আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষোভ ॥ লাশ পড়ে থাকলো, এত নেতা কোথায় ছিল তখন

58
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করে বলেছেন, পাকিপ্রেমীরা জেলেই থাকুক, আর বিদেশেই থাকুক- তাদের ষড়যন্ত্র থাকবেই। কিন্তু পাকিপ্রেমীদের ষড়যন্ত্র এদেশের মাটিতে কখনও সফল হতে পারে না, হতে দেব না। যারা এদেশের স্বাধীনতা ও দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়, আমরা তাদের তা করতে দেব না। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলার মানুষকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। এখনও মুষ্টিমেয় কিছু দালাল থাকতে পারে, কিন্তু দেশের মানুষকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, পারবেও না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ লাখো শহীদের আত্মত্যাগ কখনও বৃথা যেতে পারে না।
শোকাবহ ১৫ আগস্টে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যাকান্ডের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে ওই সময় সাহস নিয়ে দলের নেতাদের এগিয়ে না আসায় কিছুটা ক্ষোভও ঝরে পড়ে আবেগতাড়িত প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এত বড় একটা ঘটনা (বঙ্গবন্ধু হত্যা), বাংলাদেশের কোন লোক জানতে পারল না? কেউ কোন পদক্ষেপ নিল না? লাশ পড়ে থাকল ৩২ নম্বরে! সে কথা আমি এখনও ভাবি। এত বড় সংগঠন, এত দলের নেতা- কোথায় ছিল তখন? মাঝে মাঝে আমার জানতে ইচ্ছে করে, কেউ সাহসে ভর করে এগিয়ে আসতে পারল না? বাংলার মানুষ তো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিল। এই ব্যর্থতার খেসারত দিতে হয়েছে গোটা জাতিকে। দেশে একের পর এক ১৮/১৯ ক্যু হয়েছে, অনেক মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। সেই সময় (বঙ্গবন্ধু হত্যা) কেউ সাহস করে দাঁড়ালে এতবার দেশে ক্যু হতো না, দেশের এত ক্ষতি হতো না।
মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে এসব প্রশ্ন উত্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় দলের নেতাকর্মীকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে সততার সঙ্গে নিজেদের গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, কী পেলাম বা কী পেলাম না, সেটি বড় কথা নয়। দেশের মানুষকে কী দিতে পারলাম সেটাই বড় কথা। অর্থ নিয়ে কেউ কবরে যেতে পারবে না। কিন্তু অনেকের অর্থপ্রাপ্তি একটি বড় নেশা। অর্থের পেছনে ছুটতে গিয়ে নিজের পরিবারকে ধ্বংস করে, ছেলেরা বিপথে যায়, মাদকে কিংবা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। এই দুরারোগ্য ব্যাধি (অর্থলিপ্সা) থেকে মুক্ত হয়ে জনগণের জন্য কাজ করলে এ দেশ আরও উন্নত হবে ও এগিয়ে যাবে। সেভাবেই নিজেদের গড়ে তুলতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিম-লীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গির কবির নানক, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএ মান্নান কচি ও মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির। স্বাগত বক্তব্য রাখেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিনের পরিচালনায় আলোচনা সভায় কবিতা আবৃত্তি করেন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য অধ্যাপক মেরিনা জাহান কবিতা।
সভাপতির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশকে সবদিক থেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্পের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ’৮১ সালে যখন দেশে ফিরে আসি তখন আমার একটাই লক্ষ্য ছিল, যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আমরা পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়েছি। তাই বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিকসহ সবদিক থেকে এগিয়ে থাকবে। আজ সত্যিই সেটা হয়েছে। অনেকের চেয়েই বাংলাদেশ আজ এগিয়ে রয়েছে। তবে এই অগ্রযাত্রা আমাদের ধরে রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধু আমাদের দেশকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। আমরা কারও ষড়যন্ত্রকে সফল হতে দেব না। বিজয়ের মাসে আমাদের অঙ্গিকার, আমরা বিজয়ের বেশেই সারাবিশ্বে মাথা উঁচু করে চলব, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তুলব।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ না করে বলেন, স্বাধীনতার পর যারা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) বলেছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে কী হবে, তলাবিহীন ঝুড়ি হয়ে থাকবে। সেই দেশটির বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ১৮ ভাগ। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, আমাদের দারিদ্র্যের হার সেই দেশটি থেকে একভাগ হলেও কমাব। শত ষড়যন্ত্র হলেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিকসহ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্যের হার আমরা ২০ ভাগে কমিয়ে আনতে পেরেছি, আরও কমাব। দেশের প্রবৃদ্ধি এখন ৮ দশমিক ১৫ ভাগ। আমরা ৯০ ভাগ প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করছি। আমরা যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
’৭৫ পরবর্তী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নাম ও তার ভাষণ বাজানো নিষিদ্ধ এবং ইতিহাস বিকৃতির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতিহাস সত্যকে অনুসন্ধান করে। সত্যই টিকে থাকে, মিথ্যা কখনও টিকে থাকে না- এটা আজ প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্বের আড়াই হাজার বছরের সব ভাষণের মধ্যে জাতির জনকের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে ইউনেস্কোর প্রমাণ্য দলিলে স্থান পেয়েছে। আমার এখন খুব জানতে ইচ্ছে করে, দীর্ঘ ২১টি বছর এই ভাষণটি যারা বাজানো নিষিদ্ধ করেছিল কিংবা এটা করার পরামর্শ দিয়েছিল- তাদের এখন লজ্জাবোধ হয় কী না? বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যতদিন, যত ঘণ্টা বেজেছে পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন ভাষণ এতদিন বাজেনি, ভাষণের আবেদন এখনও এতটুকু কমেনি।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘ ২১টি বছর বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলে স্বল্পোন্নত দেশে পরিণত করেছিলেন। বাংলাদেশ যখন ধীরে ধীরে সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখনই জাতির ওপর নেমে আসে চরম আঘাত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সব যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দিয়ে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করা, যুদ্ধাপরাধীদের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী বানিয়ে বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুরো ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলে। বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা চলে দীর্ঘ ২১টি বছর ধরে।
মহান বিজয় দিবসে দলের নেতাকর্মী, দেশী-প্রবাসী সব সমর্থকসহ দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করি, পাকিস্তানী হানাদাররা আত্মসমর্পণ করে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ বিজয় অর্জন করলেও আমরা মুক্তি পাই পরদিন ১৭ ডিসেম্বর। বন্দীদশায় থাকার ওই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর আমাদেরও ধানম-ির একটি বাড়িতে বন্দী করে রাখা হয়। শেখ কামাল আগেই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল, আর শেখ জামাল গেরিলা কায়দায় ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শেখ হাসিনা আরও বলেন, বন্দী দশায় থাকার সময় আমাদের একমাত্র অবলম্বন ছিল একটি রেডিও। ওই রেডিওর মাধ্যমে আমরা হানাদারদের আত্মসমর্পণের কথা জানতে পারি। বাইরে তখন জয় বাংলা গগনবিদারী স্লোগান চলছিল। দেশ স্বাধীন হলেও আমরা তখনও বন্দী। বিজয়ী বাঙালীদের অনেকেই স্লোগান দিয়ে আমাদের দিকে (যেখানে বন্দী করে রাখা হয়েছিল) আসার চেষ্টা করেছে, তখন পাকিস্তানী হানাদাররা গুলি করে অনেককে হত্যা করেছে। পরদিন ১৭ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের মুক্ত করা হয়। মুক্তি পেয়েই আমার মা (ফজিলাতুন্নেসা মুজিব) ওই বাসায় টানানো থাকা পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান কারাগারে বন্দী থাকার কথা স্মরণ করাসহ তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমার মাঝে মাঝে অবাক লাগে! সেই নয়টা মাস (মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস) একাকী তিনি (বঙ্গবন্ধু) পাকিস্তান কারাগারে বন্দী। একটি বৈরী পরিবেশ, বৈরী আবহাওয়া। সেখানে যেমন গরম, তেমন শীত। তাঁকে কীভাবে রেখেছিল? কি খেতে দিয়েছিল? যাকে তারা (পাকিস্তানী) ফাঁসি দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল, তাঁকে তারা কত কষ্ট দিতে পারে- সেটা কল্পনাও করা যায় না। আপনারা একবার চিন্তা করে দেখেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভেতর যে আত্মবিশ্বাস ছিল, সেই আত্মবিশ্বাসই তাঁকে দৃঢ় করে রেখেছিল। যে কারণে এত কষ্টের পরেও বেঁচে ছিলেন। এরপর তিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলার মাটিতে এসে ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যত রূপরেখা ঘোষণা করেছিলেন।’
আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাত্র সাড়ে তিনটা বছর বঙ্গবন্ধু দেশ পরিচালনার সময় পেয়েছিলেন। এই সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই যুদ্ধের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে গড়ে গিয়েছিলেন। তিনি প্রতিটি কাজের ভিত্তি তৈরি করে দিয়ে গেছেন। একটা সংবিধান পর্যন্ত তিনি দিয়ে গেছেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, যখন বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। শুধু তাঁকে একা না, আমাদের পরিবারের সব সদস্যকে হত্যা করল ঘাতকরা। এমনকি আমার মেজো ফুফু, ছোট ফুফু সব বাড়িতেই তারা হানা দিয়ে হত্যা করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, হয়তো এই ব্যর্থতার খেসারতই দিতে হয়েছে জাতিকে। কারণ জাতির পিতাকে হত্যার পর ১৯/১৯টি ক্যু হয়েছে। অত্যাচার-নির্যাতন চলেছে আমাদের দলের নেতাকর্মীদের ওপর। সেই সময় যদি কেউ সাহস করে দাঁড়াত, হয়তো এ অত্যাচার হতো না। বার বার ক্যু হতো না। বার বার ক্যুর করে একটা দেশকে সম্পূর্ণ ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, যে আদর্শ নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, তাও ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছিল। আমরা ’৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে দেশকে সেই ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছি। দেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০০৯ থেকে টানা ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে আমরা দেশকে সবদিক থেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত যেন থাকে সেজন্য তিনি দেশবাসীর সহযোগিতাও কামনা করেন।