কাজিরবাজার ডেস্ক :
আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটস (আইএস) প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদি নিহত হওয়ার পর জঙ্গি সংগঠনটির অফিসিয়াল সাইট আমাক নিউজ খবর দিয়েছে, নতুন আইএস প্রধান নিযুক্ত হয়েছেন বাগদাদির বিশ্বস্ত আবদুল্লাহ কারদাশ হাজী আবদুল্লাহ আল-আফারি। বাগদাদি নিহত হওয়ার পর আইএস জঙ্গিদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ার কারণে আইএস-এ যোগদানকারী বিদেশে অবস্থান করছে এমন বাংলাদেশী ২০ জঙ্গি যাতে দেশে ফিরে আসতে না পারে সেজন্য বিমানবন্দর, স্থলবন্দর, নৌবন্দর, সীমান্ত এলাকায় বার্তা পাঠিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দেশের ভেতরে আইএস মতাদর্শের অনুসারী জঙ্গি সংগঠন নিউ জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ জঙ্গিদের ওপর কঠোর নজরদারি শুরু করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, আইএস প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদি নিহত হওয়ার পর জঙ্গি সংগঠনটির অফিসিয়াল সাইট আমাক নিউজ থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে গোয়েন্দা সংস্থা। আমাক নিউজ বলেছে, নতুন আইএস প্রধান হচ্ছেন আবদুল্লাহ কারদাশ হাজী আবদুল্লাহ আল-আফারি। গত আগস্টে তাকেই তার অনুপস্থিতিতে আইএস পরিচালনার ভার দেন বাগদাদি। আইএসের অফিসিয়াল সাইটের বরাত দিয়ে নতুন আইএস প্রধান হওয়ার খবরটি প্রকাশ করেছ বিদেশী সংবাদমাধ্যমও। এক সময়ে ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের অধীনে দেশটির সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন নতুন আইএস প্রধান আবদুল্লাহ কারদাশ হাজী আবদুল্লাহ আল- আফারি।
আইএসের শুরুর দিকেই জঙ্গি সংগঠনটিতে নাম লেখান আবদুল্লাহ কারদাশ হাজী আবদুল্লাহ আল-আফারি। জঙ্গি সংগঠনটি তখনও ইরাক-সিরিয়ায় বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগ দখল করেনি, ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেনি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তখন জঙ্গি সংগঠনটি ব্যাপক পরিচিতিও লাভ করেনি। নতুন আইএস প্রধান কারদাশ আইএস অনুসারীদের কাছে অধ্যাপক হিসেবেও পরিচিত। বাগদাদি তাকে প্রথমে ‘মুসলিম এ্যাফেয়ার্স’ বিভাগের দায়িত্ব দেন। এখন বাগদাদির মৃত্যুর পর কারদাশ আইএস-এর কমান্ডার ইন চীফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। বাগদাদির দীর্ঘদিনের বিশ^স্ত সঙ্গি হচ্ছেন কারদাশ। এখন সে আইএসকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করার দায়িত্ব পেয়েছেন। নতুন আইএস প্রধান কারদাশ এমন এক সময়ে জঙ্গি সংগঠনটির দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন যখন এই সন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠী খিলাফতের নামে হাজার হাজার মানুষকে হত্যার পর ইরাক ও সিরিয়ায় পর্যুদস্ত হয়ে মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে যারা আইএস এ যোগদানের জন্য ইরাক-সিরিয়া গেছেন এবং এখন আফগানিস্তানে অবস্থান করছেন তারা নিজ নিজ দেশে ফিরে আসার চেষ্টা করছেন।
গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে ফিরতে চায় এই ধরনের তালিকায় রয়েছে ২০ ইসলামিক স্টেটস (আইএস) জঙ্গি। এই জঙ্গিগোষ্ঠীতে বাংলাদেশ থেকে যোগ দিতে সিরিয়া-ইরাক গেছে ৪০ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ২০ জন সেখানেই। সিরিয়া-ইরাকে আইএস জঙ্গিদের শেষ ঘাঁটি পতনের পর এখনও জীবিত ২০ আইএস জঙ্গি দেশে ফিরে আসার চেষ্টা করছে। আইএস প্রধান বাগদাদি নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশী আইএস জঙ্গিরা দেশে ফিরে আসতে পারে এমন আশঙ্কায় বিমানবন্দর, স্থলবন্দর, সীমান্ত এলাকায় বার্তা পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যারা আইএস জঙ্গি সংগঠনে যোগদান করেছে তাদের নাম করা হয়েছে কালো তালিকাভুক্ত। আইএস জঙ্গিরা যাতে দেশে ঢুকতে না পারে সেজন্য সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দেশে ফিরে আসার চেষ্টা করলেই আইএস জঙ্গিদের গ্রেফতার করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, শুধু বাংলাদেশ থেকেই নয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে গোপনে নানা কৌশলে সিরিয়া গিয়ে আইএসে যোগ দিয়েছেন এমন বাংলাদেশীর সংখ্যা ৪০ জন। তাদের তালিকা হাতে পেয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। বিভিন্ন দেশের সহযোগিতা ও তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে তালিকাটি তৈরি করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরা সবাই জন্মসূত্রে বাংলাদেশী অথবা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত। অনেকেই আবার বাংলাদেশ ছাড়াও অন্য দেশের দ্বৈত নাগরিক। তবে এদের মধ্যে ২০ জন ইতোমধ্যে মারা গেছেন, বাকিরা বাংলাদেশে ফেরার চেষ্টা করছেন। আইএসে যোগদানকারীরা দেশে ফিরলেই তাদের গ্রেফতার করা হবে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ জন্য দেশের সব বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে নামের তালিকা পাঠানো হয়েছে। তারা যেন কোনভাবেই দেশে প্রবেশ করতে না পারে, আর আসলেই যাতে গ্রেফতার করা হয় সে ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাদের শনাক্ত করা মাত্রই গ্রেফতার করবে এবং বিষয়টি তাৎক্ষণিক কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে জানানোর নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। সিরিয়া-ইরাকে আইএস জঙ্গি ঘাঁটি পতনের পর থেকেই প্রবাসী জঙ্গি যারা এখন দেশে ফিরে আসার চেষ্টা করছিল এবং আইএস প্রধান বাগদাদি নিহত হওয়ার পর তারা দেশে ফিরে আসার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করবে এমনটাই মনে করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে তালিকাভুক্ত যে ৪০ জন আইএস জঙ্গির খাতায় নাম লিখিয়েছে তারা সবাই রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের আত্মীয়-সন্তান। আর এদের মধ্যে আইএসের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন সাইফুল হক সুজন ও আশিকুর রহমান। আইটি বিশেষজ্ঞ সাইফুল হক সুজন সিরিয়ায় যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। তার স্ত্রীর নাম সায়মা আক্তার মুক্তা। দুই সন্তানসহ গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে সিরিয়া যান সুজন। সিরিয়ায় যাওয়ার পর ওসমান নামে তার একটি সন্তান হয়। খুলনার ইকবাল নগরে তাদের বাসা। মারা যাওয়ার পর আইএস তাকে ‘সাহসী মুজাহিদ’ হিসেবে অভিহিত করে। কাওরানবাজারে তার একটি কম্পিউটার ফার্ম ছিল। সম্প্রতি স্পেন থেকে সুজনের ভাই আতাউল হক ৫০ লাখ টাকা পাঠায় এই ফার্মের নামে। এই টাকাসহ সুজনের বাবা ও তার আরেক ভাইকে গ্রেফতার করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। পরে তার বাবা কারাগারে মারা যান। ওই ৫০ লাখ টাকা গুলশানের হলি আর্টিজান হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিমকে দেয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল। এটা জঙ্গি অর্থায়নের টাকা। সুজনের সিরিয়া যাওয়ার বিষয়টি জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানায় তার বাবা-ভাই। আরেক জঙ্গি নেতা প্রকৌশলী বাশারুজ্জামান উত্তরবঙ্গে অভিযানে নিহত হন। তিনি সুজনদের ফার্মে কাজ করতেন। তার সঙ্গে সিরিয়ার আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বলে জানতে পেরেছে জঙ্গিগোষ্ঠীর তদন্ত সংস্থা।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ রোকন উদ্দিন খন্দকার তার স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে সিরিয়া গিয়েছিলেন আইএসের পক্ষে কাজ করতে। যুদ্ধাহত আইএস জঙ্গিদের চিকিৎসা সেবার দায়িত্বে ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম নাইমা আক্তার, মেয়ে রেজোয়ানা রোকন, মেয়ের জামাই সাদ কায়েজ ও মেয়ে রোমিকা রোকন। ঢাকার খিলগাঁওয়ের চৌধুরীপাড়ায় তাদের বাড়ি। সব বিক্রি করে তারা সিরিয়া যান। যৌথবাহিনীর আক্রমণে সিরিয়ায় আইএস ছিন্নভিন্ন হওয়ায় তারা এখন দেশে ফিরতে চান। তবে যৌথবাহিনীর নেটওয়ার্কে রোকনউদ্দিন খন্দকার ও তার পরিবার ধরা পড়েছে। তবে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে পাঁচ সদস্যের এই পরিবার। অপরদিকে ইব্রাহিম হাসান খান ও জুনায়েদ খান নামে দুই ভাইও সিরিয়া গিয়েছিল। তাদের মা-বাবা সৌদি আরবে থাকেন। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ডাঃ আনোয়ার ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী। তিনিও সপরিবারে ব্রিটেন থেকে সিরিয়া যান। তবে যুক্তরাজ্য সরকার তার পাসপোর্ট বাতিল করেছে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক হবিগঞ্জের বাসিন্দা ইবনে হামদুদ আইএসের সদস্য। তার আসল নাম সামিউন রহমান। আইএসের দেয়া নাম ইবনে হামদুদ। বাংলাদেশে আসার পর তার কর্মকা-ে আইএসের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায় তদন্ত সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। এই তিনজন গ্রেফতারও হয়। তখন দেশের সুশীল সমাজের একটি অংশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ইবনে হামদুদ ব্রিটিশ সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে জড়িত। পরে জামিনে মুক্তি পান সামিউন। এ ঘটনার কিছুদিন পর সামিউন দিল্লীতে যান। সেখানে ভারতের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কে ধরা পড়ে সামিউনের আইএসে জড়িত থাকার কর্মকা-। পরে তাকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানা গেছে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের ৪০ জনের তালিকা বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরের সকল ইমিগ্রেশনে পাঠানো হয়েছে। সিরিয়া ও ইরাক থেকে যারা আসবেন তাদের সব তথ্য দেখে তালিকাভুক্তদের কেউ থাকলে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হবে। তিনি বলেন, এয়ারপোর্ট ও স্থলবন্দরগুলো কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে। আইএসের সদস্য আসা মাত্রই গ্রেফতার করা হবে। এ বিষয়ে অন্যান্য ইন্টেলিজেন্সের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস অনেক আগেই কোণঠাসা হয়ে পড়ার পর তাদের শেষ ঘাঁটি পতনের ঘোষণা দেয়ার পরই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এখন আবার বাগদাদি নিহত হওয়ার পর নতুন করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।