে এবং তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। পরে তবলিগী মুরব্বিদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এলাকা ভাগ করে তাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় তবলিগী কাজে পাঠনো হবে।
আখেরি মোনাজাত আজ সকালে : ইজতেমার আয়োজক কমিটির মুরব্বি ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুর রহমান জানান, রবিবার সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে আখেরি মোনাজাত করার কথা রয়েছে। তবলীগ জামাতের মুরব্বি বাংলাদেশের কাকরাইল মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ জোবায়ের আরবী ও বাংলায় এ পর্বের আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করার কথা রয়েছে। ইতোপূর্বে মাওলানা জোবায়ের তবলীগের প্রয়াত বিশ্ব আমির মোঃ জোবায়রুল হাসান এবং মাওলানা সা’দের বয়ান বিশ্ব ইজতেমায় আগত বাঙালিদের বাংলায় অনুবাদ করে শুনাতেন। তবলীগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরব্বিদের পরামর্শের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এজন্য ব্যাপক প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
আরও পাঁচ মুসল্লির মৃত্যু : শনিবার দুপুর পর্যন্ত বিশ্ব ইজতেমায় দ্বিতীয় পর্বে যোগ দিতে আসা ৯ মুসল্লি হৃদরোগ ও বার্ধক্যজনিত কারণে ইজতেমা ময়দানে মারা গেছেন। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার মোঃ মনজুর রহমান জানান, শুক্রবার রাতে কুমিল্লার দেবীদ্বার থানার বিংলাবাড়ী গ্রামের তমিজ উদ্দিন (৬৫), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ থানার তল্লা গ্রামের আব্দুস সাত্তারের ছেলে শাহজাহান (৬৫), বরিশালের গৌরনদী থানার খালিজপুর গ্রামের আলী আজগর (৭০) ও নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার দক্ষিণ কলাবাগান গ্রামের ইউসুফ আলী মেম্বার (৪৫)। এর আগে শুক্রবার বিকেলে চরঘাট থানার বনকিশোর এলাকার আব্দুর রহমানের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক (৫০), সকালে নওগাঁর শহিদুল ইসলাম (৫৫), বৃহস্পতিবার সকালে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া এলাকার ইয়াকুব শিকদার (৮৫) এবং রাতে সিরাজগঞ্জের খোকা মিয়া (৬০) ও চট্টগ্রামের মোহাম্মদ আলী (৭০) মারা যান।
চার বছর পর যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত : প্রায় চার বছর বিরতি দিয়ে এবারের বিশ^ ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিনে ইজতেমা ময়দানে কনের অনুপস্থিতিতে এজতেমার মূল আকর্ষণ যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। শীর্ষ মুরব্বি মাওলানা জোবায়ের ও মাওলানা সা’দ কান্ধলভী অনুসারীদের মতবিরোধের কারণে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এজতেমা ময়দানে যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে বর ও কনে পক্ষের সম্মতিতে তাদের সংশ্লিষ্ট এলাকার মসজিদে যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল।
ইজতেমা ময়দানের শীর্ষ মুরব্বি প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, গতকাল শনিবার বাদ আসর বিশ^ ইজতেমা ময়দানের মূলমঞ্চে ৬১ জোড়া যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিয়ে পরিচালনা করেন মাওলানা জোহায়েরুল হাসান। তবলীগের রেওয়াজ অনুযায়ী ইজতেমার দ্বিতীয় দিন বাদ আসর বয়ান মঞ্চের পাশে বসে যৌতুকবিহীন বিয়ের আসর। কনের সম্মতিতে ও তার অনুপস্থিতিতে বর এবং কনে পক্ষের লোকজনের উপস্থিতিতে ওই বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। বিয়েতে মোহরানা ধার্য করা হয় ‘মোহর ফাতেমী’র নিয়মানুযায়ী। এ নিয়মানুযায়ী মোহরানার পরিমাণ ধরা হয় দেড়শ’ তোলা রূপা বা উহার সমমূল্য অর্থ। বিয়ের পর নবদম্পতিদের সুখ-সমৃদ্ধিময় জীবন কামনা করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে মোনাজাতের মাধ্যমে দোয়া করা হয়। এসময় মঞ্চের আশপাশের মুসল্লিদের মাঝে খোরমা খেজুর ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়।
বিদেশী মুসল্লি : শনিবার দুপুর পর্যন্ত বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে বিশে^র ৬৯টি দেশের প্রায় এক হাজার ৯শ’ বিদেশী মুসল্লি অংশ নেন। তাছাড়া এ পর্বে দেশের ৬৪টি জেলার কয়েক লাখ মুসল্লিরা ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন গাজীপুরে জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম।
জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমান আদালত : গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম জানান, ইজতেমাস্থলের আশপাশে বিভিন্ন খাবার দোকান ও হোটেলে শুক্রবার থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের একাধিক ভ্রাম্যমান আদালত অভিযান চালিয়ে ভেজাল খাবার পরিবেশন ও বিক্রির দায়ে বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে কয়েক ব্যক্তিকে জরিমানা ও আদায় করেন। ইজতেমাস্থলের আশপাশে ৫টি করে দুশিফটে গাজীপুর জেলা প্রশাসনের মোট ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। গাজীপুরসহ বিভিন্ন জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ ওইসব আদালত পরিচালনা করেন।