কাজিরবাজার ডেস্ক :
মিথ্যা তথ্য দিয়ে জালিয়াতি করে ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) থেকে ৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আত্মসাতের মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ (এস কে সিনহা) মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে দুদক। দুদক কমিশনার বেনজির আহমেদ সোমবার ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ কে এম ইমরুল কায়েসের আদালতে এই চার্জশীট জমা দেন বলে জানান আদালতে দুদকের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা মোঃ জুলফিকার। এর আগে গত চার ডিসেম্বর দুদক চার্জশীটটি আদালতের দাখিলের জন্য অনুমোদন দেয়। উল্লেখ্য, তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে অনেক আগেই এস কে সিনহার ব্যাংক হিসাবের চার কোটি টাকা জব্দ করা হয়। দুদকের এই মামলায় ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক জিয়া উদ্দিন আহমেদও আসামি ছিলেন। তবে চার্জশীটে তাকে অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। অন্যদিকে মামলায় নাম না থাকলেও চার্জশীটে বাবুল চিশতিকে নতুন করে আসামি করা হয়েছে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অসৎউদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে নিজেরা লাভবান ও অন্যদের লাভবান করে অবৈধপন্থায় ভুয়া ঋণ সৃষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে তা স্থানান্তর করে নগদে উত্তোলন ও বিভিন্ন পে-অর্ডারের মাধ্যমে স্থানান্তর ও গোপনে পাচার করেছেন। সিনহা ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন, ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী, সাবেক এমডি এ কে এম শামীম, সাবেক এসইভিপি গাজী সালাহউদ্দিন, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, সাফিউদ্দিন আসকারী, ভাইস প্রেসিডেন্ট মোঃ লুৎফুল হক, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা শাহজাহান, একই এলাকার নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা, রণজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায়।
বিচারপতি সিনহা নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্যে দুই বছর আগে বিদেশে পাড়ি জমানোর পর দুদক অভিযোগ পায়, তিনি ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ব্যবসায়ী পরিচয়ে দুই ব্যক্তির নেওয়া ঋণের চার কোটি টাকা নিজের এ্যাকাউন্টে নিয়েছিলেন। অভিযোগ পেয়ে ওই বছরই তদন্তে নামে দুদক। দীর্ঘ তদন্তের পর এ বছরের ১০ জুলাই সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন।
মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, ’১৬ সালের ৬ নবেম্বর আসামি শাহজাহান ও নিরঞ্জন সাহা ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় আলাদা দুটি এ্যাকাউন্ট খোলেন। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য পরদিন তারা ওই ব্যাংক থেকে দুই কোটি করে মোট চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন। তাদের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ও ঋণের আবেদনে উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ৫১ নম্বর বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়, যার মালিক ছিলেন তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। আবেদনে ঋণের জামানত হিসেবে আসামি রণজিৎ সাহার স্ত্রী সান্ত্রী রায়ের নামে সাভারের ৩২ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করা হয়। ওই দম্পতি এস কে সিনহার পূর্বপরিচিত ও ঘনিষ্ঠ। দুদক বলছে, ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি এ কে এম শামীম কোন ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই, ব্যাংকের নিয়ম-নীতি না মেনে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ দুটি অনুমোদন করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ৭ নবেম্বর ঋণের জন্য আবেদনের পর অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে তা অনুমোদন রাখা হয়। পরদিন মোট চার কোটি টাকার দুটি পে-অর্ডার ইস্যু করা হয় এস কে সিনহার নামে। ৯ নবেম্বর সোনালী ব্যাংকের সুপ্রীমকোর্ট শাখায় এস কে সিনহার এ্যাকাউন্টে তা জমা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে ক্যাশ, চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে ওই টাকা উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে এস কে সিনহার ভাইয়ের নামে শাহজালাল ব্যাংকের উত্তরা শাখার এ্যাকাউন্টে দুটি চেকে দুই কোটি ২৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয় ওই বছরের ২৮ নবেম্বর। এজাহারে বলা হয়, আসামি রণজিৎ শাহা দ্রুত ঋণ অনুমোদনের জন্য প্রধান বিচারপতির প্রভাব ব্যবহার করেন। রণজিৎ সাহার ভাতিজা হলেন ঋণ গ্রহীতা নিরঞ্জন এবং অপর ঋণগ্রহীতা শাহজাহান ও রণজিতের ছোটবেলার বন্ধু। ঋণ গ্রহীতা দু’জনই অত্যন্ত গরিব ও দুস্থ। তারা কখনও ব্যবসা-বাণিজ্য করেননি।
উল্লেখ্য, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে নানা দাবির মুখে ১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে ছুটিতে যান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। পরে বিদেশ থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে কানাডায় আছেন। তবে দুর্নীতির এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ওই সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে সিনহার ভাই অনন্ত সিনহার নামে একটি বাড়ি কেনার খবর গণমাধ্যমে আসে। তা নিয়েও অনুসন্ধান চালায় দুদক। বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১ অভিযোগ পাওয়ার কথা সুপ্রীমকোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়।