পিন্টু দেবনাথ কমলগঞ্জ থেকে :
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে কার্তিকের পূর্ণিমা তিথিতে ঢাকঢোল, খোল-করতাল আর শঙ্খধ্বনি ও আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়ে কঠোর নিরাপত্তা আর বর্ণাঢ্য আয়োজনে মণিপুরী সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব “মণিপুরী মহারাসলীলা” মঙ্গলবার শুরু হয়েছে। বুধবার ঊষালগ্নে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটবে। মঙ্গলবার বেলা ২টা থেকে রাখালনৃত্যের মধ্য দিয়ে কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়া মন্ডপ প্রাঙ্গণে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সম্প্রদায়ের ১৭৭তম ও আদমপুরের মণিপুরী কালচারাল কমপে¬ক্স প্রাঙ্গণে মণিপুরী মী-তৈ সম্প্রদায়ের ৩৪তম এবং নয়াপত্তন যাদু ঠাকুর মন্ডপ প্রাঙ্গণে ৪র্থ বারের মতো মহারাসোৎসব শুরু হয়েছে।
তুমুল হৈ-চৈ, আনন্দ-উৎসাহ, ঢাক, ঢোল, মৃদঙ্গ, করতাল এবং শঙ্খধ্বনির মধ্যদিয়ে রাধা-কৃষ্ণের লীলাকে ঘিরে মঙ্গলবারের দিনটি বছরের অন্য সব দিন থেকে ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসে কমলগঞ্জ উপজেলাবাসীর জীবনে। বর্ণাঢ্য আয়োজনে রাস উৎসবে প্রতিবারের মত এবারও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। উৎসব উপলক্ষে বসেছে রকমারি আয়োজনে বিশাল মেলা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার ভক্তবৃন্দসহ দেশী-বিদেশী পর্যটকের ভিড়ে মুখরিত হয়ে ওঠে কমলগঞ্জের মণিপুরী অঞ্চলগুলো। ভিড় সামলাতে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হিমশিম খেতে দেখা যায়।
দামোদর মাস খ্যাত কার্তিক পূর্ণিমা তিথিতে গৌড়িয় বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মণিপুরীদের প্রধান ধর্মীয় মহোৎসব শ্রীশ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলা অনুসরণ। কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়া মন্ডপ প্রাঙ্গনে মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের উদ্যোগে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী সম্প্রদায়ের ১৭৭তম শ্রী শ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরন উৎসব উপলক্ষে মঙ্গলবার বেলা ২টা থেকে শুরু হয়েছে রাখাল নৃত্য (গোষ্ঠলীলা)।
অপরদিকে রাসোৎসব উদযাপন পরিষদের আয়োজনে আদমপুর মণিপুরী কালচারাল কমপে¬ক্স প্রাঙ্গণ ও নয়াপত্তন যাদু ঠাকুর মন্ডপ প্রাঙ্গণে মন্ডপে মঙ্গলবার বেলা ২টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় রাখাল নৃত্য। রাখাল নৃত্যের বিভিন্ন ধাপে রাধাকৃষ্ণের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনকালের বিভিন্ন চিত্র ফুটে উঠেছে। নিজস্ব পোশাকে সজ্জিত হয়ে মণিপুরী তরুণ-তরুণীরা এতে অংশ নেন। সন্ধ্যায় গুণীজন সংবর্ধনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এরপর রাত ১২টা থেকে শুরু হয়ে শনিবার ভোর পর্যন্ত মণিপুরী নৃত্যের ধ্রুপদ ভঙ্গিমায় রাধাকৃষ্ণের রাসনৃত্য চলবে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শৈশব এবং শ্রীমতি রাধিকার সঙ্গে প্রেমের কাহিনী নিয়ে রাসোৎসবের আয়োজন। মাধবপুরের শিববাড়ি থেকে শুরু করে গ্রামের তিনটি ম-পসহ পুরো এলাকা সেজেছে বর্ণিল সাজে।
রাসলীলা উপলক্ষে কমলগঞ্জের তিনটি স্থানে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলায় খৈ, মুড়ি, বাতাসা, ছোটদের বিভিন্ন ধরনের খেলনা, পোশাক-পরিচ্ছদ, ঘর সাজানোর বিভিন্ন উপকরণ ও প্রসাধনী, শ্রীকৃষ্ণের ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির ছবিসহ বাহারি পণ্য শোভা পাচ্ছে। এ ছাড়া মাধবপুর ললিতকলা একাডেমির সামনে বসেছে মণিপুরী সম্প্রদায়ের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে বইপত্রের কয়েকটি স্টল।
মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ জানান, মাধবপুর জোড়ামন্ডপে রাসোৎসব সিলেট বিভাগের মধ্যে ব্যতিক্রমী আয়োজন। এখানে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের আগমন ঘটে। বর্ণময় শিল্প সমৃদ্ধ বিশ্বনন্দিত মণিপুরী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী রাস উৎসবে সবার মহামিলন ঘটে। মণিপুরী ললিতকলা একাডেমির গবেষণা কর্মকর্তা প্রভাস সিংহ জানান, এখানে সব ধরনের সুবিধা বিদ্যমান থাকায় এটি উৎসবে রূপ নিয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উৎসবে যোগ দিতে হাজার হাজার ভক্ত অনুরাগী এখানে এসেছেন।
সাদা কাগজের নকশায় নিপুন কারু কাজে সজ্জিত করা হয় মন্ডপগুলো। রাসোৎসব উপলক্ষে শুক্রবার মহারাত্রির পরশ পাওয়ার জন্য হাজার হাজার মানুষের মিলনতীর্থ পরিনত হয় মাধবপুর জোড়া মন্ডপ আর আদমপুরের মন্ডপগুলো। মন্ডপে মণিপুরী শিশু নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুন নৃত্যাভিনয় রাতভর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের। মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও মেতে উঠে একদিনের এই আনন্দে। মহারাত্রির আনন্দের পরশ পেতে আসা দেশের বিভিন্ন স্থান হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরসহ নানা পেশার মানুষের পদচারণায় সোমবার সকাল থেকে মুখরিত হয়ে উঠে মণিপুরী পল¬ীর এ দুটি এলাকা।
অতীতের সেই ধারাবাহিকতার সূত্র ধরেই কোন রূপ বিকৃতি ছাড়াই কমলগঞ্জে উদযাপিত হয়ে আসছে মনিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শ্রী কৃষ্ণের মহা রাসলীলা। ঢাক, ঢোল, মৃদঙ্গ, করতাল এবং শঙ্খ ধ্বনির সঙ্গে ব্যাপক আনন্দ উল্লাসের মধ্যদিয়ে রাধা-কৃষ্ণের লীলাকে ঘিরেই এ দিনটি বছরের অন্য সব দিন থেকে ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসে কমলগঞ্জ উপজেলাবাসীর জীবনে।