কাজিরবাজার ডেস্ক :
বাংলাদেশের উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন পূরণে জাপানের সহায়তা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। বুধবার রাজধানী টোকিওতে জাপান ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে এ বিষয়টি উঠে এসেছে।
বৈঠকের পর শিনজো আবে ও শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য জাপানের সঙ্গে আড়াই শ’ কোটি ডলারের উন্নয়ন সহায়তা চুক্তি করেছে বাংলাদেশ সরকার। চুক্তির পর যৌথ বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ’৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি আমরা। এ লক্ষ্য পূরণে জাপান আমাদের পাশে থাকবে ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবে বলে প্রধানমন্ত্রী আবে আমাকে নিশ্চিত করেছেন।
জাপান এককভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগী। ’৭২ সাল থেকে জাপানের কাছ থেকে বাংলাদেশ এক হাজার ১৩০ কোটি ডলারের সহায়তা পেয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুটি প্রকল্পের ৩৬ হাজার কোটি টাকার মাতারবাড়ি বিদ্যুুত কেন্দ্র ও বন্দর এবং ২২ হাজার কোটি টাকার মেট্রোরেল প্রকল্পের বেশিরভাগ অর্থই দিচ্ছে জাপান। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে জাপানের জন্য ‘বিশেষ জায়গা’ রয়েছে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা স্বাধীনতার পর থেকেই জাপানের সহায়তার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। জাপানের ঐতিহাসিক উন্নয়ন থেকে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। ‘স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর আমরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলতে পারি, সেই কাক্সিক্ষত স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে এখন আমরা সঠিক পথ ধরেই এগিয়ে চলেছি।’
জাপানের সঙ্গে করা আড়াই শ’ কোটি ডলারের উন্নয়ন সহায়তা চুক্তির অর্থে মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-১), বিদেশী বিনিয়োগ সহায়ক প্রকল্প (২), জ্বালানি দক্ষতা ও সুরক্ষা সহায়ক প্রকল্প (পর্যায়-২) ও মাতারবাড়ি আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র প্রকল্পে (৫) অর্থায়ন করা হবে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, জাপান সব সময় আমাদের পাশে আছে।’
শিনজো আবের সঙ্গে বৈঠকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতাকে আরও শক্তিশালী ও সম্প্রসারণ করার বিষয়ে কিছু নতুন ধারণা (আইডিয়া) নিয়ে আলোচনা করেছি।’ সম্ভাব্য যেসব ক্ষেত্র থেকে দুই দেশই লাভবান হতে পারে, সেগুলো নিয়ে কাজ করার বিষয়ে দুই প্রধানমন্ত্রীই একমত হয়েছেন বলে জানান তিনি। আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি বিষয়ে শিনজো আবের সঙ্গে আলোচনার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নেও জাপান সহায়তা দেবে বলে শিনজো আবে নিশ্চয়তা দিয়েছেন।
আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার বিষয়টিও দুজনের আলোচনায় স্থান পেয়েছে বলে জানান শেখ হাসিনা।
সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা এবং পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের মতো বিষয়গুলোতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ’ জাপান একে অপরের প্রতি সহযোগিতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আড়াই বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন সহায়তা চুক্তি করায় শিনজো আবেকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
বৈঠকে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়টিও উঠে আসার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসা ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাদের মানবিক ও রাজনৈতিক সঙ্কটের বিষয়ে টেকসই ও দ্রুত সমাধানের উপায় খোঁজার বিষয়ে তারা ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি জাপান অনুভব করতে পারছে। মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যাওয়ার মতো সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন বলেও মনে করে জাপান। শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ককে সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমি ও প্রধানমন্ত্রী আবে আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছি।’
বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের ‘পরীক্ষিত বন্ধু’ জাপানে চার দিনের সফরে মঙ্গলবার রাজধানী টোকিও গেছেন শেখ হাসিনা। বুধবার বিকেল পৌনে ছয়টার দিকে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছলে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান শিনজো আবে। এ সময় সুসজ্জিত একটি দল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গার্ড অব অনার দেয়। এরপর শুরু হয় দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠক। দুই দেশের নীতিনির্ধারক ছাড়াও সরকারী কর্মকর্তারা বৈঠকে অংশ নেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পক্ষে বৈঠকে ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমেদ, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান, এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ ও পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক প্রমুখ।
গত জানুয়ারিতে টানা তৃতীয় দফা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর শেখ হাসিনার এটাই প্রথম জাপান সফর। বৃহস্পতিবার ‘দ্য ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সম্মেলনে তিনি এশিয়ার সম্ভাবনা ও উত্থান নিয়ে নিজের ভাবনার কথা তুলে ধরবেন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও তাত্ত্বিকদের সামনে।