কাজিরবাজার ডেস্ক :
চামড়া নিয়ে নতুন জটিলতা দেখা দিয়েছে। আড়ত মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন বকেয়া পাওনা পরিশোধ না করলে তারা ট্যানারিতে চামড়া দেবেন না। সরকার ঘোষিত সুযোগ গ্রহণ করে তারা লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া রফতানির প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। অবস্থা বেগতিক দেখে ট্যানারি মালিকরা সরাসরি চামড়া কেনার চেষ্টা করছেন। প্রতিনিধি পাঠিয়ে তারা দেশের বিভিন্ন জেলার হাট থেকে নির্ধারিত দামে চামড়া কেনা শুরু করেছেন। শনিবার থেকেই সারাদেশে কোরবানির চামড়া কেনাকাটা শুরু হয়েছে। আগামী নবেম্বর মাস পর্যন্ত লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হবে। তবে পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের কাছ থেকে চামড়া না পেলে ট্যানারি মালিকরা তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারবেন না। এতে চামড়া শিল্প নতুন জটিলতায় পড়বে।
পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা বলছেন, গত তিন মৌসুমে চামড়া বিক্রি করেও তারা ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে পাওনা অর্থ আদায় করতে পারেননি। এ কারণে তারা এবার চামড়া কেনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ব্যবসায়ীদের এই সিদ্ধান্তে এবার চামড়ার মূল্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে। কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। কোন কোন এলাকায় চামড়া কেনার লোকও খুঁজে পাওয়া যায় না। বিক্রি করতে না পেরে অনেকে চামড়া নষ্ট করে ফেলেছেন। বঞ্চিত হয়েছে দেশের দরিদ্র মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে সরকার কাঁচা চামড়া রফতানির ঘোষণা দেয়। সরকারের এই ঘোষণায় নড়েচড়ে বসেন ব্যবসায়ীরা। লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি চায় ৩০০ আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ী। এ লক্ষ্যে বিপুল পরিমাণ চামড়া তারা মোকাম ও গোডাউনে মজুদ করেছে। প্রতিবর্গফুট লবণযুক্ত চামড়া ১২৭-১৩৫ টাকায় চীন এবং ভারত ১১৫-১২০ টাকায় কেনার আগ্রহ দেখিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশে সরকার নির্ধারিত প্রতিবর্গফুট ভাল গরুর চামড়ার মূল্য হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা মাত্র।
এদিকে, দেশের কোথাও এক পিস চামড়াও যাতে আর নষ্ট হয়, সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে সরকার। জাতীয় সম্পদ চামড়া রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা মাঠে কাজ করছে। এছাড়া মৌসুমি ব্যবসায়ী যারা কোরবানির চামড়া সংগ্রহ করেছেন তাদের সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া বেচার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে জেলা পর্যায়ে বাজার মনিটরিং করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এদিকে কোরবানির সোয়া কোটি পিস চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের সক্ষমতা ট্যানারিগুলোর রয়েছে কিনা সে বিষয়ে খোদ সন্দেহ রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণায়ের। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব মোঃ মফিজুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই চামড়ার উৎপাদন বেড়েছে। মানুষের আয় বাড়ায় বেড়েছে ক্রয় ক্ষমতা। ভাল পশু কোরবানি দেয়ার পাশাপাশি মানুষ সারাবছর মাছ-মাংস খাচ্ছেন। সব মিলিয়ে পশু উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি চামড়ার উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু ট্যানারির সংখ্যা তো বাড়েনি। বরং সাভারের শিল্পনগরীতে সুনির্দিষ্ট গুটিকয়েক উদ্যোক্তারা ট্যানারির মালিক হওয়ায় সিন্ডিকেশন হচ্ছে। এ কারণেই চামড়ার বাজারের ভয়াবহ পতন হয়েছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, গত দশ বছর ধরে ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের অনুরোধে ধারাবাহিকভাবে দেশে চামড়ার দাম কমানো হচ্ছে। অথচ খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, বিশ্বের কোথাও কাঁচা চামড়া এত কম দামে বিক্রি হয় না।
জানা গেছে, ট্যানারি মালিক, আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সরকার নির্ধারিত দামে এবার চামড়া না কেনায় এ খাতে বিপর্যয় নেমে আসে। সময় মতো চামড়ায় লবণ না দেয়ার কারণে সারাদেশে লাখ লাখ পিস চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। এ অবস্থায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ সরকার নির্ধারিত দামে শনিবার থেকে সারাদেশে চামড়া কেনাবেচা শুরু হয়েছে।
এদিকে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী কোরবানির পশুর লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া কেনা শুরু করেছেন ট্যানারি মালিকরা। বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও সালমা ট্যানারির মালিক সাখাওয়াত উল্লাহ আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা ট্যানারি মালিকরা লবণযুক্ত কাঁচা চামড়া কেনা শুরু করেছি। আমরা সরকার নির্ধারিত মূল্যে আগামী তিন মাস চামড়া সংগ্রহ করব। যেসব চামড়া ভালভাবে সঠিক সময়ে লবণ দিয়েছে ওইসব চামড়া ভাল দামে কেনা হবে। এ ছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ট্যানারি মালিক, আড়তদার ও কাঁচা চামড়া সংশ্লিষ্টদের বৈঠকে বর্তমান চামড়ার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে।
এছাড়া পাইকারি ও আড়ত মালিকদের বকেয়া টাকা দ্রুত পরিশোধ করা হবে বলে জানান তিনি। শনিবার দুপুরে সাভারে চামড়া শিল্পনগরীর বিসিক কার্যালয়ে শিল্প সচিবের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আড়তদারদের দীর্ঘদিন ধরে ট্যানারি মালিকরা সুসম্পর্ক বজায় রেখে ব্যবসা করে আসছে। সম্প্রতি তারা কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ট্যানারি মালিকরা তাদের বকেয়া দ্রুত পরিশোধ করার চেষ্টা করছে।
নির্ধারিত দাম কার্যকরে প্রতিটি গরুর চামড়ার দাম হবে ৮১০ থেকে ১৭৫০ টাকা : সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর হলে প্রতিটি গরুর চামড়ার দাম হবে প্রায় ৮১০-১৭৫০ টাকা। বাংলাদেশ হাইড এ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের মতে, বড় সাইজের একটি গরুতে প্রায় ৩৫ বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। ওই হিসেবে প্রতিবর্গফুট চামড়া ৫০ টাকা হলে একটি গরুর চামড়ার দাম হয় ১৭৫০ টাকা। ঢাকায় এবার প্রতিবর্গফুট গরুর চামড়া ৪৫-৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া মাঝারি সাইজের একটি গরু থেকে ২৬ থেকে ২৮ বর্গফুট এবং ছোট সাইজের একটি গরু থেকে ১৮ বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। ওই হিসাবে প্রতিটি ছোট আকারের গরু থেকে ৮১০ টাকার চামড়া পাওয়া যাবে।
এছাড়া প্রতিটি খাসি ও বকরি থেকে প্রায় ৬-৭ বর্গফুট চামড়া আসে। এ প্রসঙ্গে সংগঠনটির সভাপতি হাজী মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলেন, সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর হলে গড়ে প্রতিটি গরুর চামড়াই হাজার টাকার ওপরে বিক্রি হবে। কিন্তু ওই দামে চামড়া বেচাকেনা হয়নি। ট্যানারি মালিকরা পাওনা ও বকেয়া পরিশোধ না করায় পাইকারি ও আড়তদারদের চামড়া কিনতে সমস্যা হচ্ছে বলে তিনি জানান। তবে এবার কাঁচা চামড়া রফতানির সুযোগ দেয়ায় পাইকারি ও আড়ত মালিক খুশি হয়েছেন। তারা সরাসরি চামড়া বিদেশে রফতানি করতে পারবেন।
এদিকে ঈদের দিন চামড়ার নির্ধারিত মূল ও ক্রেতা না পেয়ে অনেকেই চামড়া নষ্ট করে ফেলেন। এদের মধ্যে কিছু মাদ্রাসা ও ব্যক্তি পর্যায়ে সংগ্রহ করা চামড়া নদী ফেলা দেয়া হয় সহ মাটিতে পুতে ফেলে হয়। চামড়ার বাজারে এই বিপর্যয়ের পর সরকারের তড়িৎ নানা সিদ্ধান্তে আবারও সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কেনা বেচা শুরু হওয়ায় ইতিমধ্যে যারা চামড়া নষ্ট করে ফেলেছিলেন তাদের অনেকেই এখন আফসোস করছেন।