জাতীয় পার্টি ও বিএনপি সৃষ্টি হয়েছে অবৈধভাবে ষড়যন্ত্র করে – প্রধানমন্ত্রী

47
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পায়রা উড়িয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন উদ্বোধন করছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা অগ্নিসন্ত্রাসী-দুর্নীতিবাজ-জঙ্গীবাদী বিএনপি-জামায়াত জোট যেন ক্ষমতায় ফিরে আসতে না পারে সেজন্য দলের নেতাকর্মীসহ দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, যারা সন্ত্রাস করে, অগ্নিসন্ত্রাস করে পুড়িয়ে জীবন্ত মানুষকে হত্যা করে, যারা সন্ত্রাস-দুর্নীতি-মানুষ খুন ছাড়া আর কিছুই বোঝে না- তারা যেন আর ফিরে আসতে না পারে। আর কখনও এসব হায়েনার দল এদেশের মানুষের বুকে চেপে বসতে পারবে না, মানুষের রক্ত চুষে খেতে পারবে না। কোন দুর্নীতিবাজ-সন্ত্রাসী ও অগ্নিসন্ত্রাস করে আগুন দিয়ে যারা মানুষ হত্যা করেছে- তারা আর কখনও মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারবে না।
চলমান সন্ত্রাস ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সন্ত্রাস জঙ্গীবাদ ও মাদকের বিরুদ্ধে যে অভিযান, সেটা অব্যাহত থাকবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানও চলবে। কারণ জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ তাদের কল্যাণেই ব্যয় হবে। কারও ভোগ-বিলাসের জন্য এটা ব্যয় হবে না। কেউ অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করবেন, বিলাসবহুল জীবনযাপন করবেন, আর যিনি সৎভাবে জীবনযাপন করবেন তিনি সাদাসিধে জীবনযাপন করে তার জীবনটাকে নিয়ে কষ্ট পাবেন, এটা কিন্তু হতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে বিরানি-পোলাও খাওয়ার থেকে বা কোন ব্রান্ডের পোশাক পরার থেকে সাদাসিধে জীবনযাপন করা অনেক অনেক সম্মানের। অন্তত সারাক্ষণ ওই অবৈধ চোরা টাকা এটা মনে আসবে না। শান্তিতে ঘুমানো যাবে। চোরা টাকা, দুর্নীতির টাকা, অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে যতই বিলাসিতা করুক, মানুষ মুখে হয়ত খুব বাহবা দেবে, কিন্তু পেছনে একটা গালি দেবে- এই ব্যাটা দুর্নীতিবাজ, চোর। সেই গালিটা হয়ত শোনা যাবে না, বোঝা যাবে না। কিন্তু সেই গালিটা খেতে হয়। এই কথাটা মনে রাখতে হবে। জাতির পিতা সারাজীবন সাদাসিধে জীবনযাপন করে গেছেন। কাজেই আপনারা যারা তার আদর্শের সৈনিক, তাদেরও সেই অনুযায়ী চলতে হবে।
টাকা বানানোর নেশাকে ‘রোগ’ হিসেবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আসলে টাকা বানানো একটা রোগ, এটাও একটা ব্যাধি, এটা একটা অসুস্থতা। একবার যে টাকা বানাতে থাকে তার শুধু টাকা বানাতেই ইচ্ছে করে। কিন্তু ওই টাকার ফলে ছেলেমেয়ে বিপথে যাবে। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা নষ্ট হবে। মাদকাসক্ত হবে সেটা দেখারও সময় নেই, টাকার পেছনে ছুটছে তো ছুটছেই। আর নিজের পরিবার ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। কাজেই এই ধরনের একটা সামাজিক অবস্থা আমরা চাই না। আমরা চাই সৎ পথে কামাই করে যে চলবে, সে সম্মানের সঙ্গে চলবে, সৎ পথে কামাই করে যে থাকবে সে সমাজেও সম্মান পাবে।
শনিবার রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। খালেদা জিয়ার কারাগারে থাকা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া এতিমের কথা বলে টাকা এনেছেন। সেই টাকা এতিমদের না দিয়ে খালেদা জিয়ার এ্যাকাউন্টে চলে গেছে। অর্থাৎ সেই টাকা তিনি আত্মসাত করেছেন। এই দুর্নীতির দায়ে আদালতের রায়ে তিনি কারাগারে গেছেন। এটাকে অনেকে রাজনৈতিক মামলায় রং দেয়ার চেষ্টা করছে। তাই এটা কোন রাজনৈতিক মামলা নয়, পরিষ্কার দুর্নীতির মামলা। আর আমরা খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কোন রাজনৈতিক মামলা দেইনি, এই মামলা তারই প্রিয় ব্যক্তিরা সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসব মামলা দিয়েছে।
এর আগে সকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্মেলনস্থলে পৌঁছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময় দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের নেতারা। ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরাও দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন। পরে শান্তির প্রতীক পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর নৌকাকৃতির সুবিশাল ও দৃষ্টিনন্দন সম্মেলন মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তাকে ফুলের তোড়া ও ক্রেস্ট দিয়ে এবং ব্যাজ পরিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। পরে মহানগর নেতা সালাহউদ্দিন বাদল ও মতিন ভুঁইয়ার পরিচালনায় বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান ও নৃত্য পরিবেশন করা হয়।
এর পর পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনের আনুষ্ঠানিকতা। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী আবুল হাসনাতের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদের সঞ্চালনায় সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি একেএম রহমতুল্লাহ এমপি। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আলোচনার শুরুতেই সাধারণ সম্পাদকের সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করেন উত্তরের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান ও দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ। শোক প্রস্তাব পাঠ করেন উত্তর ও দক্ষিণের দফতর সম্পাদক এম সাইফুল্লাহ সাইফুল ও গোলাম রাব্বানী বাবলু।
প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনের উদ্বোধন করে আরও বলেন, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করে তাদের উন্নয়ন ও ভাগ্যের পরিবর্তন করাই আওয়ামী লীগের লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ কাজ করেছে বলেই আজকের বাংলাদেশ এত উন্নত হতে পেরেছে। আজকের বাংলাদেশ বিশে^ সম্মান পাচ্ছে, উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমরা অতীত সরকারগুলোর মতো সেরকম বিলাসব্যসনে গা ভাসালে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হতো না। এই বাংলাদেশ বিশে^ সম্মানও পেত না।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের নামে সাম্প্রতিক সন্ত্রাস ও ভাংচুরের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতে আমার বিরুদ্ধে ১২টি মিথ্যা মামলা দিয়েছিল। কিন্তু খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতির মামলা দেয়নি। বরং তার (খালেদা জিয়া) পছন্দের প্রিয়ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন ও ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়েছে। দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত সেই আসামির জন্যই হামলা হলো, ভাংচুর হলো। তবে এটা বিএনপি নেতাকর্মীদের পুরনো অভ্যাস। এটাই তারা সব সময়ই করেছে। নির্বাচন বানচালের আন্দোলনের নামে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে তারা সারাদেশে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য করেছে, অগ্নিসন্ত্রাস করে শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। ক্ষমতায় থাকতে তারা দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও মানিলন্ডারিং করেছে। খুন, সন্ত্রাস, নির্যাতন, জঙ্গীবাদ সৃষ্টি আর দুর্নীতিই ছিল তাদের নীতি।
বক্তব্যের শুরুতে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ভূমিকা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তার (শেখ হাসিনা) মুক্তির আন্দোলনে মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাত্র ১৫ দিনে ২৫ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তার মুক্তির জন্য তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে জমা দিয়েছিলেন। এটা না হলে সেদিন তার মুক্তি ও গণতন্ত্র ফিরে পাওয়া কঠিন হতো।
জাতির পিতার ত্যাগের আদর্শে মানুষের পাশে থেকে তাদের কল্যাণে কাজ করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাই হয়েছিল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে। আওয়ামী লীগ সব সময়ই মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কাজ করেছে। আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শ হলো জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করা, তাদের জীবনমান নিশ্চিত করা। জাতির পিতা এদেশের মানুষকে সংগঠিত করে দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। মন্ত্রিত্বের পদ ছেড়ে দিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ নিয়েছিলেন কেবল জনগণের সেবা করার জন্য। কাজেই আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মীর বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দীক্ষা নিতে হবে।
জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দলগুলো সৃষ্টি হয়েছে অবৈধভাবে, ষড়যন্ত্র করে। ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় বসে থেকে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে দলগুলো গঠন করা হয়েছে। দলগুলো মাটি থেকে গড়ে ওঠেনি। কোন বিরোধী দলে থেকেও গড়ে ওঠেনি। দলগুলো মানুষের কথা চিন্তা করে গড়ে ওঠেনি। মানুষের জন্য কাজ করা, মানুষের উপকার করা, এগুলো তারা বোঝে না। দুর্নীতি-খুন-সন্ত্রাস-অর্থ পাচার করা এসবই তারা বোঝে। কাজেই তাদের চরিত্রটা হচ্ছে আলাদা। এরা হচ্ছে সুবিধাবাদী, খাওয়াপার্টি। এরা মানুষকে কিছু দিতে পারে না।
দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের আদর্শ ও নীতি নিয়ে পথ চলার আহ্বান জানিয়ে বলেনÑ কী পেলাম সেটা নয়, মানুষের জন্য কতটুকু করতে পারলাম সেই চিন্তা করতে হবে। জনগণকে কী দিতে পারলাম সেই চিন্তা করতে হবে। জনগণের কল্যাণ কিসে হবে সেই চিন্তা করতে হবে। জনগণের অর্থ ভোগবিলাসে ব্যয় হবে না। জনগণের অর্থ জনগণের জন্য ব্যয় হবে। আজ আমরা সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছি, এটা অব্যাহত থাকবে।