কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা দেশ থেকে দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার দূর করতে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে দলমত নির্বিশেষে দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করে বলেছেন, সাধারণ ছোট-খাটো চোর ধরতে পারবে, কিন্তু বড় অর্থশালী-বিত্তশালী হলে তাদের হাত দেয়া যাবে না, ধরা যাবে না- এটা তো হয় না। আমার চোখে অপরাধী যে সে অপরাধীই। তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রী কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, কোন ধরনের অপরাধের সঙ্গে আমাদের দলেরও কেউ যদি সম্পৃক্ত থাকে, আমি তাদের ছাড় দিচ্ছি না, ছাড় দেব না। আর অন্য কেউ যদি করে তারা তো ছাড় পাবেই না। শাসনটা ঘর থেকেই করতে হবে, আমিও তাই করছি। এমনকি আইন-শৃঙ্খলা সংস্থার কেউ এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকে, সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং এটা অব্যাহত থাকবে। কারণ এটা সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত ত্রিশ মিনিটের প্রশ্নোত্তর পর্বে দুজন সংসদ সদস্যর পৃথক সম্পূরক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
জাতীয় পার্টির রওশন আরা মান্নানের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব সময় নিজেকে বাংলাদেশের জনগণের একজন সেবক মনে করি। প্রধানমন্ত্রিত্বটা হলো মানুষের জন্য কাজ করার একটা সুযোগ। আমি সর্বক্ষণিক চেষ্টা করি সেই সুযোগটুকু কাজে লাগিয়ে দেশের মানুষের কতটা উন্নয়ন করা যায়। দেশের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নতি কতটা করা যায়। অন্যায় অবিচারের হাত থেকে দেশের মানুষকে কীভাবে রক্ষা করা যায়?
তিনি বলেন, শুধু আমাদের দেশেই শুধু নয়, সব দেশেই দেখা যায়- একটা দেশ যখন অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নে অগ্রযাত্রা শুরু করে তখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ ধরনের টাউট বাটপার বা বিভিন্ন ধরনের লোক সৃষ্টি হয়। কিন্তু তাদের দমন করা এটা শুধু আইন শৃঙ্খলাবাহিনী দিয়ে সম্ভব না। এটা সামাজিকভাবেও করতে হবে। জঙ্গি-সন্ত্রাস-মাদক ও দুর্নীতি দমনে জনসচেতনতা সৃষ্টির বিষয়টি ইতোমধ্যে গুরুত্ব দিয়েছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী গোয়েন্দা সংস্থা সবাইকে কাজে লাগাচ্ছি। পাশাপাশি আমাদের সমাজের বিভিন্ন মানুষ যেমন শিক্ষক, অভিভাবক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সবাইকে নিয়ে বিশিষ্টজন জনপ্রতিনিধি আছে তাদেরকে বলব- প্রত্যেক এলাকায় একটা কমিটি করার। যাতে এ ধরনের কোন অন্যায়কে কেউ যেন প্রশ্রয় না দেয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে। সমাজ থেকে অন্যায় অবিচার দূর করতে হবে। শুধু বাহিনীর উপর নির্ভরশীল তা নয়, সামাজিকভাবে সচেতন করতে হবে। দুর্নীতি আমরা করব না, কাউকে দুর্নীতি করতে দেব না। ঘুষ যে গ্রহণ করবে, ঘুষ যে দেবে- তারা উভয়ই অপরাধী। দুজনকেই ধরা হবে। শুধু ঘুষ নিলে তাকে ধরা হবে তা নয়, যে দেবে তাকেও ধরা হবে। কারণ ঘুষ দেয়াটাও অপরাধ।
সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা বলেন, কেউ বলতে পারবেন না সবাই এক শ’ ভাগ সৎ হবে। ঈদের আগে যখন দেশের বাইরে ছিলাম তখন কিছু বড় বড় জায়গায় হাত দেয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলো। এটা আমার কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য ছিল না। মনে হয় এমন অনেক বড় জায়গা আছে যাতে হাত দিলেই হাতটা পুড়ে যাচ্ছে। যারা ধরতে যায় তারাই অপরাধী হয়ে যায়। কিছু পত্র-পত্রিকা লেখা-লেখি শুরু করে। তবে আমাদের সচেতন থাকতে হবে, কে কি বললো তাতে কান দেয়ার দরকার নেই।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ডাঃ রুস্তম আলী ফরাজীর সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষটা ছিল পরিকল্পিত। এই ঘটনার যিনি মূল হোতা ছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল জিয়াউর রহমান তাকে খাদ্যমন্ত্রী করেছিলেন। তার পুত্র বিএনপির এখনও বড় নেতা।
দুর্নীতি দমনে আলাদা কোন সংস্থার প্রয়োজন নেই : বিরোধীদল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য বেগম রওশন আরা মান্নানের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার টানা তৃতীয়বার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশের জনগণের কল্যাণে এবং দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করা, জনসচেনতামূলক কার্যক্রম জোরদার এবং আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতি পরিধি ক্রমান্বয়ে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার বিশেষ পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। এর মাধ্যমে সরকার দুর্নীতির বিষবৃক্ষ সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলে দেশের প্রকৃত আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও জনকল্যাণে একটি সুশাসনভিত্তিক প্রশাসনিক কাঠামো ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন করতে বদ্ধপরিকর।
সংসদ নেতা বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি স্বাধীন ও স্বশাসিত সংস্থা। কমিশন নিরপেক্ষভাবে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্ত করে। বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন এনফোর্সমেন্ট টিমের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন দফতরে তাৎক্ষণিক অভিযান পরিচালনা করছে। এর ফলে বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা কমে আসছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/দফতরে দুর্নীতির মাত্রা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী দুদককে শক্তিশালী করতে গৃহীত নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে বলেন, এ বাস্তবতায় দুর্নীতি দমনে আলাদা কোন সংস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে মর্মে প্রতীয়মাণ হয় না। এছাড়া বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিস থেকে কমিশনের চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় জনবল প্রেষণে দুর্নীতি দমন কমিশনে পদায়ন করা হচ্ছে। ফলে দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যকর অবদান রাখতে পারছে। তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি স্বাধীন সংস্থা। বিভিন্ন এলিট ফোর্স থেকে লোকবল নিয়ে দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে নতুন সংস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা নেই।
দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ : জাতীয় পার্টির অপর সংসদ সদস্য ডাঃ রুস্তম আলী ফরাজীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণের পর কৃষি ও কৃষকের ভাগ্যেন্নয়নে কাজ করে। আমরা ২০০০ সালের মধ্যেই দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করি। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় এসে কৃষিসহ সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের বদলে দেশকে পেছনে টেনে নিয়ে যায়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশে আবারও খাদ্য ঘাটতি দেখা যায়।
তিনি বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর কৃষি উন্নয়নে আন্তরিকভাবে কাজ করে। আমাদের কৃষিবান্ধব নীতি বাস্তবায়নের ফলে খাদ্য উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ১৩ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন। আমাদের দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে ২০০৮-২০০৯ সালে দেশে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৩ হাজার মেট্রিক টন। উৎপাদনশীলতার ধারাবাহিকতায় দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ আজ ধান উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, আলু উৎপাদনে সপ্তম এবং সবজি উৎপাদনে তৃতীয় স্থান অর্জনকারী দেশ।
বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত : সরকার দলীয় সংসদ সদস্য মোরশেদ আলমের প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা জানান, বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে তা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এক সময়ের তলাবিহীন ঝুড়ি বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে শামিল হয়েছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের দক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ২০১৭-১৮ সালে আমাদের জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ হবে বলে আশা করছি।
তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৯০৯ মার্কিন ডলার। ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ। এ সময়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ১০ শতাংশ। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তুলনীয় এক সুখী, সমৃদ্ধ এবং শান্তিপূর্ণ উন্নত জনপদ। মাথাপিছু আয় ১৬ হাজার মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশ আজ উন্নয়ন বিস্ময় : সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আছলাম হোসেন সওদাগরের প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা বলেন, সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে বর্তমান সরকার ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের উন্নয়ন ভাবনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়নে ফলে আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দেশী-বিদেশী নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে উন্নয়ন, অগ্রগতি আর সমৃদ্ধির পথে হাঁটছে আমাদের আজকের বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, আমাদের র্অর্থনৈতিক সক্ষমতা এমন পর্যায়ে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছি যে, পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প নিজেদের অর্থায়নে বাস্তবায়ন করছি। পদ্মা সেতুসহ আমরা ১০ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। আওয়ামী লীগ সরকারের জনকল্যাণমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়ন উদ্যোগ বাস্তবায়নের কারণে বাংলাদেশের এই উন্নয়ন এবং অদম্য অগ্রযাত্রা সম্ভব হয়েছে। আশির দশকের তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ কাটিয়ে বাংলাদেশ আজ উন্নয়ন বিস্ময় হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত উম্মোচিত হচ্ছে নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার।
কৃষকরা ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবে : সরকার দলীয় সংসদ সদস্য গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকারের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কৃষকরা যাতে ধানসহ সকল ধরনের ফসলের নায্যমূল্য পায় এবং মধ্য স্বত্বভোগীরা যাতে কৃষকদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে সে লক্ষ্যে আমরা কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছি।
তিনি জানান, কৃষকরা যাতে ধানের ন্যায্যমূল্য পায় সে লক্ষ্যে সরকার চলতি মৌসুমে দেড় লাখ মেট্রিক টন ধান কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি প্রতি কেজি ২৬ টাকা দরে ক্রয় করছে। বাজার দর বৃদ্ধির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে কৃষকের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ৩৫ টাকা কেজি দরে দেড় লাখ মেট্রিক টন আতপ চাল এবং ৩৬ টাকা কেজি দরে ১০ লাখ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহের সিদ্দান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। গত ২৫ এপ্রিল ২০১৯ তারিখ থেকে সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।