শিক্ষিতদের প্রায় ৫০ শতাংশই বেকার

42

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাড়লেও মান সঙ্কট আর কাজের বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিহীন শিক্ষাব্যবস্থার কারণে বেড়েই চলেছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। প্রতিবছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেকই বেকার থাকছেন অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছেন না। লাখ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কাজের বাজারের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রতিবছর ২৫ থেকে ৩০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছেন। কিন্তু কাজ পান মাত্র সাত থেকে আট লাখ। প্রায় ৫০ শতাংশ স্নাতকই বেকার। শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষার মান সঙ্কট বেকার সমস্যাকে প্রকট করছে। বিদেশেও কমছে সনদের মর্যাদা। সঙ্কট উত্তরণে শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন ও কার্যকর এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল হতে পারে বড় সমাধান।
উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিতের আশায় দেশে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বাংলাদেশ এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদও উদ্বিগ্ন দেশের উচ্চশিক্ষার মানের সঙ্কটজনক পরিস্থিতি নিয়ে। তিনি বলেছেন, আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশে প্রশ্ন আছে। দিন দিন সার্টিফিকেট মূল্যায়নে পিছিয়ে পড়ছি আমরা। এর মূল কারণ হচ্ছে গবেষণাহীন, সেকেলে শিক্ষা, অগভীর ও অগোছালো শিক্ষা পদ্ধতি। শৃঙ্খলা ও মানোন্নয়নে তাই যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া দরকার। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে এই মুহূর্তে বাস্তব, পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে এ জাতি। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে নবগঠিত বাংলাদেশ এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলকে (বিএসি) কর্মময় ও সক্রিয় করতে সবার সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। কারণ শিক্ষার মানোন্নয়ন গবেষণা, কোয়ালিটি ও সিলেবাস কারিকুলাম ডেভেলপমেন্টে এখনই হাত না দিলে ভবিষ্যাতে এর দায় আমাদের নিতে হবে।
মানহীন উচ্চশিক্ষা শিক্ষিত বেকার সমস্যা বাড়াচ্ছে মন্তব্য করে অধ্যাপক ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, উচ্চশিক্ষায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে আসন সংখ্যা সাড়ে ছয় লাখের বেশি। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন রয়েছে ৫৩ হাজারের ওপরে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে তিন লাখ ২৭ হাজার প্রায়। এর বাইরে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশকিছু আসন রয়েছে। ইন্টার লেভেলে ৩৬ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। তারা ১৫৫টি প্রাইভেট ও সারাদেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত প্রায় দুই হাজার বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অনার্স, মাস্টার্স সম্পন্ন করছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কি পড়ানো হচ্ছে তাদের? প্রায়ই দেখি দেশে হাজার হাজার শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার পরও বেকার হয়ে রাস্তায় চাকরির জন্য ঘুরছে। এর মূল কারণ হলো মানহীন শিক্ষায় শিক্ষিত তারা।
হতাশা প্রকাশ করে এ শিক্ষাবিদ আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনও দেখা গেছে, ১৯৭৭ সালের জনৈক শিক্ষার্থীর হ্যান্ড নোট নিলক্ষেত থেকে ফটোকপি করে পড়ছে ২০১৯ সালের শিক্ষার্থীরা। যুগ যুগ ধরে চলছে ডিপার্টমেন্টের ওই বড় ভাইয়ের নোট। একই বিভাগের গত বাধা সেই নোট তোতা পাখির মতো ঠোঁটস্ত করে যাচ্ছে। তারা পাস করছে কিন্তু মেধাহীনভাবে। এখনও চার পাঁচ দশক আগের সিলেবাসে চলছে বেশ কিছু ডিপার্টমেন্ট।
গবেষণার ধারেকাছেও নেই এগুলো। এ হল আমাদের উচ্চশিক্ষার একাংশের চিত্র। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ। সাত কলেজের ঝামেলা তো লেগেই আছে। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের গুরুত্বের কথা তুলে ধরে অধ্যাপক ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত যেসব সমস্যা সামনে চলে এসেছে তার সঠিক সমাধান, পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও নিরূপণ করাই এই কাউন্সিলের কাজ। বিশ্বের অনেক দেশে এ কাউন্সিল গঠন করে তার এক্সপার্টরা উচ্চশিক্ষায় আমূল পরিবর্তন এনেছেন।
এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার নাম বলতেই হয়। বিগত ৫ বছরে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। কারণ উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নে যে ক্যাটাগরি তারা দিয়েছে তা পালনে ব্যর্থ হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এখন শিক্ষায় এসেছে সুষ্ঠু পরিবেশ। বাংলাদেশ এ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের লক্ষ্য ধীরে ধীরে সে পথের দিকেই ধাবিত হওয়া।
কিন্তু উচ্চশিক্ষায় মান সঙ্কট আর কাজের বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিহীন শিক্ষাব্যবস্থার কারণে কিভাবে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা? আর শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়লে দেশের সেই চিত্রটাই বা কেমন? কি বলছেন দেশী-বিদেশী গবেষণা সংস্থা ও শিক্ষাবিদরা? তারা বলছেন, এটি একটি বড় সমস্যা হলেও সরকারীভাবে ভাল কোন গবেষণা বা জরিপ খুব একটা দেখা যায় না। প্রায় পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপেও উঠে এসেছিল বেকারত্বের একটি চিত্র। সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে শ্রমশক্তির পরিমাণ প্রায় ছয় কোটি। এর মধ্যে সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের কাজ আছে। এর অর্থ প্রায় অর্ধ কোটি মানুষ বেকার। তবে জরিপেই বলা আছে, পরিবারের মধ্যে কাজ করে কিন্তু কোন মজুরি পান না, এমন মানুষের সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। এ ছাড়া আছে আরও এক কোটির বেশি আছেন দিনমজুর, যাদের কাজের কোন নিশ্চয়তা নেই।
তবে বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থা বিশেষত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার হিসাব বলছে, বাংলাদেশের প্রায় ৫০ শতাংশ স্নাতকই বেকার। দক্ষিণ এশিয়ায় এর চেয়ে বেশি উচ্চ শিক্ষিত বেকার আছেন কেবল আফগানিস্তানে ৬৫ শতাংশ। বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্নাতকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা আর কাজের বাজারের চাহিদার মধ্যে বিশাল ফারাক থাকায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও বাড়ছে। বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। যদিও এ পরিসংখ্যান কয়েক বছর আগের, এখন এই পরিমাণ আরও বেড়েছে বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
‘হাই ইউনিভার্সিটি এনরোলমেন্ট, লো গ্র্যাজুয়েট এমপ্লয়মেন্ট’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে ইআইইউ বলেছে, গত এক দশকে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়লেও শিক্ষার গুণগত মান বাড়েনি। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। আর শ্রমবাজার ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয় নেই। স্থানীয় ও বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিতদের কারিগরি ও কাজ করার মতো দক্ষতা কম। তাই উচ্চ শিক্ষিত স্নাতকদের অনেকে বেতন পান বেশ কম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের মান বৈশ্বিক মানদ-ের সঙ্গে তুলনীয় হওয়ার কথা থাকলেও দেশের শিক্ষাকে বাজার উপযোগী নয় বলে বলছেন বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, শিক্ষায় সবার জন্য আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
বিশ্বব্যাংক মনে করে, সরকার কম দেখালেও প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এর ওপর এখন প্রতিবছর নতুন করে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছেন। সুতরাং নতুন কর্মসংস্থান তৈরির চাপ রয়েছে অর্থনীতির ওপর। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের হার ২ শতাংশ বাড়ানো গেলে প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে উন্নীত হবে। আর তাহলেই ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ হওয়া সম্ভব।
দেশীয় গবেষণা সংস্থাগুলোর অভিমত প্রায় অভিন্ন। তারা বলছে, প্রতিবছর ২৫ থেকে ৩০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু কাজ পায় মাত্র সাত থেকে ৮ লাখ। প্রায় ৫০ শতাংশ স্নাতকই বেকার। শিক্ষার মান সঙ্কট উচ্চ শিক্ষিত বেকার সমস্যাকে প্রকট করছে। উচ্চ শিক্ষিত অর্থাৎ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যারা শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন, তারাও আছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে কিছু করার চেষ্টা করেন। আবার অনেকে নিজের যোগ্যতার চেয়ে কম মানের কাজ করতে বাধ্য হন।