বাজার সিন্ডিকেটদের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা গড়ে তোলার বিকল্প নেই !

28

জেড.এম.শামসুল
আমাদের দেশে একটি অনিয়মকে নিয়মে পরিণত হয়েছে, যা বিশ্বের কোন দেশে হয়ত; শোনা যায় না। বিশ্বের যত সভ্য দেশ রয়েছে, সে গুলোতে মানুষ-মানুষের কল্যাণে যত-বেশী সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারে, তাতে সে তত সন্তুষ্টতা বোধ করে। কিন্তু আমাদের দেশে ‘মানুষ-মানুষের জন্যে‘ শ্লোগানটি শুধু বাজ্যিকতাই বেশী। বিশ্বের প্রতিটি দেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুসের বসবাস রয়েছে, এসব ধর্ম-বিশ্বাসীরা তাদের ধর্মীয় উৎসব করে থাকে, আমাদের দেশে সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষের বসবাস। অথচ বাংলাদেশে মুসলমান ব্যবসায়ীদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনতে, সরকারী নির্দেশ যেমন কাজে আসছে না, তেমনি ধর্মীয় আদেশ-নিষেধ মানছে না। এ সব বাজার সিন্ডিকেটদের বিরুদ্ধে এদেরকে সামাজিক ভাবে বয়কটসহ গণসচেতনতা গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশ হিসাবে খ্যাত আমাদের দেশে মানবতা, মানুষ্যত্ব বেশী থাকার কথা থাকলেও কোন ধরনের মনুষ্যত্বের চরম অভাব রয়েছে। ইসলামী ধর্মীয় মতে মুসলমানদের শবে-বরাত, মাহে-রমজান, ঈদুল-ফিতর, ঈদুল-আযহা, শুধু এ দিন গুলো মুসলমানরা উৎসব হিসাবে পালন করে থাকে। কিন্তু এ দিন গুলোর আগমনের মাস-খানেক পূর্বেই ব্যবসায়ী নামক প্রতারকরা যে কোন অজুহাত দেখিয়ে পণ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করে ইচ্ছা মাফিক ফায়দা হাসিল করে নেয়। অথচ বিশ্বের প্রতিটি দেশে ধর্মীয় উৎসবের সময়ে পণ্য দ্রব্যের কাটতি বেশীর কারণে সুলভ মূল্যে পাওয়া গেলেও আমাদের দেশে পণ্য-দ্রব্যের কাটতি বেশী দেখে সারা বছরের অর্থ যোগার করতে গিয়ে, সাধারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে একের অধিক ফায়দা আদায় করে নেয় ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের এ অপকর্মের বিরুদ্ধে আইনী কোন ব্যবস্থা যথাযথ ভাবে প্রয়োগ না হওয়ায়, তাদের অপকর্ম দিন-দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এসব বাজার সিন্ডিকেটরা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের সাথে হাত মিলিয়ে নানা ধরনের চক্রান্ত শুরু করেছিল। দেশ স¦াধীনতা লাভের বছর যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতিরসহ বিভিন্ন অজুহাতে পণ্যদ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। ৭২ এয়ে দেশে শরণার্থীরা প্রবেশ করার মুহূর্তে নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বাড়িয়ে দেয়া হয়।
সদ্য স্বাধীন দেশে ষড়যন্ত্রকারী স্বাধীনতা বিরোধী চক্র মানুষের নিত্য-প্রয়োজনীয় পণ্যদব্য কেরোসিন, দিয়াশলাই, লবণ, ধান-চালের মূল্য বৃদ্ধি করে দেয়, অন্যদিকে কতিপয় ব্যক্তিরা রাজনীতির নামে বিশৃংখলার সৃষ্টি করে দেয়। দেশে দেখা দেয় অভাব-অনটন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার বিধেশ থেকে নিত্য-প্রয়োজনীয় পণ্য-দ্রব্য আমদানীর জন্য ব্যবস্থা নিলেন। দেশ-বিরোধী চক্র জাহাজ ভর্তি পণ্য-দ্রব্য নিয়ে আসার পথে ষড়যন্ত্র করে জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। দেশে দেখা দেয় পণ্য-দ্রব্যের অভাব। পণ্যদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে আনতে দেশের আইন-শৃংখলা বাহিনীসহ স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দল তথা ন্যাপ, সিপিবি ও আওয়ামী লীগের সরকারের নেতৃত্বে নানান কমিটি গঠিত হয়।
গণসংগঠন সহ ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র লীগের নেতা-কর্মীরা বসে থাকেনি, জেলা থেকে থানা সমূহে সংগ্রাম কমিটি গঠন করে নিত্য-প্রয়োজনীয় পণ্য-দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। এ সময়ে আমরা জকিগঞ্জ থানায় ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র লীগ যৌথ ছাত্র ফেডারেশন গঠন করে রিলিফ চোরও পণ্য-দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি এম.এ.রহিম. সাধারণ সম্পাদক জেড.এম.শামসুল সহ ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র লীগের এক বিশাল কর্মী বাহিনী ছাড়াও জকিগঞ্জের দায়িত্ব প্রাপ্ত বিডিআর বাহিনীর কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা, রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের পূর্ণ সহযোগিতায় জকিগঞ্জ, বাবুরবাজার, কালীগঞ্জবাজার.সড়কেরবাজার, শাহ-গলীর বাজার সহ অন্যান্য বাজার সমূহে ঘন-ঘন অভিযান চালিয়ে বাজার স্বাভাবিক করন ছাড়াও স্থানে-স্থানে বেকার যুবকদেরকে নিজস্ব উদ্যোগে কর্মের ব্যবস্থা করণ সহ ৭৪ এর বাম্পার কৃষি ফলন হওয়ার মুহূর্তে দেশ-বিরোধী কুখ্যাত মস্তাক চক্র তাদের ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা চালিয়ে যায়। দেশ-বিরোধী চক্র বিভিন্ন সময়ে একটি অজুহাত দেখিয়ে নানা ধরনের বিশৃংখলার সৃষ্টি করতে দ্বিধা বোধ করে না। তারা ৭৩ থেকে ৭৫ পর্যন্ত পণ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। দেশ যখন স্বাভাবিক গতিতে চলছিল, তখনই দেশ-বিরোধী চক্র ষড়যন্ত্র করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের সদস্যদেরকে নির্মম ভাবে হত্যা করে, স্বাধীনতা বিরোধী চক্র তাদের প্রভুর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিদ্বারা দেশ পরিচালনা করে। বর্তমান সরকার স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ পরিচালনা করছে, তা স্বাধীনতা বিরোধী চক্র মেনে নিতে পারছে না। তাই তারা বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র শুরু করছে। তারা সাধারণ মানুষের নিত্য-প্রয়োজনীয় পণ্য-দ্রব্য নিয়ে খেলা করছে। তাই মানুষের নিত্যপণ্য নিয়ে যেভাবে ছিনিমিনি খেলতে না পারে, সে ব্যাপারে কঠোর আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প নেই।
দেশ-বিরোধী চক্র দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করে আসছে, বর্তমানে মানুষের খাবার নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করছে, যা কোন বিবেকমান ব্যক্তির কাজ নয়। তাদেরকে বিবেক প্রতিবন্ধী ছাড়া কিছু বলা যায় না। এরা দেশ তথা মানুষও জাতির শত্র“।এ সব ষড়যন্ত্রকারীদেরকে খোঁজে বের করে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলে পরবর্তীতে কোন ষড়যন্ত্রকারী এরূপ ষড়যন্ত্র করতে পারবে না। বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে বাজার নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রতিটি পণ্যের মূল্য তালিকা সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হাট-বাজারের একটা সময় নির্ধারণ করতে হবে, এক সময় হাট-বাজার গুলোর একটা সময়সীমা ছিল। যেমন হোটেল, রেস্তেুারাঁ, মেডিকেল, ফার্মেসী গুলো সব সময় খোলা ছিল, এ ছাড়া হাট-বাজার গুলো সকাল ১০টা থেকে সর্বোপরি ১০টার মধ্যে বন্ধ করতে হতো। এতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অল্পে তুষ্ট নৈতিকতা আসবে। প্রতিটি পণ্যের মূল্যে সরকার কতৃক পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করার পূর্ণ ক্ষমতা থাকতে হবে। জনগণের খাবার নিয়ে ব্যবসায়ীদের ছিনিমিনি খেলা বন্ধ করতে সরকারই ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারের সবচেয়ে বড় কর্তব্য জনগণের সাথে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বিশ্বে কোন দেশে এ ভাবে ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য খুব কম শুনা যায়। জনকল্যাণে ব্যবসায়ীদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যবসাকে একটি সেবা মূলক কাজ হিসাবে মেনে নেয়ার মনোভাব তৈরী করার উদ্যোগ নিতে হবে। তাই আমাদের ধর্মীয় সূত্র মতে ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে কঠোর নির্দেশ রয়েছে। তাহা একটু মনে করলে হয়ত; ব্যবসায়ীরা সর্থক অবস্থানে আসতে পারেন।
ইসলামী ধর্মীয় দৃষ্টিতে ব্যবসা-বাণিজ্য (তেজারত) বিষয়ে মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে জরুরী পণ্য গুদামজাত করে রাখা সম্পর্কে মিশকাত শরীফে বলা হয়েছে, ‘হযরত মোয়ায (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলে করীম (সা:) কে বলতে শুনেছি যে, বড়ই অভিশপ্ত সেই ব্যক্তি যে মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পণ্যদ্রব্য গুদামজাত করে রাখে। অতঃপর আল্লাহ যদি পণ্য সস্তা করে দেয়, তাহলে সে চিন্তিত হয়। আর যদি মূল্য বৃদ্ধি পায়, তাহলে আনন্দিত হয়।‘ এ ছাড়াও ইবনে মাযাহ রায়হাক শরীফে বলা হয়েছে, ‘হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর নবী করীম (সা:)‘র একথা বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি খাদ্য দ্রব্য গুদামজাত করে রাখে অতিরিক্ত মূল্যে মুসলমানদের হাতে বিক্রি করে, আল্লাহ তাঁকে দরিদ্রতা ও জুয়া নামক ব্যাধি দ্বারা শায়েস্তা করেন।
ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে আল-কোরআনের মাধ্যমে মানুষ জাতিকে বিভিন্ন সময়ে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, সূরা তাতফীফ-১, আয়াতে বলা হয়েছে,‘ পরিতাপ সে সকল পরিমাপকারীদের জন্যে, যারা লোকের কাছ থেকে পরিমাণে-ই গ্রহণ করে। কিন্তু তাদেরকে দেয়ার বেলায় পরিমাণে কম দেয়।‘ তিরমিজি শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে সমস্ত ব্যবসায়ীরা পরিমাণকৃত বস্তুর ব্যবসা করে, তাদেরকে উদ্দেশ্য করে হুযুর (সা:) বললেন, তোমারা এমন দু‘টি কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেছ যার কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী কয়েকটি জাতি ধ্বংস হয়েছিল‘। সূরা আর-রহমান ‘এর, ১ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর সেই মহান আল্লাহ-ই আকাশকে উন্নত করেছেন এবং পরিমাণ যন্ত্রের ব্যবস্থা করেছেন, যাতে করে তোমরা পরিমাণে কম-বেশী না করো। আর ইনসাফের সাথে পরিমাণ কর, আর তোমরা পরিমাণে কম দিও না।‘ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে হযরত শোয়ায়েব (আ:) কে আল্লাহ তায়ালা নবী হিসাবে এমন একটি জাতির কাছে প্রেরণ করেছিলেন, যারা ছিল ব্যবসায়ী এবং পরিমাণে কম-বেশী করার পাপ তাদের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় প্রসারিত হয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা হযরত শোয়ায়েবের (আ:)‘র সময়ে, পাপী এ ব্যবসায়ীদেরকে সাবধান করে, সূরা আল-হুদ, এর ৮৪-৮৫ আয়াতে, আর শোয়ায়েব (আ:) বললেন, হে আমার স্বজাতি। তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কবুল করো, তাঁর ইবাদত কর। একমাত্র তিনি ব্যতিত, তোমাদের অন্য কোন মাবুদ নেই। তোমারা পরিমাণে কম করো না। আমি তো তোমাদেরকে স্বচ্ছল অবস্থায় দেখছি, আর আমি তোমাদের জন্যে এক ভয়াবহ দিনের শাস্তির ভীতি প্রদর্শন করছি। হে আমার স্বজাতি, ইনসাফ সহকারে পরিমাপ ও পরিমাণ কর এবং লোককে তাদের জিনিস কম করে দিও না। আর আল্লাহর যমিনে ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে সীমা লংঘন করো না।‘