ভয়াল মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির ২২তম বার্ষিকী কাল ॥ এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ আদায় হয়নি

17

কমলগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা :
মাগুরছড়া ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি দিবস ১৪ জুন। এই দিন আসলে কমলগঞ্জতথা মৌলভীবাজার জেলার মানুষের মনে ঝলঝল সুনীল আকাশে দাবানল হয়ে উঠে সেই ভয়াবহ দৃশ্য। এক এক করে ২২ টি বছর কেটে গেলেও আদায় হয়নি ক্ষয়ক্ষতির টাকা। সেই ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল এসেছে নতুন নতুন সরকার। তবে ২২ বছর ধরে কোন এক অদৃশ্যের কারনে ক্ষয়ক্ষতির টাকা আদায় করা হয়নি যা সত্যিই রহস্যজনক। আর ২২ বছর ধরেও এই দিনটি নানা ভাবে পালন করছে বিভিন্ন প্রতিবাদী সংগঠনগুলো।
১৯৯৭ সালে ১৪ জুন মধ্যরাতে মাগুরছড়ার ১নং অনুসন্ধান কূপ খননকালে হঠাৎ করে ভয়াবহ বিষ্ফোরণ ঘটেছিল সেখানে। বিষ্ফোরণ ও বিকট শব্দে কেঁপে উঠে কমলগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা। বিষ্ফোরণে প্রত্যক্ষভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় সংরক্ষিত বনাঞ্চল, বন ও পরিবেশের জীববৈচিত্র, আখাউড়া-সিলেট রেলপথ, ফুলবাড়ি চা বাগান, কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল প্রধান সড়ক, মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির বাড়ি ঘর, পান জুম এলাকা ও পিডিবির ৩৩ হাজার কেভি প্রধান বিদ্যুৎ লাইনের। তাছাড়া পরোক্ষভাবে ২৮টি চা বাগানের ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। দীর্ঘ ৬ মাস বন্ধ ছিল কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়ক ও আখাউড়া-সিলেট সরাসরি রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ ১৫ কিঃমিঃ (৩৩ হাজার কেভি) উচ্চতাপ বৈদ্যুতিক লাইন পুড়ে নষ্ট হয়। কুলাউড়া, বড়লেখা ও কমলগঞ্জ উপজেলার ৫০ টি চা বাগানে দীর্ঘদিন স্থায়ীভাবে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দেয়। ৬৯৫ হেক্টর বনাঞ্চলের বৃক্ষ সম্পদ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এছাড়া ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে নষ্ট হয়, যার বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৫০ কোটি ডলার। দুর্ঘটনার এক দুই বছরের মধ্যে জানা যায়, লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্টের ৮৭ দশমিক ৫০ একর এলাকা গ্যাসের আগুনে ক্ষতি হয়। সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২০ দশমিক ৫০ একর এলাকা। সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ২০ একরে ৪.৭৫ ঘনফুট গাছ-গাছালির, ৫৫ হাজার ২শ টি পূর্ণ বয়স্ক বাঁশ এবং ১ লাখ ১৫ হাজার অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুড়ে গেছে। ক্ষতির পরিমান ৫ কোটি টাকা। এছাড়া ২৬ একরের বড় আকৃতির বহু সংখ্যক দামী বৃক্ষ সম্পূর্ণ ও আংশিক পুড়ে যায়। একইভাবে ৪১.৫০ একরের ২২.৮২৫ ঘনফুট গাছ-গাছালিরও আংশিক ক্ষতি ধরা হয়। সব মিলিয়ে পুড়ে যাওয়া গ্যাস, ক্ষতিগ্রস্ত বন ও পরিবেশের বিশাল ক্ষয়ক্ষতি আদায়ে মার্কিন কোম্পানিসমূহের টাল বাহানায় মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের ২০ বছরে ৩ টি কোম্পানির হাত বদল হয়েছে। কিন্তু পুরো ক্ষতিপূরণ আদায়ে কোন পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি।
মাগুরছড়া র্ট্যাজেডির তদন্ত রিপোর্টে বেরিয়ে আসে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি অক্সিডেন্টালের খামখেয়ালিপনার, দায়িত্বহীনতা, অবহেলা ও ত্রুটির কথা। ১৯৯৭ সালের জুন মাসে স্থানটি রাতারাতি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনামে পরিণত হয়।
মাগুরছড়া গ্যাসফিল্ডে ভয়াবহ এ বিস্ফোরণে মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণের পর দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাকে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটি ১৯৯৭ সালেরই ৩০ জুলাই মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিবের কাছে দুটি ভলিউমে প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়। পরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এ বিস্ফোরণের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ, ক্ষতিপূরণ পাওয়া ও তা বিতরণের বিষয়ে তিন সদস্যের একটি সাব কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি সাব-কমিটিকে জানায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালনে অক্সিডেন্টালের ব্যর্থতার জন্যই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। কমিটির তদন্তে অক্সিডেন্টালের কাজে ১৫ থেকে ১৬টি ত্রুটি ধরা পড়ে। অক্সিডেন্টালের কর্মকর্তারা দুই থেকে তিনটি ত্রুটির বিষয়ে আপত্তি জানালেও বাকিগুলো স্বীকার করে তদন্ত রিপোর্টে সই করেন। কিন্তু গ্যাস ফিল্ডে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ক্ষয়ক্ষতি পরিশোধ না করেই কোম্পানিটি আরেক মার্কিন কোম্পানি পানি ইউনিকলের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ইউনিকলও কিছুদিন কাজ করার পর ফের আরেক মার্কিন কোম্পানি শেভরনের কাছে তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চলে যায়।
ক্ষয়ক্ষতি প্রসঙ্গে তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়- মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্রে ছোট-বড় ৩৯টি চা বাগানের ক্ষতি হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয় ৪৬ কোটি ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩০ টাকা। এছাড়া বনাঞ্চলের মোট ক্ষতি ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৮৫৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা, ২ হাজার ফুট রেলওয়ে র্ট্যাক ধ্বংস বাবদ ক্ষতি ৮১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯৫ টাকা, সড়ক পথ বাবদ ২১ কোটি টাকা, গ্যাস পাইপ লাইন বাবদ ১৩ লাখ টাকা, বিদ্যুৎ লাইন বাবদ ক্ষতি ১ কোটি ৩৫ লাখ ৯ হাজার ১৮৬ টাকা, খাসিয়া পানপুঞ্জির অধিবাসীদের পানের বরজ বাবদ ধরা হয়েছে ১৮ লাখ টাকা, বাস মালিকদের রাজস্ব ক্ষতি ধরা হয়েছে ১২ লাখ টাকা। আর বিস্ফোরণে পুড়ে যাওয়া ভূগর্ভস্থ গ্যাসের পরিমাণ ৪৮৫.৮৬ বিসিএফ এবং এর মধ্যে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ ২৪৫.৮৬ বিসিএফ ধরা হয়। উত্তোলনযোগ্য ২৪৫.৮৬ বিসিএফ গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮৩৪ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা। ভয়াবহ এই বিস্ফোরণে মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ধরা হলেও মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির এতো গুলো বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও ওই মার্কিন কোম্পানির কাছ থেকে আজও মেলেনি ক্ষতিপূরণ।
এদিকে, ক্ষতিপূরণের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে পরিবেশবাদীসহ স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠন। দাবি আদায়ে মানববন্ধন, পদযাত্রা, সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, গণসংযোগসহ নানা কর্মসূচির পালন করছে। এবারও বিভিন্ন সংগঠন আলোচনা সভা, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালনের প্রস্তুতি নিয়েছে। পাহাড় রক্ষা ও উন্নয়ন সোসাইটি কমলগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি মোনায়েম খান জানান, ১৪ জুন সকাল ১০ টায় কমলগঞ্জ উপজেলা চত্বর থেকে মাগুরছড়ায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হবে। মাগুরছড়া গ্যাস কূপে আগুনে পুড়ে ছাই হওয়ার ২২ বছর অতিক্রম হলে এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়নি। ক্ষতিপূরণ আদায়, কমলগঞ্জ উপজেলাবাসীর ঘরে ঘরে গ্যাস লাইন সরবরাহসহ বিভিন্ন দাবী নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে স্মারকলিপি প্রদান করা হবে।