কাজিরবাজার ডেস্ক :
সারাদেশে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশই জামিন নিয়ে বের হয়ে গেছে। কারাগারে আছে মাত্র ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ জঙ্গি। জামিনপ্রাপ্ত অন্তত দুই শতাধিক জঙ্গির কোন হদিস পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ’১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ’১৯ সাল পর্যন্ত পৌনে তিন বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক ৭৭৯ জঙ্গির মধ্যে ৫৬৪ জনই জামিনে বের হয়ে গেছে। বছরের পর বছর ঝুলে আছে প্রায় আট শ’ মামলা। আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৫৫০। অজানা কারণে মন্থর গতিতে চলছে ২৫০ মামলার তদন্ত কাজ। আলোচ্য সময়ে এসব মামলায় আটক প্রায় চার হাজার জঙ্গি। এদের দুই শতাধিক জামিন নিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছে। তিন শ’ জামিন নিয়ে আর আদালতে হাজির হচ্ছে না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জঙ্গিদের জামিন পাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। গোয়েন্দা রিপোর্টে চিহ্নিত জঙ্গিদের অকালীন জামিন পাওয়া বন্ধ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে উদ্যোগ নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এ বিষয়ে এখনই প্রশাসনিক বা আইনী ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। তদন্তে গাফিলতি ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতায় মূলত এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এসব মামলার আসামিদের যথাসময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না হলে জঙ্গি হামলার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে বলে গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিরা জামিন নিয়ে পলাতক হলেও তাদের জামিনদারদের নেই যথাযথ কার্যকর জবাবদিহিতা। তাদের কারও বিরুদ্ধেই আজ পর্যন্ত কোন আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জঙ্গিরা নির্বিঘ্নে জামিন নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। পলাতকদের মধ্যে অন্তত দুই ডজন ভয়ঙ্কর জঙ্গি রয়েছে, যারা সমরাস্ত্র পরিচালনাসহ শক্তিশালী বিস্ফোরক তৈরিতে পারদর্শী। দেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে জঙ্গি সংগঠনের সাম্প্রতিক উত্থানের নেপথ্যে এসব র্দুর্র্ধষ জঙ্গি কলকাঠি নাড়ছে। আবার কেউ কেউ কারাগারে আটক থেকেও তৎপরতা চালানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। দেশের বিভিন্নস্থানে চিরুনি অভিযান চালিয়েও জামিনে পলাতক জঙ্গিদের অবস্থান চিহ্নিত করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জামিনে মুক্ত এসব দুর্বৃত্ত কোথায় আছে সে বিষয়ে কোন তথ্য নেই পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাছে। এসব পলাতক জঙ্গিকে দ্রুত গ্রেফতার করা না গেলে দেশে নিরাপত্তা হুমকির আশঙ্কা থাকবে।
সুপ্রীমকোর্টের এক আইনজীবী বলেন, প্রচলিত আইনে জঙ্গিবাদের ঝুঁকির বিষয়টি সেভাবে কভার করে না। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে মামলা হয় অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে। এ বিষয়ে আইন সংশোধন করা জরুরী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষ আদালতের মাধ্যমে জঙ্গি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকেও সরকারের কাছে আবেদন জানানো হবে যাতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এসব মামলার বিচার করা হয়। ওকে গ্রেফতার হয় জঙ্গি হিসেবে আর মামলা দায়ের হয় অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে। এভাবে কোন জঙ্গিকে কতদিন আটকে রাখা যায়?
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গি দমন ও এ সংক্রন্ত মামলা তদন্তে পুলিশের আন্তরিকতার অভাব নেই। প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে সময় লাগায় চার্জশীট দিতে কোন কোন ক্ষেত্রে দেরি হয়। তবে খুব বেশি দেরি করার সুযোগ নেই। প্রত্যেক মামলার তদন্তে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ওই সময়সীমার মধ্যে অনেক সময় পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা যায় না। আবার যথাযথ তথ্য-প্রমাণ ছাড়া চার্জশীট দাখিল করলে জঙ্গিদের ছাড়া পেয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ত্রুটিহীন চার্জশীট দিতে সময় বেশি লাগলে আবার জবাবদিহিতার আওতা দিয়ে যেতে হয়।
জঙ্গিদের বিষয়ে কাজ করেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের এমন এক আইনজীবী বলেন, অনেক সময় সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা সম্ভব হচ্ছে না। সাক্ষী হাজিরের জন্য আদালত থেকে অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানাও পাঠানো হচ্ছে। তবুও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আদালতে সাক্ষী উপস্থিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। জঙ্গি সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন অত্যন্ত জরুরী। যেসব জঙ্গি জামিন নিয়ে পলাতক, সেসব মামলায় তাদের জামিনদারদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। জামিনদার সিভিল হোক, আইনজীবী হোক জামিন নিয়ে আসামি পলাতক হলে জামিনদারদের আইনের আওতায় আনতে হবে। জামিনদারের জবাবদিহিতার নজির সৃষ্টি না হলে জঙ্গিদের জামিন নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকবে না।
গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, জামিন নিয়ে যেসব জঙ্গি পালিয়ে গেছে তার অন্তত দুই শতাধিক জঙ্গির তালিকা তৈরি করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। যারা পালিয়ে গেছে তাদের মধ্যে আছে আইএস দাবিদার ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন রহমান ইবনে হামদান। ’১৪ সালে ঢাকায় ‘মুজাহিদ’ সংগ্রহে এসে গ্রেফতার হয় সে। জামিনে ছাড়া পেয়ে লাপাত্তা সে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে জামিন নিয়ে পলাতক-র্দুর্র্ধষ জঙ্গিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কাওছার হোসেন, কামাল উদ্দিন, আজমীর, গোলাম সারওয়ার, মুফতি আবদুল হাই, মুফতি শফিকুর রহমান, জাহাঙ্গির আলম, নূর ইসলাম, আমিনুল মুরসালিন, মহিবুল মোত্তাকিন, রফিকুল ইসলাম মিরাজ ও মশিউর রহমান, তানভীর, তৌহিদুল, সাইদুর, সাইফুল, রেজাউল, নাঈম, জুম্মন, আমিনুল, জঙ্গি আবদুল আকরাম, জুনায়েদ রহমান, মানিক, মাজিদ, সাজেদুর, ফারুক, শফিক, মিলন, কফিল উদ্দিন ওরফে রব মুন্সি, আজিবুল ইসলাম ওরফে আজিজুল, শাহান শাহ, হামিদুর রহমান, বজলুর রহমান, বাবর, শরিফ, খাইরুল ইসলাম, ওয়ালিউল্লাহ ওরফে হামিদ, জাকারিয়া, সবুজ, নাদিম, ময়েজ উদ্দিন, মহব্বত ওরফে তিতুমীর ওরফে নাহিদ।
র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর র্যাবের হাতে গ্রেফতার ৫১২ সন্দেহভাজন জঙ্গির মধ্যে তিন শ’ জনই জামিন পেয়েছে। এই তিন শ’ জনের মধ্যে জামিন নিয়ে বের হয়ে গেছে, যার অর্ধেকই এখন পলাতক। জঙ্গি সন্দেহে আটকের পর জামিনে থাকলে তাদের ওপর কতটা নজরদারি করা সম্ভব হচ্ছে ? জামিন পাওয়া সন্দেহভাজনদের ওপর সর্বক্ষণিক নজরদারি করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।