কাজিরবাজার ডেস্ক :
গত ৯ বছরে ১ লাখ ২০ হাজার ১৯১টি ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তথ্য বলছে, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা, অপহরণ, খুন, ছিনতাই, নির্যাতন, ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া, যৌন হয়রানিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পুলিশ সদস্যদের বিভাগীয় শাস্তি দেয়া হয়।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গড় হিসাবে বছরে ১৩ হাজার ৩৫৪টি ঘটনায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাস্তি নামমাত্র। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের এক শতাংশেরও চাকরি যায় না।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, ‘বিভাগীয় শাস্তির ক্ষেত্রে সাধারণত দায়িত্বে অবহেলা, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বৈধ আদেশ অমান্য করা, ক্ষমতার অপব্যবহার, অপেশাদার আচরণ, উৎকোচ গ্রহণ ইত্যাদি গুরুত্ব পায়।’
পিআরবি-১৮৬১ (পুলিশ প্রবিধান) অনুযায়ী, কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়ালে তার বিরুদ্ধে ২ ধরনের বিভাগীয় শাস্তির (লঘু ও গুরু) বিধান আছে। গুরুদন্ডের আওতায় চাকরি থেকে বরখাস্ত, পদাবনতি, পদোন্নতি স্থগিত, বেতন বৃদ্ধি স্থগিত ও বিভাগীয় মামলা হয়। মামলায় অপরাধ প্রমাণিত হলে বরখাস্ত করা হয়। গুরুদন্ডের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ আছে। ছোট অনিয়ম বা অপরাধের জন্য দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার, অপারেশনাল ইউনিট থেকে পুলিশ লাইনস বা রেঞ্জে সংযুক্ত করে লঘুদন্ড দেয়ার বিধান আছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মানবাধিকার পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন নূর খান লিটন। পুলিশের বিভাগীয় শাস্তি নিয়ে তার পর্যবেক্ষণও আছে। বিভাগীয় শাস্তির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা লক্ষ করেছি শাস্তি হলেও এক ভাগ ক্ষেত্রেও চাকরি যায় না। পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্তের পর সাধারণত তাদের ক্লোজড বা সংযুক্তি করা হয়। এবং পরবর্তীতে বলা হয়, তাদের শাস্তি দেয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু সময়ের জন্য তাদের হয়তো অন্যত্র সংযুক্ত করে রাখা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা বাহিনীতেই থেকে যায়। খুব কমসংখ্যক ঘটনায় পদাবনতি হয়, ইনক্রিমেন্ট কাটা পড়ে অথবা পুলিশ বাহিনী থেকে বের করে দেয়া হয়।’
নূর খান লিটন বলেন, ”লঘু ও গুরুদন্ডের মাঝখানে তদন্তের যে ব্যাপারটা থাকে সেখানে ‘নরম’ আর ‘গরম’ বলে দুটি বিষয় আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগের গুরুত্ব থাকলেও কম গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। ফলে দেখা যায়, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা খালাস পেয়ে যায়।”
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য
২০১০ কনস্টেবল থেকে এসআই পদমর্যাদার ১১ হাজার ৩৩ জনকে লঘুদন্ড, ৫৩৮ জনকে গুরুদন্ড, ৪৯ জনকে চাকরিচ্যুত ও ৬৪ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
২০১১ সালে ১২ হাজার ৯৭২ জনকে লঘুদন্ড, ৬১২ জনকে গুরুদন্ড, ৯০ জনকে চাকরিচ্যুত ও ৩৭ জনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়।
২০১২ সালে ১২ হাজার ৯৯২ জন পুলিশ সদস্যের শাস্তি হয়। এর মধ্যে ১৭৪ জনকে চাকরিচ্যুত ও ১৪ জনকে বাধ্যতামূলত অবসরে পাঠানো হয়েছে।
২০১৩ সালে ১৪ হাজার ৬০ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। এরমধ্যে ৭৫ জনকে চাকরিচ্যুত ও একজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
২০১৪ সালে ১৫ হাজার ২৯৭ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। এরমধ্যে ৭৩ জনকে চাকরিচ্যুত ও ৭ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
২০১৫ সালে ১০ হাজার ৩৪ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। এর মধ্যে চাকরি হারান ৭৮ জন।
২০১৬ সালে ১৩ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়।
২০১৭ সালে ১৬ হাজার ২৫৮ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৩৯৫ জনকে (কনস্টেবল থেকে এসআই পদবির) লঘুদন্ড, ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার ৩৫৭ জনকে গুরুদন্ড ও ২৯ জনকে লঘুদন্ড, সাতজনের বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্তসহ বিভাগীয় শাস্তি এবং ২৫ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
২০১৮ সালে ১২ হাজার ৭৩৩ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়।
বিভিন্ন ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির ঘটনা বাড়ছে। এর কারণ জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, ‘শাস্তি হওয়াটা ভালো দিক। তার মানে প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা আছে। শাস্তি হওয়া নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। শৃঙ্খলা মেনে চলা প্রতিষ্ঠান হিসেবে শাস্তি দেয়া হয় যথাযথ কারণেই। লঘুদন্ড দেয়া হয় ছোটখাটো অপরাধের জন্য। গুরুদন্ডও খুব বেশি হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘লোকজন রাতারাতি সব ভালো হয়ে যাবে তা-ও মনে করার কারণ নেই।’