স্পোর্টস ডেস্ক :
এমন দুর্দান্ত শুরু খুব কমই হয়েছে। ‘উঠন্তি মুলা পত্তনেই চেনা যায়’ কথাটির স্বার্থকতা অবশ্য ২০০৭ ও ২০১৫ বিশ্বকাপে যথাক্রমে ভারতকে ৫ উইকেটে ও আফগানিস্তানকে ১১১ রানে হারিয়ে দিয়েছিল টাইগাররা। সেরা সাফল্যও পেয়েছিল। এবার দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে সেই ভাল শুরুটা পেয়েছে বাংলাদেশ দল। ভারতীয় গণমাধ্যমসহ অনেকেই এটিকে অঘটন দাবি করলেও দুর্দান্ত দলগত পারফর্মেন্সে শক্তিশালী প্রোটিয়াদের হারিয়ে দিয়েছে মাশরাফি বিন মর্তুজার দল। এর মাধ্যমে অনেকের কটুক্তি, সমালোচনা আর হেয় করে দেখার সমুচিত জবাব দিয়েছে বাংলাদেশ। বড় দলের বিরুদ্ধে এমন জয়ে উজ্জীবিত টাইগাররা এবার হট ফেবারিটদের বড় চ্যালেঞ্জের বার্তাই ছুড়ে দিয়েছে। চলতি বিশ্বকাপে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে এবার গত আসরের রানার্সআপ নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে জয় তুলে নেয়ার পালা। বুধবার দ্য ওভালেই দিবারাত্রির ম্যাচে কিউইদের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। ম্যাচটি বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে শুরু হবে। শুরুতেই ধাক্কা খাওয়াটা যেকোন দলকে পিছিয়ে দেয় অনেকখানি। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের কাছে ৬ উইকেটে, ২০০৩ বিশ্বকাপে দুর্বলতর কানাডার কাছে ৬০ রানে, ২০১১ বিশ্বকাপে ভারতের কাছে ৮৭ রানে হেরে বিশ্বকাপ মিশন শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের। পরর্বর্তীতে এই তিন আসরে আর আহামরি কিছু করে দেখাতে পারেনি। কিন্তু ‘বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এবার ঘুঘু তোমার বধিব পরান’- কথাটির স্বার্থক প্রয়োগ মাঠের ব্যাট-বলের প্রতিযোগিতায় দেখিয়ে দিয়েছে টাইগাররা। আর এটি ঘোষণা দিয়েই করেছেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। আইসিসি আয়োজিত অধিনায়কদের বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রোটিয়া অধিনায়ক ডু প্লেসিসকে লক্ষ্য করে মাশরাফি বলেছিলেন, ‘আমরা প্লেসিসদের হারিয়েই বিশ্বকাপ মিশন শুরু করতে চাই!’ সেই শুরুটা পাওয়ার পরেও অনেকেই বাংলাদেশের এ জয়টাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। বিশেষ করে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে পুরোপুরি ‘অঘটন’ বলেই চালিয়ে দিয়েছে এটিকে। কিন্তু মাশরাফির বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্ব, কৌশল এবং দলগত পরিকল্পনার সঠিক প্রয়োগ প্রোটিয়াদের পরাস্ত করেছে। আর এই কৌশলগত দিকগুলোতেই প্লেসিস পিছিয়ে গেছেন মাশরাফির চেয়ে। প্রোটিয়াদের মতো শিরোপার দাবিদার বড় দলকে এমন হেসে-খেলে হারানোয় টাইগার অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজারই ‘বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা’ দেখছেন ভারতের ক্রীড়া বিশ্লেষক ও ভাষ্যকার আকাশ চোপড়া। শুধু আকাশ চোপড়াই নয়, বিশিষ্ট ধারাভাষ্যকার ও সাবেক ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেসার ইয়ান বিশপও প্রশংসা করেন। এছাড়া অন্য ধারাভাষ্যকারও যা বলেছেন তার সারকথা হচ্ছে, ‘কৌশলগতভাবে দারুণ একজন অধিনায়ক এবং দলকে অনুপ্রাণিত করার অসম্ভব ক্ষমতা মাশরাফি মর্তুজার।’ আর ইয়ান বিশপ তো ঘোষণা দিয়েছেন অনেক বড় দল এখন বাংলাদেশ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আবার নিশ্চিত করল যে গত কয়েক বছর ধরে আমরা তাদের যে শক্তিশালী ভাবছি সেটা সঠিক। বিশ্বমানের খেলায় তারা এখন সত্যিকারের শক্তিশালী দল।’ পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কার মতো দলগুলোর বাজে শুরুর পর, ফেবারিটদের তালিকায় না থাকা বাংলাদেশই অবিস্মরণীয় কিছু করে দেখিয়েছে। বড় দলগুলোকেও একটি চ্যালেঞ্জের বার্তা ছুড়ে দিয়েছে টাইগাররা।
প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে দ্য ওভালের মাঠে পরাস্ত করাটা বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দ্বিতীয় জয়। ২০০৭ বিশ্বকাপেও তাদের হারিয়েছিল বাংলাদেশ, তবে সেটিকে অঘটনই বলেছিলেন অনেকে। এবার আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফেরার পর আর তেমনটা বলার সুযোগ কমই। এরপরও অনেকেই বাংলাদেশ দলকে এইবার কেউ বিবেচনায় রাখেননি। যেমন ভারতীয় গণমাধ্যম এটিকে অঘটন দাবি করেছে। আবার নিউজিল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককুলাম দাবি করেছিলেন শুধু শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই একমাত্র জয় পাবে বাংলাদেশ দল। তাদের এসব আলোচনাকে অনেকে মনস্তাত্ত্বিক খেলা হিসেবেও দেখছেন। নিজ দলগুলোর বিপক্ষে ‘ভয়ঙ্কর’ টাইগাররা মুখোমুখি হওয়ার আগেই কথা দিয়ে দুর্বল করার কৌশল। কিন্তু উজ্জীবিত বাংলাদেশ দলের আত্মবিশ্বাস এখন তুঙ্গে। বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে আগের ৪ ম্যাচে হেরে গেলেও এবার প্রথম জয় তুলে নিতে অনুপ্রেরণার রসদ পেয়ে গেছে দল। আর প্রোটিয়া বধের মাঠেই কিউইদের পাচ্ছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ ইংল্যান্ডের মাটিতে মোকাবেলায় ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ৫ উইকেটে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়েছিল টাইগাররা। সে ম্যাচে ৩৩ রানে ৪ উইকেট হারালেও কার্ডিফে অন্য এক ইতিহাস রচনা করে মাশরাফির দল। এবার আরেকবার তাদের মুখোমুখি হচ্ছে ‘চেনা’ হয়ে ওঠা ওভালে। আগের ম্যাচে প্রচুর বাংলাদেশী সমর্থকের উপস্থিতি বাংলাদেশ দলকে বুঝতেই দেয়নি তারা বিদেশের মাটিতে খেলতে নেমেছে। তেমন ভক্ত-সমর্থক উপস্থিতি থাকলে কিউইদের হারিয়ে দেয়াটাও কঠিন হবে না। ৩৫ বার ওয়ানডেতে মুখোমুখি হয়ে ১০ জয় তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ, আর ২৪ জয় নিউজিল্যান্ডের। একটি ম্যাচ হয়নি বৈরী আবহাওয়াতে। পরিসংখ্যান বাংলাদেশের জন্য বিরূপ হলেও দক্ষিণ আফ্রিকাকে কৌশলগত দিক থেকে পিছিয়ে রেখে জয় তুলে নিয়েছে ব্যাটে-বলে দলগতভাবে জ্বলে ওঠা বাংলাদেশ। কিউইদের বিরুদ্ধে তাই আরেকটু মানসিক দৃঢ়তা নিয়েই নামবে তারা। বিশেষ করে প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে এমন ‘পারফেক্ট’ একটি জয়ে বাকি দলগুলো প্রমাদ গুনতেই শুরু করেছে। বাংলাদেশ দল যে সহজ প্রতিপক্ষ হবে না তা অনেকেই আগে ভাগে বলে রেখেছিলেন। যেমন সাবেক পাক স্পিডস্টার শোয়েব আখতার। তিনি প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই দেখছেন। শোয়েব বলেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রথম এমন এশিয়ান দল যারা প্রমাণ করেছে যদি আপনার দলের ব্যাটসম্যানরা পুরো ৫০ ওভার টিকে থাকতে পারে তাহলে বড় স্কোর কোন ব্যাপারই না। বাংলাদেশ কোন ভুল করেনি। আমি আগেও এক অনুষ্ঠানে বলেছি, যদি বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দেয় তবে তা আপসেট হতেই পারে না। বাংলাদেশ এমন একটা দল যাদের স্পিনার আছে, পেসার আছে, যারা উইকেট তুলে নিতে পারে। এছাড়া তাদের ব্যাটিং লাইনআপ অনেক বড়। ৮ নম্বর পর্যন্ত তাদের ব্যাটসম্যান। তাই আমি আবারও বলব এটা আপসেট নয়। এশিয়ার বাকি দলগুলোরও বুঝতে হবে এটা তাদেরও টুর্নামেন্ট।’ ঈদের আগে বাংলাদেশের জনসাধারণ দারুণ এক আনন্দের উপহার পেয়েছেন মাশরাফিদের কাছে। বুধবার ঈদ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সেদিন সন্ধ্যায় শুরু হওয়া ম্যাচে কি গতবারের রানার্সআপ কিউইদের বধ করে তাদের অহংকারের পতন ঘটাতে পারবেন মাশরাফি-সাকিবরা? প্রত্যাশার চাপ বেড়ে যাওয়া কিংবা পরিবারের সঙ্গে ঈদ পালন করতে না পারার বিষয়গুলোকে পাত্তাই দিচ্ছেন না মাশরাফি। এখন শুধু এগিয়ে যেতে চান ধারাবাহিক নৈপুণ্যে। তবে তিনি জানালেন নিউজিল্যান্ডকে হারাতে হলে আবারও দলগতভাবেই জ্বলে উঠতে হবে।