কাজিরবাজার ডেস্ক :
জিয়া চ্যারিটেবল (দাতব্য) ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দন্ডিত বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন পর্যবেক্ষণসহ খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। আদেশ দেয়ার সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, সর্বসম্মতিক্রমে জামিন আবেদন খারিজ (ডিসমিসড) করা হলো। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, যদি আবেদনকারী (খালেদা জিয়া) প্রয়োজনীয় সম্মতি দেন, তাহলে মেডিকেল বোর্ড দ্রুত তার এ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের (বায়োলজিক এজেন্ট) জন্য পদক্ষেপ নেবে, যা বোর্ড সুপারিশ করেছে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে ছয় সদস্য বিশিষ্ট আপীল বেঞ্চ এ বৃহস্পতিবার পিনপতন নীরবতার মধ্যে এই আদেশ দেয়। বেঞ্চে অপর পাঁচ সদস্য ছিলেন বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি জিনাত আরা, বিচারপতি আবু বরক সিদ্দিকী ও বিচারপতি মোঃ নুরুজ্জামান। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, দুদকের পক্ষে খুরশীদ আলম খান। আর খালেদা জিয়ার পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও জয়নুল আবেদীন। উচ্চাদালতে আদেশের ফলে খালেদা জিয়াকে এখন কারাগারেই থাকতে হবে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়েরকৃত দুটি মামলায় ১০ ও ৭ বছরের কারাদ-ে দ-িত হয়েছেন। আপীলে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৫ বছরের কারাদ- বেড়ে ১০ বছর এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিশেষ আদালতে ৭ বছরের কারাদ-ে দ-িত হন তিনি। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণার পর থেকে পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডে অবস্থিত ঢাকা সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রাখা হয়। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার জামিনের আপীল আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়েছে।
শুনানিকে কেন্দ্র করে সুপ্রীমকোর্টের প্রতিটি প্রবেশপথ, আশপাশ ও আদালত চত্বরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশির পর আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্টদের আদালত চত্বরে প্রবেশ করানো হয়। প্রধান বিচারপতি এজলাসে ৮টি সিসি ক্যামেরা পাঠানো হয়েছে। আদালতে প্রবেশের মুখে প্রথম তল্লাশির পর প্রধান বিচারপতির এজলাসে যেতে আরও তিন দফা তল্লাশি চালানো হয়েছে। তল্লাশির সময় সুপ্রীমকোর্টের গেট থেকে ফাইজুল্লাহ নামে এক আইনজীবীকে আটক করা হয়। বিকেলে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে প্রধান বিচারপতির এজলাসে প্রবেশ করার সময় বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের সঙ্গে নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের তর্ক-বিতর্ক চলে। যাদের আপীল বিভাগের এনরোলমেন্ট নাই তাদের ঢুকতে দেয়নি। এ নিয়ে বিএনপিপন্থী আইনজীবীগণ এজলাস কক্ষের সামনে হট্টগোল শুরু করে। একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি উভয় পক্ষের ৩০ জন করে মোট ৬০ আইনজীবীকে এজলাস কক্ষে প্রবেশের অনুমতি দেন। কিন্তু এক আইনজীবী, সাংবাদিক, বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আদালত কক্ষ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। শুনানি চলাকালে আওয়ামীপন্থী ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীগণ পৃথক পৃথকভাবে আদালত প্রাঙ্গণে মিছিল বের করেন।
চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিস ও আথ্রাইটিসের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল বলে মত দিয়েছে তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যাল বোর্ড। একইসঙ্গে মেডিক্যাল বোর্ড মনে করছে, খালেদা জিয়া রাজি না হওয়ার কারণেই তাকে উন্নত চিকিৎসা দেয়া যায়নি। আপীল বিভাগে দাখিল করা খালেদা জিয়ার সর্বশেষ স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদনে এসব বলা হয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদন দেখে আপীল বিভাগে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত জামিন আবেদন খারিজ করে দেয়।
এদিকে সুপ্রীমকোর্টের আদেশের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আপীল ভিাগের ছয় বিচারপতি নিশ্চয়ই যথেষ্ট বিবেচনা করেই খালেদা জিয়ার জামিন না দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আমরা যেহেতু আইনের শাসনে বিশ^াস করি, তাই আমাদের আদালতের সিদ্ধান্ত মানতেই হবে। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করে দিয়েছে আপীল বিভাগ। জামিনের বিরোধিতা করে আমরা বলেছি, তিনি পৃথক মামলায় ১৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। কারা হেফাজতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার খালেদা জিয়ার সর্বাত্মক চিকিৎসা দিচ্ছে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার বেশ কিছু শারীরিক সমস্যা আগে থেকেই ছিল। তার হাঁটুতে পূর্বেই অপারেশন হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন তাতে দেখা যায় খালেদা জিয়ার অবস্থা স্থিতিশীল। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়নি। তিনি আগে যেমন ছিলেন এখনও তেমনই আছেন। অন্যদিকে এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, জামিন চেয়ে আমরা আইনী লড়াই চালিয়েছি। সাত বছরের সাজায় জামিন না দেয়া নজিরবিহীন। এটি সুপ্রীমকোর্টের জন্য একটি কলঙ্কজনক ঘটনা হয়ে থাকবে।
বৃহস্পতিবার আদালতে মেডিক্যাল বোর্ডের প্রতিবেদনের ওপর এবং তার জামিন আবেদনের ওপর শুনানি হয়। শুনানির শুরুতে খালেদা জিয়ার বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্টার জেনারেল আলী আকবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল বোর্ডের পাঠানো প্রতিবেদন আদালতের কাছে পেশ করেন। শুনানির শুরুতে আপীল বিভাগের তালিকাভুক্ত না হলে আইনজীবীদের আদালত কক্ষে ঢুকতে বাধা দেয়ায় প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি অভিযোগ করেন, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সবাই ভেতরে ঢুকতে পারলেও বিএনপিপন্থীদের তালিকাভুক্তি আছে কি না তা দেখা হচ্ছে। এমনকি তার জুনিয়রকেও ঢুকতে দেয়া হয়নি। পরে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের অন্যতম আইনজীবী জয়নুল আবেদীনের মতামতের ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি দুই পক্ষের ৩০ জন করে আইনজীবী থাকার অনুমতি দেন।
ঠিক হয়, খালেদা জিয়ার মামলার শুনানি শুরুর আগে ৫ মিনিট সময় দেয়া হবে। তখন সবাই বেরিয়ে গিয়ে আবার ঢুকবে। উভয় পক্ষের ৩০ জন করে আদালতকক্ষে থাকতে পারবে। কিন্তু সকাল ১০টার কিছু সময় পর আপীল বিভাগে খালেদার মামলার শুনানি শুরু হলে দেখা যায় কোন পক্ষই বেঁধে দেয়া সংখ্যা মানেনি। এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি। এরপর রেজিস্টার জেনারেল আগের ও বর্তমান দুটি মেডিক্যাল বোর্ডের প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন। আদালতে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সেই প্রতিবেদনের সারমর্ম উপস্থাপন করেন।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সর্বশেষ মেডিক্যাল রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃত করে শুনানিতে বলেন, চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার সম্মতি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে চিকিৎসকরা তার যথাযথ চিকিৎসা দিতে পারছেন না। আমরা তার জামিন আবেদন নাকচ করার আর্জি জানাচ্ছি। বেলা ১টায় শুনানি শেষে মিনিট দশেক বিরতি দিয়ে সিদ্ধান্ত জানায় আপীল বিভাগ। হাইকোর্টের জামিন খারিজের আদেশই তাতে বহাল থাকে।