বন্দর সেরি বেগওয়ানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ॥ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে সব ধরনের উদ্যোগ চান ব্রুনাইয়ের সুলতান

48
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রুনাই সফরের ২য় দিন দারুস সালামের জেম এএসআর মসজিদ পরিদর্শন করছেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মিয়ানমারে নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিজভূমে ফেরত পাঠাতে ‘সব ধরনের উদ্যোগ’ নেয়া উচিত বলে মনে করছেন ব্রুনেই সুলতান হাজী হাসান আল বলকিয়া।
ব্রুনাইয়ের রাজধানী বন্দর সেরি বেগওয়ানে সোমবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সুলতান বলকিয়ার এই মত প্রকাশ করেন।
সুলতানের বাসভবন ইস্তানা নুরুল ইমানের চেরাদি লায়লা কেনচানায় শেখ হাসিনার সঙ্গে এই বৈঠক হয় বলে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক সাংবাদিকদের জানান। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে (সুলতান) বেশ বড় একটা বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের সবাই মিলে একটা সমাধানে আসা উচিত। আমাদের সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া উচিত, যাতে তারা ফিরে যেতে পারে।’ ২০১৭ সালের আগষ্টে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন অভিযান শুরুর পর সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তার আগে গত কয়েক দশকে এসেছে আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করেছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলো। তবে মিয়ানমার সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
মিয়ানমার বলে আসছে, তাদের নাগরিকদের মধ্যে যারা বাংলাদেশে আছে, যাচাই-বাছাই করে তাদের ফিরিয়ে নিতে তারা তৈরি আছে।
কিন্তু জাতিসংঘ বলছে, মিয়ানমারে এখনও রোহিঙ্গাদের ফেরার মতো অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। আর রোহিঙ্গারা বলছে, নিরাপত্তার পাশাপাশি নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা পেলেই কেবল তারা ফিরে যাওয়ার কথা ভাববে।
রোহিঙ্গাদের ফেরার মতো অনুকূল পরিবেশ যেন মিয়ানমার তৈরি করে, সে বিষয়ে তাদের চাপ দিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক যোগাযোগ চালিয়ে আসছে বাংলাদেশ। শহীদুল হক বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা ইস্যুতে আসিয়ানের বড় ইনভলভমেন্ট চেয়েছেন এবং এ বিষয়ে ব্রুনাইয়ের সুলতানের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
‘আর সুলতান রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আসিয়ানের ইনভলভমেন্টের কথা বলেছেন আসিয়ান হিউম্যানেটেরিয়ান সেন্টারের কনটেক্সটে।’
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ‘শক্তিশালী’ করার বিষয়ে ব্রুনাই সবসময় সহায়তা করে যাবে- এমন আশ্বাস সুলতানের তরফ থেকে এসেছে বলে জানান পরারাষ্ট্র সচিব।
সুলতানের আমন্ত্রণে তিনদিনের সরকারী সফরে রবিবার বন্দর সেরি বেগওয়ানে পৌঁছান শেখ হাসিনা। সোমবার সকালে তিনি সুলতানের বাসভবনে পৌঁছালে প্রোটোকল ভেঙ্গে এগিয়ে এসে সুলতান বলকিয়ার ও যুবরাজ হাজী আল মুহতাদি বিল্লাহ তাকে স্বাগত জানান।
রাজ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর সুলতানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর। বৈঠক শেষে তাদের উপস্থিতিতে ছয়টি সমঝোতা স্মারকে সই ও একটি কূটনৈতিক নোট বিনিময় হয়।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘গত নির্বাচনে জিতে টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করায় শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান সুলতান। তিনি বলেন, ‘এটা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের স্বীকৃতি হিসেবে জনগণের রায়।’
‘দুই দেশের সম্পর্কের সম্প্রসারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই সফর মাইলফলক হয়ে থাকবে বলেও মন্তব্য করেন সুলতান।’
পররাষ্ট্র সচিব জানান, দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান যোগাযোগ চালুর বিষয়টি দুই নেতার কথাতেই এসেছে। প্রবাসী শ্রমিকদের বিষয়ে একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ করার প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
‘নন-উইপেন রিলেটেড অঞ্চলে সামরিক সহযোগিতার বিষয়ও আলোচনায় এসেছে। হিউম্যানিটি, অপারেশন্স, নলেজ শেয়ারিং সুলতানও কিন্তু শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অবদানের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।’
ওআইসির সদস্য দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচ রাষ্ট্র বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই ও ইন্দোনেশিয়া মিলে একটি অর্থনৈতিক জোট গড়ার সম্ভাবনার কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে বলেন।
তিনি ব্রুনাইয়ের সুলতান ও তার স্ত্রীকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালে সুলতান তা গ্রহণ করেন বলে পররাষ্ট্র সচিব জানান। সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ের সময় প্রেস সচিব ইহসানুল করিম ও স্পিচ রাইটার নজরুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন।
রবিবার ব্রুনাই পৌঁছে প্রবাসী বাংলাদেশীদের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। পরে বাংলাদেশ হাইকমিশনারের দেয়া নৈশভোজে অংশ নেন।
আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ফোরাম গঠনের প্রস্তাব : এদিকে বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সদস্য পাঁচটি দেশের সমন্বয়ে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ফোরাম গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। সোমবার সকালে ব্রুনাইয়ের সুলতানের সরকারী বাসভবন ইস্তানা নুরুল ইমান এ ব্রুনাইয়ের সুলতান হাজী হাসানাল বলকিয়ার সঙ্গে আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রস্তাব করেন।
আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে পররাষ্ট্র সচিব মোঃ শহীদুল হক বলেন, প্রস্তাবিত আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ফোরাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (সিয়াকো) -এর সদস্য হবে দক্ষিণ এশিয়া থেকে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ব্রুনাই। পররাষ্ট্র সচিব জানান, প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ব্রুনাইয়ের সুলতান আশ্বস্ত করেন যে, তিনি বিষয়টি নিয়ে ‘অনুকূল বিবেচনা’ করবেন। ব্রিফিংকালে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম ও বক্তৃতা লেখক নজরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আলোচনায় রোহিঙ্গা সঙ্কটসহ দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ সংক্রান্ত বিষয়গুলো স্থান পায়।
বাংলাদেশ ও ব্রুনাইয়ের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা আরও জোরদার করার জন্য প্রধানমন্ত্রী আরও কিছু প্রস্তাব করেছেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং এ লক্ষ্যে একটি অগ্রাধিকার বাণিজ্য ব্যবস্থার সম্ভাব্যতা যাচাই করার প্রস্তাব করেছেন। শেখ হাসিনা দু’দেশের মধ্যে যৌথ কমিশন গঠনের বিষয়ে আলোচনা করার প্রস্তাব দেন। তিনি পাট ও পাটজাত পণ্য, সফটওয়্যার, কৃষি পণ্য, সিরামিক ও টেবিলওয়্যার, জাহাজ নির্মাণ শিল্প ও পর্যটন ক্ষেত্রে সহযোগিতার উপর গুরুত্বারোপ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, সরকার শিল্পপার্ক স্থাপন করছে যেখানে ব্রুনাইয়ের উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে পারে। তিনি দ্বৈত কর পরিহার করার পাশাপাশি পারস্পরিক প্রচার এবং বিনিয়োগের সুরক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ব্রুনাইয়ের প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে অগ্রাধিকার দেন এবং বলেন, দুই দেশের মধ্যে স্বাস্থ্য পেশাজীবী ও ফার্মাসিউটিক্যালসের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সহযোগিতা গড়ে তোলা যেতে পারে। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও সুলতান উভয়ই বাংলাদেশ ও ব্রুনাইয়ের মধ্যে সরাসরি বিমান চলাচল শুরুর কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী মানবিক কর্মসূচী ও জ্ঞান বিনিময়ের মতো অস্ত্রশস্ত্রবিহীন ক্ষেত্রে সামরিক সহযোগিতার প্রস্তাব দেন। এ প্রসঙ্গে সুলতান বিশ্বজুড়ে সমস্যাক্রান্ত অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করেন। ব্রুনাইয়ের সুলতান হাজী হাসানাল বলকিয়া গত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ এবং চতুর্থবার সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানান। সুলতানের উদ্ধৃতি দিয়ে হক বলেন, ‘এটি জনগণের রায় এবং বিজয়টি হল বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের স্বীকৃতি যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে অর্জিত হয়েছে’। একই সঙ্গে, সুলতান বলেন, ব্রুনাই ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে ও সম্প্রসারণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সফর একটি মাইলফলক। সুলতান বলেন, দু’দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির এক বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, ব্রুনাই ও বাংলাদেশের মধ্যে জ্বালানি, খাদ্য, জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগ এবং যোগাযোগের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা তৈরি করা যেতে পারে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে, বলকিয়া রোহিঙ্গা সঙ্কটের ‘সঠিক ও স্থায়ী সমাধান’ করার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সব ধরনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা উচিত যাতে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে পারে’। হক বলেন, এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আসিয়ানের বড় ধরনের অংশগ্রহণ কামনা করেন। প্রধানমন্ত্রী সুলতানের সহযোগিতাও কামনা করেন। আসিয়ান সম্পর্কে সুলতান আশ্বাস দেন যে, বাংলাদেশ এবং আঞ্চলিক ফোরামের সহযোগিতাকে শক্তিশালী করতে ব্রুনাই সহায়তা প্রদান করবে। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আলোচনাকালে শেখ হাসিনা ব্রুনাইয়ের সুলতানকে তার স্ত্রীসহ বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। পররাষ্ট্র সচিব আরও বলেন, এর আগে, সুলতান ব্রুনাইয়ের ঐতিহ্যবাহী রাজকীয় প্রোটোকল ভেঙ্গে প্রাসাদের সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান।