শাহ আলম শামীম কুলাউড়া থেকে :
দেশ স্বাধীনের আগে থাকিই এই হাখম (সাঁকো) দিয়া চাইর (চার) গাঁওর (গ্রাম) লোকজন চলাফেরা করে আসছেন। স্বাধীনর পর থাকিয়া এইখানে একটা পুলর (সেতুর) লাগি সকল এমপি, ইউনিয়ন চেয়ারম্যানরে লিখিত দাবি জানাইছি। সবেউ (সকলে) আমরারে আশ^াস দিছইন পুল (সেতু) করিয়া দিবা। বিশেষ করে ভোটর সময় আইলে (এমপি-চেয়ারম্যান) পুল (সেতু) করিয়া দেয়ার আশ^াস বেশি দিছইন। কিন্তু পরে তাঁরা ভুলি যাইন, আর কোন খোঁজ নেইননা (নেননি)। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় ক্ষোভের সাথে এ কথাগুলো বলেন আবুতালিপুর গ্রামের বাসিন্দা ষাঠোর্ধ্ব মো. বশির মিয়া। এ ক্ষোভ শুধু বশির মিয়ার নয়, কুলাউড়া উপজেলার জয়চন্ডী ইউনিয়নের চারটি গ্রামের ১০ সহস্রাধিক মানুষের মাঝে বিরাজ করছে এমন ক্ষোভ।
সরেজমিন গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার জয়চন্ডী ইউনিয়নের মিঠুপুর-আবুতালিপুর সংযোগ সড়কের গোগালিছড়া নদীতে দীর্ঘদিন থেকে বাঁশ-বেত দিয়ে সাঁকো তৈরী করে স্থানীয় লোকজন চলাচল করছেন। প্রায় ৬০ ফুট দৈর্ঘ্যরে এ সাঁকোটির বর্তমান অবস্থা একেবারে নাজেহাল। কিছুদিন আগে নদী দিয়ে পাহাড়ি ঢল নেমে অধিকাংশ বাঁশের খুঁটি ভেঙ্গে সাঁকোটি এক পাশে কাত হয়ে গেছে। বর্তমানে বন্যার পানিতে সাঁকোটি ছুঁই ছুঁই। আর এই নড়বড়ে সাঁকো দিয়ে বাঁশ ধরে ধরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কয়েকটি শিশুসহ আশপাশের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পার হতে দেখা যায়। পাজোকোল করে একজন বৃদ্ধ রোগীকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে সাঁকো পার হচ্ছেন তাঁর স্বজন।
স্থানীয় বাসিন্দা ইমরান আহমদ, আতাউর রহমান দুদু, নওশা মিয়া, আরব মিয়া, আব্দুন নুর, উস্তার মিয়া, আনার খা জানান, আবুতালিপুর, রামপাশা, মিঠুপুর ও বেগমানপুর গ্রামের ১০ হাজারেরও বেশি মানুষকে গোগালিছড়া নদীর উপর নির্মিত ওই সাঁকো দিয়ে চলাচল করতে হয়। এলাকার মানুষ নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছে স্বাধীনতার পর থেকে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও তাদের সে দাবি পূরণ হয়নি। এ অবস্থায় তারা দুর্ভোগ শিকার হয়ে বাঁশের সাঁকো দিয়েই নদী পার হচ্ছেন। এসব এলাকার শিক্ষার্থীরা সাঁকো পার হয়ে স্থানীয় দিলদারপুর উচ্চ বিদ্যালয়, রহমত মিয়া ও বন্দে আলী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে লেখাপড়া করে। নদীর উপর সেতু নির্মাণের কোন উদ্যোগ না নেয়ায় প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে এলাকাবাসী চাঁদা তুলে এবং স্বেচ্ছাশ্রমে সাঁকোটি মেরামত করে চলাচলের উপযোগী করেন। এভাবেই প্রতিবছর সাঁকো মেরামতের জন্য মানুষকে নিতে হয় উদ্যোগ। কিন্তু নদী দিয়ে পাহাড়ি ঢল নেমে সাঁকোটি তছনছ হয়ে যায়। বিপাকে পড়েন চলাচলকারী লোকজন।
দিলদারপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লিজা বেগম, রুহান আহমদ, রুবা আক্তার, পহর, লিমা বেগম, রহমত মিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আনিশা, আব্দুল্লাহ, জামিল, তুহি বলে, একেতো ভাঙ্গা সাঁকো, তার উপর বন্যার পানি ছুঁই ছুঁই, এ অবস্থায় সাঁকো পার হতে আমাদের খুব ভয় লাগে। আর এই সাঁকো পারাপারের ভয়ে প্রায় দিন স্কুলে যাইনা।
মিঠুপুর জামে মসজিদের ইমাম হাফিজ আমির আলী বলেন, আমি এ মসজিদে প্রায় ১৫ বছর থেকে ইমামতি করছি। প্রতিবার বর্ষার সময় আসলেই সাঁকোটি ভেঙ্গে যায়। এসময় বয়স্ক মুসল্লি নামাজ পড়তে এবং সকালে মক্তবের শিক্ষার্থীরা আসতে পারেনা।
মিঠুপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি মো. কামাল আহমদ জানান, শুকনো মৌসুমে অনেক রোগী আসেন। কিন্তু বর্ষাকালে সাঁকো পারাপারের ভয়ে নদীর দক্ষিণ পাড়ের দু’টি এলাকার রোগীরা এখানে আসতে পারেনা।
রহমত মিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুতৃষ্ণা রানী সরকার বলেন, এখানে একটি সেতু খুবই জরুরি। বন্যার পানি এবং সাঁকো ভাঙ্গার ফলে নদীর দক্ষিণ পারের দু’টি গ্রামের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসতে পারেনা। এই সময় তারা লেখা-পড়ায় অনেকটা পিছিয়ে পড়ে।
দিলদারপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রুপিয়া বেগম বলেন, বর্ষা এবং বন্যার সময়টাতে প্রতিবারই এমন সমস্যায় পড়ে শিক্ষার্থীরা। বন্যার পানিতে ভরপুর এত লম্বা নড়বড়ে সাঁকো পার হতে আমাদেরই ভয় লাগে। যার ফলে প্রতিবছর এই সময়ে সাঁকো পারাপারের ভয়ে বিশেষ করে ছাত্রীরা স্কুলে আসতে পারেনা।
স্থানীয় ওয়ার্ড সদস্য বিমল দাস বলেন, একটি সেতু নির্মাণের জন্য এলাকার লোকজনকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরের দ্বারে দ্বারে গিয়েছি। অনেক প্রতিশ্র“তি পেয়েছি। কিন্তু আজও সেতু পাইনি।
জয়চন্ডী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কমর উদ্দিন আহমদ কমরু জানান, ‘গোগালিছড়া নদীতে সেতু নির্মাণের দাবিটি উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভায় একাধিকবার তুলে ধরেছি। কিন্তু কোনো আশ^াস পাচ্ছি না।