গ্যাস উৎপাদন কমে আসছে

20

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আশঙ্কাজনক খবর হলেও সত্য ক্রমান্বয়ে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমে আসছে। নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারে ব্যর্থতা আর সাগরে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাতে না পারায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গত চার বছরের মধ্যে চলতি বছর সর্বনিম্ন অবস্থায় রয়েছে গ্যাসের উৎপাদন। আর গত জুন পর্যন্ত এক বছরের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে দেশী গ্যাসের উৎপাদন কমেছে দৈনিক ৩৫০ মিলিয়ন ঘনমিটারের (এমএসসিএম) ওপরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন ক্ষেত্র অনুসন্ধান না করে বিদ্যমান ক্ষেত্রের গ্যাস তুললে ক্রমান্বয়ে উৎপাদন কমে আসা স্বাভাবিক। এক সময় এই গ্যাস শেষ হয়ে যাবে। সঙ্গত কারণে স্থল এবং জলভাগে অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করার কথা বলছেন তারা। গ্যাসের উৎপাদন কমে গেলে বিদেশ থেকে চড়া দামে এলএনজি এনে প্রয়োজন মেটাতে হবে। এতে সার্বিকভাবে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে।
ভূতাত্ত্বিক অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, গ্যাসের উৎপাদন কমে আসবে এটা স্বাভাবিক ভাবেই সকলে জানে। দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধান উত্তোলন না করলে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ দেশীয় গ্যাসের দৈনিক উৎপাদন ২০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে আসবে। এই পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে নতুন নতুন জায়গাতে অনুসন্ধান করা উচিত। কিন্তু আমাদের এখানে জোরালো অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো হচ্ছে না। এতে সঙ্কট সৃষ্টি হবে।
পেট্রোবাংলার দেশীয় গ্যাস উৎপাদনের ছয় বছরের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে দেশে গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এ সময় একটি আইওসি গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি করাতে একবারে গ্যাসের উৎপাদন অনেকটা বেড়ে যায়। পেট্রোবাংলা বলছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে মোট গ্যাস উত্তোলন হয়েছে ২৭ হাজার ৫৫৯ দশমিক ২৫৫ এমএসসিএম, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে গ্যাসের উৎপাদন ছিল ২৭ হাজার ৪৪৫ দশমিক ৩৬৪ এমএসসিএম, ২০১৭-১৮ তে যা ছিল ২৭ হাজার ৪২৯ দশমিক ৯৮৩ এমএসসিএম আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ২৩২ দশমিক ৫৯৭ এমএসসিএম। এই হিসাব বলছে ২০১৮-১৯ সালে এসে দেশীয় গ্যাসের মোট উৎপাদন কমেছে।
আবার ২০১৮-এর আগষ্ট থেকে ২০১৯-এর জুন পর্যন্ত হিসাব বলছে দেশীয় কোম্পানি এবং (আন্তর্জাতিক তেল গ্যাস কোম্পানি (আইওসি) উভয় ধরনের গ্যাসেরই উৎপাদন কমেছে। বিগত ২০১৮-এর জুলাই মাসে গ্যাসের উৎপাদন ছিল দুই হাজার ৩৯১ দশমিক ৭৭৮ এমএসসিএম আর ২০১৯-এর জুনে এসে দুই হাজার ২৪ দশমিক ৯৯৮ এমএসসিএম। গত ফেব্রুয়ারি থেকে দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমতে শুরু করে।
দেশীয় গ্যাস কোম্পানির মধ্যে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড, সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি এবং বাপেক্স গ্যাস তুলছে। জুলাই ২০১৮ থেকে জুন ২০১৯ পর্যন্ত হিসাব বলছে সব কোম্পানির উৎপাদন কমছে। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি জুলাই-২০১৮তে ৭১৫ দশমিক ২৬৩ এমএসসিএম গ্যাস তুলেছে। আর তা কমে গত জুনে হয়েছে ৬০৩ দশমিক ৮৭১ এমএসসিএম। গত নবেম্বর থেকে গ্যাসের উৎপাদন কমতে শুরু করে। আর চলতি বছর মার্চ এপ্রিল থেকে অনেকটা কমে যায় উৎপাদন। একইভাবে সিলেট গ্যাস ফিল্ডের উৎপাদন ২০১৮-এর জুলাইতে ছিল ১১১ দশমিক ৮০১ এমএসসিএম আর গত জুনে এসে দাঁড়িয়েছে ১০০ দশমিক ২২২ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে বাপেক্সের উৎপাদন ২০১৮-এর জুলাই সালে ছিল ৯৯ দশমিক ৯৭৪ মিলিয়ন ঘনফুট আর গত জুনে যা ছিল ১০০ দশমিক ২২২ এমএসসিএম। তবে বছরের মাঝের কয়েক মাসে বাপেক্সের উৎপাদন কিছুটা কম ছিল। তবে মোট দেশীয় কোম্পানির গ্যাসের উৎপাদন ৯২৭ দশমিক ৩৮ এমএসসিএম থেকে গত জুনে কমে দাঁড়িয়েছে ৮০৬ দশমিক ২৬৪ এমএসসিএম।
বলা হচ্ছে দেশীয় কোম্পানির তহবিলে অলস টাকার পাহাড় জমেছে। এই অর্থ বিনিয়োগের বদলে কোম্পানিগুলো এফডিআর করে রাখে। আবার গ্রাহকের অর্থে একটি তহবিলও রয়েছে। গ্যাস উন্নয়ন তহবিলেও জমা টাকা খরচ করতে পারে না দেশীয় গ্যাস কোম্পানি। এক্ষেত্রে বাপেক্স এবং পেট্রোবাংলাকে কাজ না করার অভিযোগ করা হয় মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে। সম্প্রতি বাপেক্স ভবনে এক সেমিনারে বিদ্যুৎ জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, তাদের কাজের কথা বললে বলেন প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু কাজ আর শুরু করতে পারেন না। তিনি বলেন, বাপেক্স এবং পেট্রোবাংলার ব্যর্থতার দায় সরকার নেবে না। তাদের কাজের মূল্যায়ন করা হবে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসেন মনসুর বলেন, বাপেক্স কাজ করে না, এই দায় কি বাপেক্সের একার। প্রতিমন্ত্রী এই কথা বলতে পারেন কি না এমন প্রশ্ন তুলে বলেন, কেউ কাজ না করলে মন্ত্রণালয় কি করে!
অন্যদিকে আইওসির মধ্যে শেভরন বাংলাদেশ জালালাবাদ, মৌলভীবাজার এবং বিবিয়ানাতে ২০১৮-এর জুলাই মাসে গ্যাস তুলেছে এক হাজার ৩৯১ দশমিক ৯২০ এমএসসিএম। আর গত জুনে তারা তুলেছে এক হাজার ১৪২ দশমিক ৪৯০ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে বাঙ্গুরাতে তাল্লোর উৎপাদন ৭২ থেকে ৭৬ এমএসসিএম’র মধ্যেই ছিল।
দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমে গেলে বিদেশ থেকে এলএনজি এনে চাহিদা পূরণ করতে হবে। এতে প্রতি ইউনিটে সরকারকে ১০ ডলারের বেশি অতিরিক্ত ব্যয় করতে হবে। এলএনজি আমদানির অর্থ আবার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তুলে নিচ্ছে সরকার। এতে গ্যাসের দামও বেড়ে যাচ্ছে। এখন প্রতিদিন ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো এলএনজি আসছে। তবে দেশের উৎপাদন যত কমবে এলএনজির সরবরাহ তত বৃদ্ধি করতে হবে। এলএনজি আমদানির কারণে চলতি বছর বিইআরসি ৩২ ভাগ গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। ভবিষ্যতে এলএনজি আমদানি বাড়লেই গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে।
বলা হচ্ছে গত ১০ বছরে দেশের কোথাও গ্যাসের বড় কোন মজুদ আবিষ্কার হয়নি। যা ছোট ছোট মজুদ আবিষ্কার হয়েছে তাও ক্ষণস্থায়ী। কেবল ভোলার যে ক্ষেত্রতে গ্যাস তোলা হচ্ছে সেটি নিয়েই আশাবাদী পেট্রোবাংলা। আর সাগরে কেউ তেল গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ দেখাচ্ছে না অথবা পেট্রোবাংলা কাউকে আগ্রহী করতে পারছে না। ফলে বিস্তৃত সমুদ্র এলাকা অনুসন্ধানের বাইরে থেকে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, আমাদের উচিত স্থলভাগে অনুসন্ধানে জোর দেয়া। তিনি বলেন, ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিরসন হয়েছে। দেশ দুটি আমাদের সীমানার পাশেই অনুসন্ধান করছে। আমাদের উচিত তাদের সঙ্গে যৌথ সমীক্ষা করা। এতে সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন হবে। আর তা না করলে এক তরফাভাবে তারা গ্যাস তুলে নিয়ে যাবে। আমরা ফাঁকিতে পড়ব।