বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রপতি ॥ ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার জন্য নীতি ও আদর্শের সঙ্গে আপোষ করবেন না

14
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ১১তম সমাবর্তনে বক্তব্য রাখছেন রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো. আবদুল হামিদ।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ঘটছে অপ্রীতিকর নানা ঘটনা। এসব ঘটনার খবর গণমাধ্যমে দেখে মর্মাহত হচ্ছেন সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। নীতি ও আদর্শের সঙ্গে আপস না করতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আর সত্য ও ন্যায়কে সমুন্নত রাখতে শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
শনিবার বিকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্টেডিয়ামে আয়োজিত একাদশ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি এসব কথা বলেন।
শিক্ষকদের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি বলেন, সাধারণ মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদার উচ্চাসনেই দেখতে চায়। তাই ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার জন্য নীতি ও আদর্শের সঙ্গে আপস করবেন না।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আজকাল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যাচ্ছে শিক্ষকরা প্রশাসনের বিভিন্ন পদ-পদবি পাওয়ার লোভে লবিংয়ে ব্যস্ত। অনেকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করতেও পিছপা হন না। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ভুলে গিয়ে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট লেনদেনে সম্পৃক্ত হন। এটি অত্যন্ত অসম্মানের ও অমর্যাদাকর।’
আবদুল হামিদ বলেন, ‘শিক্ষকরা উন্নত জাতি তৈরির মহান কারিগর। শিক্ষকের কথা কেবল বক্তৃতা নয়- তা বাণী। বাণী শ্রোতার বুদ্ধি ও বিবেককে জাগ্রত করে। বাণী শ্রোতার অন্তরে জ্ঞানের মশাল প্রজ্জ্বলিত করে। আদর্শ, প্রচেষ্টা ও বৃত্তি ছাড়া পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস মূল্যহীন। তাই একজন শিক্ষককে আদর্শ ও ন্যায়-নীতির প্রতীক হতে হবে। কিন্তু সম্প্রতি গণমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রকাশিত খবর আচার্য হিসেবে আমাকে মর্মাহত করে।’
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনা উল্লেখ করে আব্দুল হামিদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় মূলত জ্ঞানচর্চা, মুক্তচিন্তা ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের ক্ষেত্র। এখানে নিরন্তর গবেষণার মধ্যে দিয়ে নবতর জ্ঞান ও বহুমুখী সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মননে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হয়। কিন্তু সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কিছু কিছু ঘটনা এই মানবিক মূল্যবোধের বিকাশকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমরা এই ব্যাপারে বিশেষভাবে সচেতন থাকি এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানচর্চা, মুক্তচিন্তা ও মানবিক মূল্যবোধের পীঠস্থান হিসেবে সমুন্নত রাখি।’
গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘তোমরা দেশের উচ্চতর মানবসম্পদ। দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে ও অগ্রগতি নির্ভর করছে তোমাদের ওপর। তোমাদের তারুণ্য, জ্ঞান, মেধা ও প্রজ্ঞা হবে দেশের উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে একজন গ্রাজুয়েট হিসেবে সবসময়ে সত্য ও ন্যায়কে সমুন্নত রাখবে। নৈতিকতা ও দৃঢ়তা দিয়ে দুর্নীতি ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। রাষ্ট্রের বিবেকবান নাগরিক হিসেবে আমাদের কাছে জাতির প্রত্যাশা, তোমরা কখনো অর্জিত ডিগ্রির মর্যাদা, ব্যক্তিগত সম্মানবোধ আর নৈতিকতা ভূলুণ্ঠিত করবে না। বিবেকের কাছে কখনো পরাজিত হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘মনে রাখবে এই দেশের খেটে খাওয়া মানুষ তাদের শ্রম ও ঘামের বিনিময়ে তোমাদের শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করেছে। তাদের কাছে তোমরা ঋণী। এখন সময় এসেছে সেই ঋণ পরিশোধ করার। তোমরা তোমাদের মেধা, কর্ম ও সততা দিয়ে দেশ ও জনগণের কল্যাণ করতে পারলে সেই ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হবে। মনে রাখতে হবে বাঙালির শেকড় এই সাধারণ জনগণের মধ্যেই প্রোথিত।’
বক্তব্যের শুরুতে রাষ্ট্রপতি অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধসহ স্বাধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের স্মরণ করেন। এর আগে বিকাল তিনটায় রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। এ সময় তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে উষ্ণ অভ্যর্থনা ও গার্ড অব অনার দেয়া হয়।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সমাবর্তন বক্তা অধ্যাপক ড. রঞ্জন চক্রবর্তী, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা ও অধ্যাপক ড. চৌধুরী মো. জাকারিয়া, রেজিস্ট্রার আব্দুল বারী, কোষাধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক।
এই সমাবর্তনে কলা, আইন, বিজ্ঞান, বিজনেস স্টাডিজ, সামাজিক বিজ্ঞান, জীব ও ভূ-বিজ্ঞান, কৃষি, প্রকৌশল ও চারুকলা অনুষদের মোট তিন হাজার ৪৩১ জন গ্রাজুয়েট অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও এমবিবিএস ও বিডিএস ডিগ্রির ৬৩৪ জন অংশগ্রহণ করেন।
রবিবার রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের (রুয়েট) পঞ্চম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হবে। এতেও সভাপতিত্ব করবেন রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য আব্দুল হামিদ। রুয়েট সমাবর্তনে দুই হাজার ৫৮৬ জন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারীরা অংশগ্রহণ করবেন।