বিজয়ের আটচল্লিশ বছর পেরিয়ে গেল

24

আফতাব চৌধুরী

আমাদের বিজয়ের ৪৯ বছর অতিবাহিত হল। বিজয় লাভের এ বছরগুলোর দিকে ফিরে তাকালে মনে হবে দেশবাসীর সম্মিলিত স্বপ্ন ও প্রত্যাশার পাশাপাশি অপ্রাপ্তিজনিত দুঃখবোধই যেন এখন মাত্রায় বেশী। বিজয়ের এত বছর পরিক্রমা হল, কিন্তু বৃহৎ সংখ্যক দেশবাসীর বহু প্রতীক্ষিত আশা পূর্ণ হল না।
এখন আমাদের চতুর্পাশ্বে দৃশ্যমান হয় দারিদ্র্যের ঘনঘটা। সরকারী হিসাবেই উল্লেখিত আছে দেশের দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা শতকরা চল্লিশের কাছাকাছি। এক থেকে আট বছর বয়স অবধি শিশুদের অপুষ্টিজনিত বৈকল্যের তাড়না হয়েছে এদের মধ্যে অন্তত শতকরা ৪৬ জনের। দু’ বেলা এ স্বাধীন দেশে মনমত ও সক্ষমভাবে খেতে পাওয়ার সুযোগ হয় না শতকরা পঞ্চাশ ভাগ লোকের।
এর সঙ্গে এখন গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো অনুভূত হচ্ছে দেশবাসীদের মধ্যে আয়, উপার্জন ও সামর্থের বিশাল ফারাক। যারা অর্থবান হচ্ছে তারা হচ্ছে আরো অর্থের সমাগমে ধনাঢ্য। আর যারা স্ব স্ব জীবিকার প্রত্যন্তে স্থিত তাদের নিয়মিত আয়ের সুযোগ নিদারুণভাবে স্বল্প। শিক্ষিত ও হাতের কাজে সুপ্রশিক্ষিত তরুণরা চাকুরি হারাচ্ছেন এখন দিনে দিনে প্রভূত সংখ্যায়। নতুন বা বিকল্প চাকুরির সুযোগাদিও এখন যেন অনেক সীমিত। সরকারের বিভিন্ন বিভাগেও অফিসে পদ শূন্য থাকলেও নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না, অথচ হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার চাকুরীর জন্য হন্য হয়ে ঘুরছে।
দেশবাসীর মধ্যে রোজগার ও সুযোগের এ বিশাল ব্যবধান বিশিষ্ট ফরাসী ঐতিহাসিক ও লেখক প্যাটরিক ফ্রেঞ্চের ভাষায় সৃষ্ট করেছে দু’রকমের বাংলাদেশীর। একদল স্বচ্ছ যারা নগরবাসী। অন্য এক বিশাল সংখ্যক সমষ্টি এখন মনে হয় জীবনের উপান্তে বেঁচেবর্তে আছে। এ দু’ রকমের বাংলাদেশীদের জীবন প্রণালী ও জীবনবোধের যে বিস্তর তারতম্য তা সখেদে জন্ম দিয়েছে দু’টি বাংলাদেশকে। প্রথমটির স্বপ্ন বা প্রত্যাশা হয়েছে পূরণ ও বিশাল সংখ্যায় দ্বিতীয়টি রয়ে গেছে দারিদ্র্যের কালিমা মেখে এক প্রত্যন্ত জীবনে বন্দি অবস্থায়।
জনৈক পরিবেশবাদী ও সংবেদনশীল লেখিকার মতে, প্রতি চার জন বাংলাদেশীর মধ্যে কমপক্ষেও একজন এখন সারা দিনে অনাহার বা অর্ধাহারে সুষুপ্ত অবস্থায় কালাতিপাত করে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও দেশে সরকারের কোনো ভাবান্তর হয় না। তাদের অবস্থা যেন এক নিষ্ক্রিয় এবং ভাবলেশহীন পাষান স্তরের মতো। সরকারী বিশাল আকারের অর্থভান্ডার সচেতনভাবে লুট করে নিচ্ছে বিবেকহীন বিস্তর সংখ্যায় রাজনীতিক, আমলা, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, দালাল ও ফড়ে শ্রেণীর লোক। এরাই জনকল্যাণের অর্থ সটান লুণ্ঠন করে তিন-চতুর্থাংশ বাংলাদেশীকে শুধু বঞ্চিত করেনি, তাদের অভাবের বৃত্তে অণুক্ষণ আবর্তিত রয়েছে। মাত্র ক’বছর আগে শেয়ার বাজারের ধ্বসে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব্যবসায়ী তাদের পুঁজি হারিয়ে স্ত্রীর সোনা গয়না বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে নানাভাবে এ সংকট মোকাবেলায় প্রতিশ্র“তি আর আশার বাণী ছাড়া কিছুই শোনা যায়নি।
আমাদের দেশ-নিয়ন্তারা এবং ক্ষমতার যারা অধীশ্বরের ভূমিকায় তাদের দেশচালনার নীতি, কৌশল, প্রকল্প এবং জ্ঞান শুধু যে ভ্রান্ত তা নয়, এগুলো একেবারে অনির্দেশিত। জনমুখী বা জনদরদী নয়। এ বিচ্যুতির বেশিরভাগ দায়ভার গ্রহণ করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। এদের কারোরই যেন জনগণের প্রতি ভালবাসা নেই। কোনো দলই যেন জনদুঃখে আর সমব্যথী হতে চায় না। এ যেন ক্ষমতার অলিন্দের দিকে এক অর্গলহীন অভিযাত্রা এবং সেখানে একবার স্থিত হতে পারলে যেনতেন প্রকারে শুধু ক্ষমতার পূজক হিসেবে জনগণের পাশ কেটে সংকীর্ণ ও ন্যস্ত স্বার্থের শীর্ষে সজোরে অবস্থান তাদের করতেই হবে।
আমাদের গ্রামীণ পরিসরে কৃষিতে সবুজ বিপ্লব এলেও ভূমি সংস্কার বিজ্ঞানসম্মত এবং বাস্তবাদিকভাবে না হওয়ায় গ্রামীন অর্থনীতি এখনো সমর্থ ও পল্লবিত হয়ে উঠতে পারেনি। কৃষি বিপণনে দরকার ছিল কর্পোরেট উপস্থিতি, খুচরো কৃষিদ্রব্যের বাজারজাত হতে একমাত্রিক এক সরবরাহ শৃঙ্খল গ্রাম থেকে মেট্রো নগর পর্যন্ত তা প্রসারিত হওয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু দেশের সরকার সেদিকেও দৃষ্টিপাত করছে না।
এদিকে, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছে। অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি রোধে সরকারের শুধু কথা বলা, আশা প্রদান আর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ ছাড়া কিছুই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। চাল, ডাল, তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের ব্যর্থতার সাধারণ মানুষের মনে হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারকে এদিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে।
দেশকে প্রকৃত অর্থে সচ্ছ্বল, সপ্রাণ এবং সাবলীলভাবে যদি নৈতিক করে তুলতে হয় তবে দরকার হবে এ দেশকে যেটি কুরেকুরে বিনষ্ট করছে সেই দুর্নীতিকে রহিত করা। বর্তমানে মনে হয় সরকার বা প্রশাসনের অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কিছু না কিছু দুর্নীতির সুবাতাস পেয়ে থাকেন। এমতাবস্তায় এ বিজয়ের দিনে আমাদের শপথ নিতে হবে আরো একবার এই বলে যে এক গরীবিমুক্ত, দুর্নীতিরহীত, এবং স্বচ্ছতায় স্থিত করে এ দেশকে আমরা যেন সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।