কাজিরবাজার ডেস্ক :
রাজধানীর গুলশানে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বাসায় অভিযান চালিয়েছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। রবিবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে গুলশান-২ এর ৫৭ নম্বর সড়কের ১১/এ বাড়িতে এ অভিযান শুরু হয়। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিদর্শক কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে মাদকের অতিরিক্ত পরিচালক ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে এ অভিযানে অংশ নেন ঢাকা মেট্রোর উপ-পরিচালক জ্যোতি মুকুল চাকমা, পরিদর্শক এসএম শামসুল কবির ও সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলম। সঙ্গে বিপুল সংখ্যক পুলিশ। অভিযানকালে বিপুল পরিমাণ মদ, গাঁজা, ক্যাসিনোসামগ্রী, সিসা ও সিসার উপকরণ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, ওই বাসায় পাওয়া গেছে মিনি বারের সন্ধান। বিপুল সংখ্যক গণমাধ্যমকর্মীর উপস্থিতিতে চালানো অভিযান শেষে চলছিল জব্দকৃত মদের সিজার লিস্ট তৈরির কাজ। রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময় পরিদর্শক কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, আজিজ মোহাম্মদ ভাই দীর্ঘদিন ধরে বাসায় না থাকলেও তার দুজন কর্মচারী নবীন ও পারভেজ অবৈধভাবে মাদক ও ক্যাসিনোর ব্যবসা পরিচালনা করতেন। এখানে আসতেন সব কালো টাকার বিত্তবানেরা। প্রতিরাতেই এখানে বসত ক্যাসিনো ও মাদকের হাট। তাদের দুজনের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
কামরুল ইসলাম বলেন, সুরম্য অট্টালিকাসদৃশ ওই বাসার তিন তলায় রয়েছে মদের বিশাল গোডাউন, ছয়তলায় বার ও ক্যাসিনোর সামগ্রী। জব্দকৃত মাদকের সিজার লিস্ট তৈরি করতে কমপক্ষে আারও ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে। এখানে ব্ল্যাক লেভেল, সিভাস রিগ্যাল, সিঙ্গেল মল্ট, কনিয়েগ, রয়্যাল সেলুট, ব্লু লেবেল ও গোল্ড লেবেলসহ নামীদামী ব্র্যান্ডের মদের বোতল পাওয়া গেছে। জব্দ তালিকা শেষ হওয়ার পর পরিদর্শক এস এম শামসুল কবির বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলা দায়ের করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ক্যাসিনো সামগ্রীর মধ্যে ছিল কয়েন কার্ড ও ঘুঁটি।
জানা গেছে, আজিজ মোহাম্মদ ভাই এ বাসায় থাকেন না দীর্ঘদিন ধরে। তিনি বিগত ওয়ান ইলেভেনের সময় থেকেই দেশছাড়া। বর্তমানে পরিবার পরিজন নিয়ে তিনি ব্যাঙ্ককে অবস্থান করছেন। সেখানেই তিনি গড়ে তুলেছেন নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
রবিরার রাতে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ব্যাঙ্কক থেকে বলেন, এ অভিযান সম্পর্কে আমাকে এখনও কেউ কিছু জানায়নি। তোমার কাছ থেকেই প্রথম শুনলাম। কিছু না জেনে তো কিছু বলতে পারছি না। তবে যে সব কথা বলছো, তা বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার বাসায় কি গাঁজার চাষ হয় নাকি কেউ সেটা খায় ? এসব গাঁজার গাঁজাখুরি কাহিনী কারা কেন করছে সেটা তোমরা খুঁজে বের কর। আমি তো বাসায় নেই। যারা এ অভিযান চালায় সেটা তাদেরই জিজ্ঞাসা কর।
উল্লেখ্য, দেশীয় চলচ্চিত্র জগতের বহুল পরিচিত মুখ এবং আলোচিত-সমালোচিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই। নামের সঙ্গে ভাই শব্দটি তাদের বংশ পদবি। তাদের পরিবারের সবার নামের শেষেই এই পদবি আছে। তার পিতার নাম মোহাম্মদ ভাই। মায়ের নাম খাদিজা মোহাম্মদ ভাই। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর তাদের পরিবার ভারতের গুজরাট থেকে বাংলাদেশে আসে। পরিবারটি মূলত পারস্য বংশোদ্ভূত। তারা বাহাইয়ান সম্প্রদায়ের লোক। বাহাইয়ানকে সংক্ষেপে বাহাই বলা হয়। উপমহাদেশের উচ্চারণে এই বাহাই পরবর্তীতে ভাই হয়ে যায়। ধনাঢ্য এই পরিবার পুরান ঢাকায় বসবাস শুরু করে। ১৯৬২ সালে আজিজ মোহম্মদ ভাইয়ের জন্ম হয় আরমানিটোলায়। আজিজ মোহাম্মদ ভাই মূলত একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। প্রায় ১১টি ইন্ডাস্ট্রির মালিক তিনি। এছাড়া মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুরে রয়েছে তার উঁচুমানের রিসোর্ট। মূলত আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের নাম গণমাধ্যমে উঠে এসেছে বাংলাদেশের সিনেমা জগতের জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহের রহস্যজনক মৃত্যুর পর।
আজিজ মোহাম্মদ ভাই বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তিনি ওয়ান ইলেভেনের আগ মুহূর্তে দেশ ছেড়ে যান। তারপর হুলিয়া জারি হওয়ায় তিনি আর দেশে ফেরার সুযোগ পাননি। বছর চারেক আগে তার বাবা ও বছর দেড়েক আগে তার মা মারা গেলেও তিনি তাদের মরদেহ দেখার সুযোগ পাননি। আইনী জটিলতায় তার পক্ষে দেশে ফেরা সম্ভব হয়নি। আজিজ ভাই জানিয়েছেন, গুলশানের বাসায় তার ক’জন কর্মচারী ও স্বজন থাকেন। ১৯৯৬ সালে জনপ্রিয় সালমান শাহের রহস্যজনক মৃত্যুর পর তার পরিবার ও ভক্তকুলের পক্ষ থেকে এ জন্য আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে পরিকল্পনাকারী হিসেবে সন্দেহের চোখে রাখেন। তারপর থেকেই তিনি মূলত ব্যাপক আলোচনায় আসেন। ভোগ বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত আজিজ ভাই বেঙ্গল গ্রুপের অন্যতম অংশীদার। চার দলীয় জোট সরকারের আমলে নায়ক সালমান শাহ’র রহস্যজনক মৃত্যু ও অপর একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার করে ডিবি। কিছুদিন জেল হাজত খাটার পরই জামিনে মুক্তি পেয়ে দেশ ছাড়েন। তারপর থেকেই তিনি ব্যাঙ্কক প্রবাসী। অভিযান শেষে রাতে পরিদর্শক কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ওই বাসায় মিলেছে ‘হাইপ্রোফাইলড’ ক্যাসিনো ও বার। এছাড়া বাসায় এমন কিছু ব্র্যান্ডের বিপুল পরিমাণ বিদেশী মদের মজুদ পাওয়া গেছে-যা সাধারণত কোন বারেও মজুদ থাকে না।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ ফজলুর রহমান বলেন, গুলশান ৫৭ নম্বর রোডের ১১/এ নম্বর বাসাটি আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের নামে। তবে বাসাটির দেখাশোনা করতেন তার ভাই ও বোন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে এখানে আমরা বিপুল পরিমাণে বিদেশী মদ, সিসার উপকরণ ও ক্যাসিনো সরঞ্জামাদি জব্দ করেছি। ক্যাসিনোটি ছিল বাসার ছাদে। এখানে ডলারের মাধ্যমে খেলা হতো। সম্প্রতি রাজধানীতে যতগুলো ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়- সেসব জায়গায় দেখা গেছে খেলা হতো টাকা দিয়ে। এখানে এক সেন্ট থেকে শুররু করে ১০০ ডলারের পর্যন্ত কয়েন দিয়ে খেলা হতো। ক্যাসিনো সরঞ্জাম এতেই বোঝা যায়- এখানে খুব হাইপ্রোফাইল মানুষজন খেলতে আসতেন। এছাড়া ক্যাসিনোটিতে সব ধরনের আধুনিক-সুবিধা রয়েছে এবং সুসজ্জিত।