আরও অনেক এমপি ফেঁসে যেতে পারেন

23

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আইন করে নিজেরাই আইন ভাঙছেন অনেক এমপি। আরও অনেক এমপি ফেঁসে যেতে পারেন শুল্কমুক্ত গাড়ি এনে শর্ত ভঙ্গ করার ঘটনায়। গত দশ বছরে এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির কারণে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে সরকার। যেসব এমপি শুল্কমুক্ত গাড়ি এনে শর্ত ভঙ্গ করেছেন বা বিক্রি করে দিয়েছেন তাদের বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর। শুল্কমুক্ত গাড়ি এনে বিক্রি করায় বিএনপি থেকে নির্বাচিত এমপি হারুন অর রশীদকে ৫ বছর সশ্রম কারাদ- ও ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে আদালত। আদালতে সাজা হওয়ার পর কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বিএনপির এমপি হারুনকে। সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে তার এমপি পদটি থাকে কিনা সেটা নিয়েও আইনগত প্রশ্ন সামনে এসেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এমপি হওয়ার পর যারা শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করেছেন তারা সেসব গাড়ি কি করেছেন তার খোঁজ নেয়া হচ্ছে। এমপি হলেই তারা শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ পান। কয়েক কোটি টাকা লাভের আশায় এসব গাড়ি বিক্রি করে দেন অনেকেই। এসব গাড়ির নম্বর প্লেটে এমপির নির্বাচনী এলাকার নম্বর ও নিজ জেলা লেখার শর্ত না মেনেই গাড়ি ব্যবহার করছেন অনেক এমপিই। এতে গাড়ি বিক্রি করে দেয়ার সুযোগ ঘটছে। গত দশবছরে যেসব এমপি শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করেছেন তাদের অনেকেই শর্ত ভঙ্গ করে সুবিধামতো চালাচ্ছেন নয়তো বিক্রি করে দিয়েছেন।
শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, শুল্কমুক্ত সুবিধায় ল্যান্ডক্রজার, পাজেরোসহ দামী দামী গাড়ি এনেছেন এমপিরা। গত দশবছরে এমপিরা এই ধরনের কয়েক শ’ শুল্কমুক্ত দামী গাড়ি এনেছেন। এতে সরকারের হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। চার হাজার সিসির ডিজেলচালিত দামী ল্যান্ডক্রুজার ও পাজেরো জিপ। এসব গাড়ির প্রতিটির শুল্ক চার থেকে সাড়ে চার কোটি টাকা। কোনটির আবার পৌনে পাঁচ বা পাঁচ কোটি টাকাও। দুই কোটি টাকার কম শুল্কের কোন গাড়ি আমদানি করেননি কেউ। প্রতিটি গাড়ির জন্য গড়ে তিন কোটি টাকা শুল্ক ধরে খসড়া হিসাব করেছেন কাস্টম কর্মকর্তারা।
শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, এমপিরা যেখানে নিজেরাই সংবিধান রক্ষা করবেন, সেখানে তারা তা লঙ্ঘন করে নিজেদের স্বার্থে বিশেষ সুবিধায় গাড়ি আনছেন। শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সময়ে প্রত্যেক এমপি একটি মুচলেকা দেন। প্রত্যেক এমপি একটি মুচলেকা দেন যে, তিনি গাড়িটির হাতবদল করবেন না বা বিক্রি করবেন না। এছাড়া শুল্কমুক্ত সুবিধার যত বিধিবিধান ও শর্ত রয়েছে, তাও তারা মেনে চলবেন বলেও মুচলেকায় উল্লেখ করে থাকেন। শুল্কমুক্ত গাড়ি এনেছেন এমন এমপিদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বিগতদিনে এমপিরা গাড়ি এনে তা অন্যের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন এমন অনিয়মের কথা শোনা গেলে বর্তমান সংসদের কোন এমপি যাতে বিক্রি না করতে পারেন, সেজন্য ৬ নম্বর শর্তটি আরোপ করা হয়। এই শর্তানুযায়ী প্রত্যেক এমপি গাড়ির নম্বর প্লেটে এমপির নির্বাচনী এলাকার নম্বর ও নিজ জেলা লেখার শর্ত মানতে বাধ্য। এতে শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করে তা বিক্রি করার সুযোগ থাকবে না। তবে শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করার ক্ষেত্রে ৬ নম্বর শর্তটি বাতিলের জন্য দেন দরবার ও চিঠি চালাচালি হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, শুল্কমুক্ত গাড়ি এনে তা বিক্রি করে টাকা আত্মসাত মামলায় বিএনপির সংসদ সদস্য হারুন অর রশীদসহ তিনজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম সোমবার এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে এমপি হারুন অর রশীদকে ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ড ও ৫০ লাখ টাকা অর্থদন্ড দেয়া হয়েছে। অর্থদন্ড অনাদায়ে আরও ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার পর সাজা পরোয়ানা দিয়ে হারুন অর রশীদকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের এমপি হারুন একাদশ জাতীয় সংসদে বিএনপির সংসদীয় দলের নেতা। এছাড়াও চ্যানেল নাইনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ এনায়েতুর রহমান বাপ্পিকে ২ বছর সশ্রম কারাদন্ড ও ১ লাখ টাকা অর্থদন্ড দেয়া হয়েছে। অর্থদন্ড অনাদায়ে আরও ২ মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়। তিনি পলাতক। অপর পলাতক আসামি গাড়ি ব্যবসায়ী স্কাই অটোসের মালিক ইশতিয়াক সাদেককে ৩ বছর সশ্রম কারাদন্ড ও ৪০ লাখ টাকা অর্থদন্ড দেয়া হয়। অর্থদন্ড অনাদায়ে আরও ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
আদালত সূত্র জানায়, ২০০৫ সালের ১৯ এপ্রিল হারুন অর রশীদ এমপি কোটায় শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করেন। এর এক সপ্তাহ পরই শুল্কমুক্ত গাড়িটি তিনি বিক্রি করে দেন। গাড়িটি তিনি স্কাই অটোসের মালিক ইশতিয়াক সাদেকের মাধ্যমে ক্রেতা মোঃ এনায়েতুর রহমানের কাছে বিক্রি করেন। গাড়িটির ইনভয়েস মূল্য ১১ লাখ ৬৪ হাজার ১১০ টাকা। শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করে শর্ত ভঙ্গ করে তা বিক্রি করায় সরকারের ৮৭ লাখ ৭১ হাজার ৬১২ টাকার শুল্ক বাবদ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এ ঘটনায় ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ এসআই মোঃ ইউনুচ আলী বাদী হয়ে রাজধানীর পল্লবী থানায় মামলা করেন। দুর্নীতি দমন কমিশন শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করে বিক্রি করে দেয়ার ঘটনায় চার্জশীট দাখিলের পর বিচারে এমপি হারুন অর রশীদসহ তিনজনের সাজা দিয়েছে আদালত।
শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, নিজের নির্বাচনী এলাকায় জনসেবা করার জন্য কোটি কোটি টাকা মূল্যের দামী গাড়ি আমদানির সুযোগ দেয়া হয় এমপিদের। সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে এমপিদের হাতে রেখে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে এমপিদের এই ধরনের সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়, যা এখনও অব্যাহত আছে। শুল্কমুক্ত দামী গাড়ি আমদানি করা হলে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে। সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হওয়ার পর এমপিদের এই সুযোগ দেয়া হলেও তারা শর্ত ভঙ্গ করছেন এবং গাড়ি বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন অনেক এমপি। যেসব এমপি শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করে এনে বিক্রি করে দিয়েছেন তাদের তালিকা তৈরি করে অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের ওই কর্মকর্তা।