অপরাধী যেই হোক শাস্তি পেতেই হবে – প্রধানমন্ত্রী

34
বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মানবাধিকার রক্ষায় সরকার আইনের শাসন নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে। অপরাধী যেই হোক শাস্তি তাকে পেতেই হবে। আমাদের সব থেকে যেটা প্রয়োজন মানবাধিকার রক্ষা করার জন্য আইনের শাসন নিশ্চিত করা। তাই যেই অপরাধী হোক, অপরাধীকে শাস্তি পেতেই হবে- এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত। আমরা সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছি। আর মানুষের ন্যায় বিচার নিশ্চিতে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করছে। বিশ্ব মানবাধিকার দিবস-২০১৯ উপলক্ষে মঙ্গলবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা ইস্যুতে বলেন, নিপীড়নের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরাতে আলোচনা চলছে। আমরা কিন্তু এ ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে কোন সংঘাতে যাইনি বরং দেশটির সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছি। যাতে মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিকদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানার উদ্যোগের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন মিয়ানমারে নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে প্রবেশের চেষ্টা করলো, তখন শেখ রেহানা আমাকে বললো- ‘১৬ কোটি জনগণকে খাওয়াতে পারলে এই ১০/১১ লাখ অসহায় লোককে খাওয়াতে পারবে না?’ তাঁর এই কথা শোনার পর আমরা রোহিঙ্গাদের দেশে আশ্রয় দিয়েছি কিন্তু শুধুমাত্র মানবিক কারণে। কারণ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের দেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থীরা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। স্বাধীনতার পর আমরা তাদের ফিরিয়ে এনেছি। মিয়ানমার কিন্তু তা করছে না।
মানবাধিকার ও নাগরিকদের দায়িত্ব সম্পর্কে দেশের মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। মানবাধিকার ও নাগরিকদের দায়িত্ব সম্পর্কে দেশবাসীকে জানাতে হবে। কেননা অধিকার ও দায়িত্ব একে অপরের পরিপূরক। একের দায়িত্ব অপরের অধিকার। আবার একের অধিকার অপরের দায়িত্ব। মানবাধিকার রক্ষায় অধিকার ও দায়িত্ব স্পষ্ট করতে সচেতনতামূলক প্রচার পরিচালনার প্রয়োজন রয়েছে।
এ বছর মানবাধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘মানবাধিকার সুরক্ষায় তারুণ্যের অভিযাত্রা’। প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মানবাধিকার দিবস পালন করে আসছে। ১৯৪৮ সালের এই দিনে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (এনএইচআরসি) ইউএনডিপি’র সহায়তায় গতকাল এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন এবং এনএইচআরসি’র চেয়ারম্যান নাসিমা বেগম অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ এবং জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সিপ্পো অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে মানবাধিকার বিষয়ক ডকুমেন্টারি ভিডিও প্রদর্শনের পাশাপাশি দিবসের থিম সং বাজানো হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিদের হাতে শুভেচ্ছা স্মারক ও উত্তরীয় পরিয়ে দেয়া হয় এবং অতিথিদের হাতে আলোকচিত্র তুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানবাধিকার রক্ষায় এনএইচআরসি নাগরিকদের দায়িত্ব ও তাদের অধিকার সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মানবাধিকার রক্ষায় আইনের শাসনকে খুবই প্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁর সরকার শ্রেণী ও পেশা নির্বিশেষে মানবাধিকার রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানবাধিকার রক্ষার পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গীবাদ, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। এসব অপরাধকে আমাদের দমন করতে হবে। কারণ এই অপরাধীরা সমাজকে ধ্বংস করে। এ নিয়ে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, মানবাধিকার রক্ষার পাশাপাশি সরকার তার কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে। আমরা সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছি। মানুষের ন্যায় বিচার নিশ্চিতে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দিতে ১৯৭৫ সালে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির প্রসঙ্গ তুলে ধরে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, হত্যাকারীরা দম্ভ করে বলত তাদের কেউ বিচার করতে পারবে না। কারণ তাদের ‘ইনডেমনিটি’ (দায়মুক্তি) দেয়া হয়েছিল। আবেগজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার মায়ের কি অপরাধ ছিল বা আমার দুই ভাই? তারা তো মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তাদের নবপরিণীতা বধূদের কি অপরাধ ছিল? আমার ছোট্ট ভাইটি ১০ বছরের। কি অপরাধ ছিল রাসেলের?
দায়মুক্তির পর হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, খুনীদের বিচার না করে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি ভোট চুরি করে দু’জন খুনীকে পার্লামেন্টে সংসদ সদস্য হিসেবে বসানো হয়েছিল। এক খুনীকে বিরোধীদলের নেতার চেয়ারে পর্যন্ত বসানো হয়েছিল। আরেক খুনীকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী করা হয়েছিল।
হত্যাকান্ডের পর ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে দেশে ফেরার পরও বিচার চেয়ে মামলা করতে পারেননি বলে কষ্টের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমি ফিরে এসে মামলা করতে গিয়েছি। বলেছে, আপনি মামলা করতে পারবেন না। কারণ তাদেরকে (খুনী) ইনডেমনিটি দেয়া হয়েছিল। ঠিক এইভাবেই এই দেশে পরিবর্তন আনা হয়েছিল মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। আমি অধিকার পাইনি আমার বাবা-মায়ের হত্যার বিচার চাইতে বা ভাইয়ের হত্যার বিচার চাইতে। আমার অপরাধটা কি ছিল? আমার মতো আরও যারা আপনজন হারিয়েছিল তাদের অপরাধটা কি ছিল?’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা এভাবে খুনীদের পুরস্কৃত করেছিল বা যারা লালন-পালন করেছিল বা যারা খুনীদেরকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়েছিল, তারাও কি একই অপরাধে অপরাধী ছিল না? অন্যায় অবিচার যারা প্রশ্রয় দেয় সেই দেশে বারবার মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে- এটা খুবই স্বাভাবিক। সেই অবস্থা থেকে দেশকে এবং জাতিকে সম্পূর্ণ ফিরিয়ে নিয়ে আসা, আমরা সেই কঠিন কাজটাই করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা একদিকে যেমন মানবাধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিচ্ছি। পাশাপাশি মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, দুর্নীতির বিরুদ্ধেও আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এগুলো সমাজকে নষ্ট করে, ধ্বংস করে। কাজেই সমাজ থেকে এই জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস, মাদক, দুর্নীতি; এটাও প্রতিরোধ করতে হবে। এজন্য জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সম্প্রতি নারী নির্যাতনসহ চাঞ্চল্যকর কিছু ঘটনার বিচার দ্রুত কার্যকর করার জন্য বিচারবিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা দ্রুত সেটার ব্যবস্থা নিয়েছি। আমাদের বিচার খুব স্বাধীনভাবে কাজ করে। সেই স্বাধীনতাও আমরা বিচার বিভাগকে নিশ্চিত করে দিয়েছি। মানুষ যেন ন্যায় বিচার পায় আমরা এইটুকুই চাই।
মানবাধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে আমাদের নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠবে, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। তরুণরাই তো এদেশের আগামীর ভবিষ্যত। তারাই গড়ে তুলবে বাংলাদেশ এবং তারাই এই অভিযাত্রাকে আরও বেশি গতিবেগ এনে দেবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীসহ সকল মানুষের মানবাধিকার সুরক্ষা, অর্থনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিতকরণে সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে জানিয়ে তিনি বলেন, সকল মানবাধিকার লঙ্ঘনে বিচারের মাধ্যমে দেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা আমরা হাতে নিয়েছি।
সরকারপ্রধান আরও বলেন, যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘন হোক আমরা এ বিষয়ে সোচ্চার। কারণ আমরা সব সময় মনে করি সরকার মানে জনগণের সেবক, জনগণের কাজ করে- সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সব শ্রেণী পেশার মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত করে সবার জন্য সুন্দর জীবন নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব।
মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কমিশন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ সরকারের কাছে প্রেরণ করছে এবং সরকার গুরুত্বের সঙ্গে কমিশনের সে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। যাতে যথাযথ বাস্তবায়ন হয় সে পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি। জনসচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, দেশের জনগণকে মানবাধিকার ও নাগরিক দায়িত্ব সম্পর্কে ভালভাবে সচেতন করে গড়ে তোলা দরকার।
বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে কতগুলো কেস (মামলা) আপনারা দেখেছেন, আমরা কিন্তু দ্রুত সেটার ব্যবস্থা নিয়েছি এবং আমাদের বিচার খুব স্বাধীনভাবে কাজ করে সেই স্বাধীনতাও আমরা বিচার বিভাগের নিশ্চিত করে দিয়েছি। মানুষ যেন ন্যায় বিচার পায় সেদিকে লক্ষ্য রেখে।