মসিক মেয়র ও কাউন্সিলরদের শপথ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ॥ শুধু ভোটে জেতা নয়, জনগণের হৃদয়ও জয় করতে হবে

77
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কার্যালয়ে ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলরদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে নবনির্বাচিতদের সঙ্গে গ্রুপ ছবিতে অংশ নেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের কল্যাণে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, শুধু ভোটে জয়লাভ করলেই চলবে না, জনগণের হৃদয়ও জয় করতে হবে। জনগণ আপনাদের যে বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে নির্বাচিত করেছেন তাদের সে বিশ্বাস ও আস্থার মর্যাদা দিতে হবে। কাজের মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে।
সোমবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর তার তেজগাঁওয়ের কার্যালয়ে ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের (মসিক) নবনির্বাচিত মেয়র এবং কাউন্সিলরবৃন্দের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন। মসিক নবনির্বাচিত মেয়র ইকরামুল হক টিটু শপথ বাক্য পাঠ করান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরসহ ৪৪ জন নতুন ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের শপথবাক্য পাঠ করান স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম। শপথ অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এস এম গোলাম ফারুক।
নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশে করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনস্বার্থে যদি আপনি কাজ করেন, মানুষের হৃদয় যদি আপনি জয় করতে পারেন তাহলে দেখবেন জনগণই আপনার ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছে এবং আপনাকে তাদের সেবা করার সুযোগটা বারবার দেবে। জনগণ আপনাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে, আপনারা তাদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছেন। তাদের প্রতি আপনাদের দায়িত্ব রয়েছে। রাজনীতিটা যদি ব্যক্তি স্বার্থে হয় তাহলে সে রাজনীতি কখনও জনগণের কল্যাণ করতে পারে না।
প্রধানমন্ত্রী নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশে করে আরও বলেন, আপনাদের ওপর বিরাট দায়িত্ব। তাই মনে রাখতে হবে-জনপ্রতিনিধি হওয়া মানেই জনগণের জন্য, শুধু যারা আপনাকে ভোট দিয়েছে তারা নয়, আপনি এলাকার সব মানুষেরই প্রতিনিধি। তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ আমি আওয়ামী লীগের সভাপতি কিন্তু যখন প্রধানমন্ত্রী তখন সমগ্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। দল মত নির্বিশেষে সকলের কল্যাণ করাই আমার দায়িত্ব। তাই আপনারাও সেভাবে নিজেকে মনে করবেন এবং স্ব-স্ব দায়িত্ব আপনারা পালন করবেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে এবং বিশ্বের দরবারে যে মর্যাদার আসন করে নিয়েছে সেটা অব্যাহত থাকবে। আপনারা সেভাবেই কাজ করবেন এবং আমার তরফ থেকে সবরকম সহযোগিতা আপনারা পাবেন। তিনি বলেন, ময়মনসিংহ নতুন সিটি কর্পোরেশন, এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু আমার বিশ্বাস আছে সেটা আপনারা পারবেন। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের আমলে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে অতীতের তুলনায় কয়েকগুণ বাজেট বৃদ্ধির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, আগামী ১৩ জুন জাতীয় সংসদে এ বছরের বাজেট পেশ করা হবে এবং এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার হবে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, উন্নয়ন বাজেট যা অতীতে ছিল মাত্র ১৯ হাজার কোটি টাকা সেটার আকার দাঁড়াবে এবার প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ উন্নয়নের ছোঁয়াটা কেবল শহরভিত্তিক নয়, একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে গ্রাম ভিত্তিক যেন হয়। আর এবারেও আমরা ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়ন করেছি। দেশের বাজেটের ৯০ শতাংশ সরকার নিজস্ব অর্থায়ন থেকে বাস্তবায়ন করে থাকে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় স্বাধীন জাতি হিসেবে কারো কাছে হাত পেতে নয় বরং আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় তার সরকারের সাফল্য তুলে ধরেন। বাংলাদেশকে আমরা জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদ মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি উল্লেখ করে তিনি নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা এই বিষয়টা অবশ্যই ভালভাবে দেখবেন। তিনি বলেন, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ এবং মাদক- যা একটা পরিবারকে ধ্বংস করে, একটি দেশকে ধ্বংস করে, সমাজকে ধ্বংস করে। কাজেই, আপনাদের কারো ছেলে-মেয়েই কখনও যেন এদিকে দৃষ্টি না দেয়। এর সঙ্গে জড়িত না হয়।
তিনি বলেন, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, মাদক এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপনাদের গণসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে এবং এসব প্রতিরোধে একযোগে কাজ করতে হবে। এ সময় তিনি প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে সকলকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, দুর্নীতি করলে কোন লাভ হয় না। কারণ একদিন মাটির নিচে চলে যেতে হয়। তখন আর অর্জিত সম্পদের কোন কিছুই সঙ্গে যায় না। উপরন্তু বদনামটা থেকে যায়। কাজেই দেশকে আমরা দুর্নীতিমুক্ত করতে চাই। তাহলে আমাদের দেশ আরও উন্নত হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, ময়মনসিংহসহ এই অঞ্চলের মানুষের যেন সার্বিকভাবে কল্যাণ হয় সেদিকে দৃষ্টি রেখেই ময়মনসিংহ বিভাগ এবং সিটি কর্পোরেশন করা হয়েছে। কাজেই তিনি নতুন সিটি কর্পোরেশনে কাজের চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সচেষ্ট থাকার জন্যও নির্বাচিতদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে সরকারে আসার পরই দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্জন করে। তাঁর সরকার ৪০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি নিয়ে যাত্রা শুরু করে দেশকে উদ্বৃত্ত খাদ্যের দেশে পরিণত করে। ২০০১ সালে সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার সময়ও দেশে ২৬ লাখ টন খাদ্য মজুদ ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকারের ১৯৯৬ থেকে ২০০১ মেয়াদেই জনগণ অনুভব করে যে সরকার জনগণের সেবক। আর ২০০১ পরবর্তী বিএনপি-জামায়াতের সরকারের সময় দেশটি সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, বোমা হামলা, অস্ত্র চোরাকারবারি, মানি লন্ডারিং এবং দুর্নীতির একটি আখড়ায় পরিণত হয়। তিনি বলেন, জঙ্গীবাদ, দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। আবার সেই উদ্বৃত্ত খাদ্যের দেশটি খাদ্য ঘাটতির দেশে পরিণত হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, গত এক দশকে তাঁর সরকারের শাসনে বাংলাদেশ আজকে উন্নত হয়েছে। আজকে জাতির পিতার হাতে গড়া বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের দেশ, মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। যে মর্যাদা ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যার পর আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম। তিনি বলেন, আমাদের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের ওপরে উঠেছে। আমাদের মাথা পিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে, আমরা দারিদ্র্যের হার ৪১ থেকে ২১ ভাগে নামিয়ে এনেছি। ইনশাল্লাহ সামনে একে আরও কমিয়ে আনব এবং বাংলদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করে গড়ে তুলব, সেটাই আমাদের স্বপ্ন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ২৬ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত মুজিববর্ষ পালন এবং নেদারল্যান্ডস সরকারের সহায়তায়তার সরকার গৃহীত শতবর্ষ মেয়াদী ‘ডেল্টা পরিকল্পনা-২১০০’ গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে তার সরকারের উদ্যোগও তুলে ধরেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. তৌফিক এলাহী চৌধুরী এবং জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা বেগম রওশন এরশাদ অন্যদের মধ্যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। কোন প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী একরামুল হক টিটু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত হন। এর আগে জাতীয় পার্টির (জাপা) মেয়র পদপ্রার্থী জাহাঙ্গীর আহমেদ তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। গত ৫ মে অনুষ্ঠিত হওয়া ময়মনসিংহের সিটি নির্বাচনের ৩৩টি ওয়ার্ডের ভোটার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৯৭ হাজার। ৩৩টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদের জন্য প্রায় ২৪২ প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এছাড়া ১১টি সংরক্ষিত আসনে প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৭০ জন। দেশের ১২তম সিটি কর্পোরেশন ময়মনসিংহের সিটি নির্বাচনে এবার ভোট প্রদানে ইভিএম ব্যবহার করা হয়।
শপথের পর এক প্রতিক্রিয়ায় মেয়র ইকরামুল হক টিটু সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে যে গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন তা পালনে সচেষ্ট থাকব। স্থানীয় নাগরিকদের মতামতের ভিত্তিতে এলাকার সকল সমস্যা সমাধান করতে চাই। এ ক্ষেত্রে দল মত নির্বিশেষে সবার সমান গুরুত্ব থাকবে। আগামীকাল বুধবার পরিচিত সভার মাধ্যমে মেয়রের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করবেন বলেও জানান তিনি।