৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত ॥ এসকে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট অনুমোদন দুদকের

18

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা) সাবেক ফারমার্স ব্যাংকে (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) জালিয়াতি করে চার কোটি টাকা আত্মসাতে জড়িত থাকার অভিযোগের প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ অভিযোগে সিনহাসহ মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার চার্জশীট অনুমোদন করেছে দুদক। মামলাটির বিচারকার্য শুরু করতে যে কোন দিন আদালতে এ চার্জশীট জমা দেবে সংস্থাটি। বুধবার কমিশনের সভায় এ চার্জশীটের অনুমোদন দেয়া হয়।
দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) সাঈদ মাহবুব খান সাংবাদিকদের কাছে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, এস কে সিনহার বিরুদ্ধে দুজন সাধারণ ব্যক্তির নামে চার কোটি টাকার ভুয়া লোন সৃষ্টি করে নিজের একাউন্টে নিয়ে আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা হয়েছিল। এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন বেনজির আহমেদ। এই মামলাতে এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করেছেন, এটি কমিশন অনুমোদন দিয়েছে। তিনি জানান, এছাড়া মৃত হিসেবে প্রমাণ মেলায় চার্জশীট থেকে এক আসামির নাম বাদ দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে নতুন একজনের নামও চার্জশীটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, যার নাম বাদ দেয়া হয়েছে তিনি হচ্ছেন ফারমার্স ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও গুলশান শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক মোঃ জিয়াউদ্দিন আহমেদ। নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ব্যাংকটির অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীকে।
চার্জশীটভুক্ত অপর আসামিরা হচ্ছেন, ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম শামীম, ব্যাংকটির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক ক্রেডিট প্রধান গাজী সালাহউদ্দিন, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, গুলশান শাখার ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট শাফিউদ্দিন আসকারী, ভাইস প্রেসিডেন্ট লুৎফুল হক, এসকে সিনহার কথিত বেসরকারী পিএস রণজিৎ চন্দ্র সাহা, রণজিতের স্ত্রী সান্ত্রী রায় সিমি, টাঙ্গাইলের মোঃ শাহজাহান ও নিরঞ্জন সাহা। উল্লেখ্য, গত ১০ জুলাই ঋণ জালিয়াতি এবং ৪ কোটি টাকা আত্মসাতে জড়িত থাকার অভিযোগে এসকে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১-এ দায়ের এ মামলার বাদী হলেন দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন।
দুদক সূত্র জানায়, ঋণ আবেদন দুটি কোন রকম যাচাই-বাছাই করা হয়নি। রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণ এবং ব্যাংকের কোন নিয়মনীতিও মানা হয়নি। আসামি মোঃ শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা ২০১৬ সালের ৬ নবেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় দুটি চলতি হিসাব খোলেন। ৭ নবেম্বর তারা ২ কোটি করে ৪ কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন। ব্যাংক হিসাব খোলা ও ঋণ আবেদনপত্রে দু’জনই বাড়ি নম্বর ৫১, সড়ক নম্বর ১২, সেক্টর ১০, উত্তরা আবাসিক এলাকার এই ঠিকানা উল্লেখ করেন। ওই বাড়ি সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ঋণ আবেদনে জামানত হিসেবে রণজিৎ চন্দ্র সাহার স্ত্রী সান্ত্রী রায় সিমির সাভারের ৩২ শতাংশ জমি দেখানো হয়। এই দুজনই এসকে সিনহার পূর্বপরিচিত।
প্রসঙ্গত বিচারপতি সিনহা নানা নাটকীয় ঘটনার মধ্যে দুই বছর আগে বিদেশে পাড়ি জমানোর পর দুদক অভিযোগ পায়, তিনি ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) গুলশান শাখা থেকে ব্যবসায়ী পরিচয়ে দুই ব্যক্তির নেয়া ঋণের চার কোটি টাকা নিজের এ্যাকাউন্টে নিয়েছিলেন। অভিযোগ পেয়ে ওই বছরই তদন্তে নামে দুদক। দীর্ঘ তদন্তের পর চলতি বছরের ১০ জুলাই সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন। মামলায় দণ্ডবিধি-১৮৬০ এর ৪০৯, ৪২০, ১০৯ ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) এবং মানিল্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২), (৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে।
মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ৬ নবেম্বর আসামি শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখায় আলাদা দুইটি এ্যাকাউন্ট খোলেন। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য পরদিন তারা ওই ব্যাংক থেকে দুই কোটি টাকা করে মোট চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন। তাদের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট এবং ঋণের আবেদনে উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ৫১ নম্বর বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়, যার মালিক ছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।
ঋণের আবেদনে জামানত হিসেবে আসামি রনজিৎ চন্দ্রের স্ত্রী সান্ত্রী রায়ের নামে সাভারের ৩২ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করা হয়। ওই দম্পতি এস কে সিনহার পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলার এজাহারে। দুদকের মতে,ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি এ কে এম শামীম কোন ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই, ব্যাংকের নিয়ম-নীতি না মেনে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ দুটি অনুমোদন করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ৭ নবেম্বর ঋণের আবেদন হওয়ার পর অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে তা অনুমোদন করা হয়। পরদিন এস কে সিনহার নামে মোট চার কোটি টাকার দুটি পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়। ৯ নবেম্বর সোনালী ব্যাংকের সুপ্রীমকোর্ট শাখায় এস কে সিনহার এ্যাকাউন্টে জমা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে ক্যাশ, চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে ওই টাকা উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে এস কে সিনহার ভাইয়ের নামে শাহজালাল ব্যাংকের উত্তরা শাখার এ্যাকাউন্টে ওই বছরের ২৮ নবেম্বর দুটি চেকে দুই কোটি ২৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয়।
এজাহারে বলা হয়, আসামি রনজিৎ চন্দ্র ঋণ দ্রুত অনুমোদনের জন্য প্রধান বিচারপতির প্রভাব ব্যবহার করেন। রনজিৎ চন্দ্রের ভাতিজা হলেন ঋণ গ্রহীতা নিরঞ্জন এবং অপর ঋণ গ্রহীতা শাহজাহান ও রনজিৎ ছোটবেলার বন্ধু। ঋণ গ্রহীতা দুইজনই অত্যন্ত গরিব ও দুস্থ। তারা কখনও ব্যবসা-বাণিজ্য করেননি। উল্লেখ্য, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে নানা দাবির মুখে ২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে ছুটিতে যান তখনকার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। পরে বিদেশ থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। তিনি এখন আছেন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে কানাডায়। তবে দুর্নীতির এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
ওই সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে সিনহার ভাই অনন্ত কুমার সিনহার নামে একটি বাড়ি কেনার খবর গণমাধ্যমে আসে। সেটা নিয়েও অনুসন্ধান চালায় দুদক। বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ পাওয়ার কথা সুপ্রীমকোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়।